কোন দিন সহবাস করলে সুসন্তান লাভ হয়

অনেক দম্পতি ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে সন্তান নেওয়ার সময় ও পদ্ধতি জানার চেষ্টা করেন। ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে সুসন্তান পাওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট দিন ও পদ্ধতি রয়েছে।
সুসন্তান লাভ  hd
সুসন্তান লাভ


ধর্মীয় মতে কোন দিন সহবাস করলে সুসন্তান লাভ হয়? ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি

অজানাকে জানার জন্য লজ্জা পাওয়া উচিত নয়। অনেক বিবাহিত পুরুষ ও নারীরা একে অপরের সঙ্গে মিলে যৌন তৃপ্তি নিচ্ছেন, কিন্তু কয়জনই আসলে সন্তান নিতে মিলিত হন? একটু ভাবুন তো! সন্তান তো অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেই আসে, আর মূলত যৌন তৃপ্তির পর আলোর মতোই। তাই গর্ভধারণ কালে কিছু বিষয় জানা দরকার। বিবাহিত জীবন যাপনের মূল লক্ষ্য হলো স্বাস্থ্যবান, যোগ্য, সফল ও সৎ সন্তান পাওয়া। স্বামী-স্ত্রী এমনভাবে বানানো হয়েছে যে তারা যখন একসঙ্গে হয়, তখন স্ত্রী গর্ভবতী হন। তবে মিলনের জন্য ভালো সময়, তারিখ এবং শুভ অশুভ সবকিছু বিচার করা হয়, কারণ এগুলোর প্রভাব সন্তানের ওপর পড়ে।

হিন্দু শাস্ত্রমতে শুভ সময়

হিন্দু ধর্মে সুসন্তানের জন্য কিছু বিশেষ সময় উল্লেখ আছে, যেগুলো গর্ভধারণের জন্য ভালো সময় বলে মনে করা হয়। শাস্ত্রীয় গ্রন্থে কি লেখা আছে  আসুন সে ব্যাপারে আমরা একটু বিস্তারিত জেনে নেই::


স্মৃতি শাস্ত্রে লিখিত আছে
নিষেকাদ্ বৈজিকং চৈনো গার্ভিকং চাপমৃজ্যতে।
ক্ষেত্রসংস্কার সিদ্ধিশ্চ গর্ভাধানফলং স্মৃতম্।।
বাংলা অর্থ: এটা বোঝায় যে নিয়ম ও প্রথা অনুসারে গর্ভধারণের মধ্যে থেকে ভালো গুণের যোগ্য সন্তান জন্ম নেয়। এই প্রথার মাধ্যমেই বীর্য ও গর্ভের সমস্যাগুলো দূর হয়। ফলে সঠিক পরিবর্তন আসে। এই সবই গর্ভধারণের সংস্কারের ফল।

সুশ্রত সংহিতায় লেখা আছে

আহারাচার চেষ্টা ভিয়াদৃশোভি সমন্বিতৌ।
স্ত্রীপুংসৌ সমুপেয়াতাং তয়োঃ পুত্রোত্তপি তাদৃশঃ।।
( সুশ্রত সংহিতা / শরীর ২/৪৩/৫০ )

অর্থাৎ-পুরুষ ও মহিলার আচরণ ব্যবহার ওই মুহূর্তে যেমন প্রদর্শন করবেন  ঠিক তেমনি আপনার সন্তানের উপরে তার প্রভাব পড়বে   তাদের সন্তানরাও একই রকমের গুণ পায়।

কোন দিন সহবাস করলে সুসন্তান লাভ হয় এবং কখন সহবাস  করা যাবেনা


1. ঋতুকালের চতুর্থ দিনে স্নান করে পবিত্র হয়ে, পূর্ণ শ্রদ্ধা ও সাত্ত্বিক ভাবনায় ঈশ্বর ও মহাপুরুষগণকে প্রণাম করে, স্বামীর সঙ্গে সহবাস করলে সুশীল, ধার্মিক ও উত্তম সন্তান জন্মলাভ করে। বিশেষ করে রাত ১২টা থেকে ভোর ৩টার মধ্যে সহবাসের ফলে যে সন্তান জন্ম হয়, সে ভক্ত ও ধার্মিক স্বভাবের হয়। ঋতুকালের চতুর্থ, ষষ্ঠ, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ, পঞ্চম, সপ্তম, নবম ও একাদশ রাতে সহবাস করা সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত।


2. একদাশী, দ্বাদশী বা কোন ব্রতের আগে বা ব্রতের দিন বা ব্রতের পরের দিন সহবাস করলে সন্তান অসুর হয়ে জন্মায়। অমাবস্যা, পূর্ণিমা, চতুর্দশী, রবিবার, সংক্রান্তি, অষ্টমী, গ্রহণ, বারবেলা, কালবেলা, রাক্ষসীবেলা, শনি বার, মঙ্গলবার, পূজা পর্বের দিন সহবাসে উৎপন্ন সন্তান রাক্ষস ও দুঃখী হয়। সকালে, সন্ধ্যায়, দূপুরে সহবাস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।


3.  দৈত্যমাতা দিতি প্রাতঃকালে জোরপূর্বক মহর্ষি কশ্যপকে সহবাসে বাধ্য করলে, তাদের ঔরসে হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু নামক দুই অসুর পুত্র এবং হোলিকা নামক এক অসুরী কন্যা জন্মগ্রহণ করে।


4. কেকসী সন্ধ্যাকালে মহর্ষি বিশ্রবাকে সহবাসে বাধ্য করলে, তাদের ঔরসে রাবণ নামে এক রাক্ষস সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সুতরাং, সন্ধ্যাকালে সহবাস শাস্ত্রবিরুদ্ধ এবং নিষিদ্ধ। অতএব, মনে রাখতে হবে—গর্ভাধান একটি পবিত্র কর্ম। এটি সর্বদা শুদ্ধ বস্ত্রে, শুদ্ধ শয্যায় এবং শুদ্ধ চিত্তে সম্পন্ন করা উচিত। তবেই সুশীল, ধার্মিক, সুকুমার পুত্র বা কন্যা সন্তান লাভ সম্ভব।


5. ক্লান্তি, চিন্তা, ভীতি, মলমূত্রের বেগ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা অথবা মানসিক অস্থিরতার সময় সহবাস সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ। গর্ভধারণের সময় ধর্মচিন্তায় মনোনিবেশ করলে সন্