অভিমন্যুর মৃত্যু কাহিনী: চক্রব্যূহের রহস্য উদ্ঘাটন

মহাভারতের অভিমন্যুর পরিচয়

অভিমন্যু, পাণ্ডবদের মধ্যে তৃতীয়, অর্জুনের ছেলে। তার মা সুভদ্রা, যিনি শ্রীকৃষ্ণের বোন। অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরা, মৎসরাজ বিরাটের কন্যা। তাদের একমাত্র সন্তান পরীক্ষিত, যে পরে হস্তিনাপুরের রাজা হয়। অভিমন্যুকে বালযোদ্ধা ও বীরশিশু হিসেবে স্মরণ করা হয়, কারণ সে কম বয়সেই দুর্দান্ত বীরত্ব দেখিয়েছে। তার চরিত্রে সাহস, নিষ্ঠা ও কর্তব্যবোধের চিহ্ন রয়েছে। অভিমন্যুর মৃত্যু একটা দুঃখজনক ও নাটকীয় ঘটনার পরিণতি, যা মূলত কৌরবদের ষড়যন্ত্র এবং তার নিজের নানা অজ্ঞতার ফল।

অভিমন্যুর মৃত্যু কাহিনী hd
অভিমন্যুর মৃত্যু কাহিনী

মাত্র ১৬ বছর বয়সে অভিমন্যুর মৃত্যু হল কেন?

অভিমন্যু মহাভারতের এক বীর যোদ্ধা, যার মধ্যাহ্নাত্মা আমরা সবাই জানি। তাঁর সাহস ও শক্তির জন্যে তিনি আজও বিখ্যাত। মহাভারতের এই যোদ্ধার গল্প ইতিহাসেও পাওয়া যায়। তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে মারা যান, আর এর পিছনে রয়েছে একটি বিশেষ কাহিনী। আসুন জেনে নিই সেই কারণ।

অভিমন্যু ছিলেন অর্জুন ও সুভদ্রার ছেলে, আর তিনি শ্রীকৃষ্ণের ভাগ্নে। তাঁর শৈশব কাটে দ্বারকায়, যেখানে তিনি পিতার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন এবং মামার তত্ত্বাবধানে বড় হন। তিনি চক্রবিহূতে ঢুকতে পারতেন, কিন্তু বেরোতে জানতেন না। কারণ তিনি যখন মায়ের गर्भে ছিলেন, তখন অর্জুন তাঁকে ঢুকতে শিখিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মা সুভদ্রা তখন ঘুমাচ্ছিলেন। ফলে তিনি বেরোবার কৌশল শিখতে পারেননি, যা তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

মহাভারতের যুদ্ধের সময় তাঁকে হত্যা করার জন্য চক্রবিহূ তৈরি করা হয়েছিল। কৌরবদের হাতে মারা যান তিনি। আসলে, অভিমন্যু ১৬ বছর বয়সে মারা যান কারণ তাঁর জন্মবেলার ভাগ্য ছিল মাত্র ১৬ বছর মর্তলোকে থাকার। পূর্ব জন্মে তিনি চন্দ্র দেবতার পুত্র হিসেবে ছিলেন। দেবতাদের নির্দেশে চন্দ্র দেবতা তাঁর পুত্রকে মানবরূপে জন্ম দিতে রাজি হন, কিন্তু বলেন যে তিনি মাত্র ১৬ বছরের জন্যে তাঁকে মর্তলোকে পাঠাবেন। এভাবেই অভিমন্যুর ১৬ বছর বয়সে মৃত্যু ঘটে।।


পূর্ব জন্মের কি কারণে অভিমন্যুর মৃত্যু কম বয়সে হল?

মহাভারতের মূল পাঠে অভিমন্যুর পূর্ব জন্ম নিয়ে সোজাসুজি কিছু বলা হয়নি, কিন্তু কিছু লোকগল্প আর আঞ্চলিক গল্পে তার অকাল মৃত্যুর পেছনে পূর্বজন্মের করমফল বা অভিশাপের কথা রয়েছে। এখানে কয়েকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া হল:

১. বালি (বানররাজ) ও সুগ্রীবের কাহিনি সম্পর্কিত অভিশাপ (দাক্ষিণাত্য লোকগল্প)
কিছু গল্পে বলা হয়, অভিমন্যু রামায়ণ যুগের বানররাজ বালি-এর পুনর্জন্ম ছিলেন। বালি ছিলেন শক্তিশালী যোদ্ধা, কিন্তু শ্রীরামের হাতে মারা যান। মৃত্যুর সময় তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন: যেভাবে আমাকে ঠকিয়ে হত্যা করা হলো, তুমিও (রাম) এক দিন পুত্রশোকে কাঁদবে! এই অভিশাপের কারণে রামের অপর অবতার শ্রীকৃষ্ণকে তার ভাগ্নে অভিমন্যুর মৃত্যু দেখতে হয়েছিল।

২. চন্দ্রদেবের পুত্র বর্চার অভিশাপ (কাশ্মীরী পৌরাণিক কাহিনি)
কিছু সংস্করণে অভিমন্যুকে চন্দ্রদেবের পুত্র বর্চা-র অবতার বলা হয়, যিনি একবার ঋষিদের অভিশাপে ১৬ বছর বয়সে মারা যান। অভিশাপের কারণ: বর্চা খুব অহংকারী ছিলেন এবং ঋষিদের তপস্যায় বাধা দিয়ে ছিলেন। এই কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ, অভিমন্যুও ছোটবয়সে চক্রব্যূহে প্রাণ হারান।

৩. অশ্বিনী কুমারদের অভিশাপ (বঙ্গীয় লোককথা)  
একটা বাংলা গল্পে বলা আছে, অভিমন্যু আগেও অশ্বিনী কুমারদের অপমান করেছিল। তারা তাকে শাপ দেয়: তুই যুদ্ধে হারবি না, কিন্তু অসম্পূর্ণ জ্ঞানের জন্য শেষ হবে! এর সাথেই চক্রব্যূহে তার অর্ধশিক্ষার বিষয়টি যুক্ত হয়।  

৪. মহাভারতের মূল পাঠে কর্মফলের কথা  
মহাভারতের মূল বইয়ে পুরাতন জন্মের বিষয়টা সরাসরি নেই, তবে কিছু ইঙ্গিত আছে: অর্জুনের পাপের ফল? অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অশস্ত ভীষ্ম ও কর্ণের প্রতি অবিচার করেছেন। অনেকের মতে, তার জন্য তিনি পুত্রশোকের মুখোমুখি হয়েছেন। সুভদ্রার কষ্ট: সুভদ্রা শ্রীকৃষ্ণের বোন, কিন্তু স্বামী (অর্জুন) ও পুত্রের বিচ্ছেদ তাকে টেনেছে, যা সম্ভবত তার আগের জন্মের কর্মফল।  

৫. দার্শনিক দৃষ্টিকোণ: আকাশের লিখন বনাম স্বাধীন ইচ্ছা  
অভিমন্যুর মৃত্যুকে শুধু পূর্বজন্মের দোষ বলে দোষারোপ করা ঠিক হবে না—এটা মহাভারতের কিছু পাঠের শিক্ষা নিয়ে আসে: অহংকারের ফল: অভিমন্যু আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, যা তাকে চক্রব্যূহে প্রবেশের জন্য বাধ্য করেছিল। ধর্মের জটিলতা: কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অধর্ম সাময়িকভাবে জিতেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের জয় হয়েছে—যা ধর্মের ধীর, তবে নিশ্চিত বিজয়ের কথা বলছে।

অভিমন্যুর অকালমৃত্যুকে আমরা পূর্বজন্মের শাপ বা কর্মফল দিয়ে বুঝতে পারি, তবে মহাভারতের আসল বার্তা হলো, নিজের কাজটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।

তার কাহিনী আমাদের কিছু শেখায়:
অর্ধশিক্ষা হতে পারে বিপজ্জনক (চক্রব্যূহ থেকে বেরোতে না পারা),
অধর্মী শক্তি সব সময় নিয়ম ভাঙবে (কৌরবদের সমন্বিত আক্রমণ),
মৃত্যুই শেষ কথা নয়—অভিমন্যুর গুণাবলি ও তার ছেলে পরীক্ষিতের মাধ্যমে পাণ্ডব বংশ বাঁচে।
এই কারণেই আজও অভিমন্যু বালবীর হিসেবে পরিচিত!

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url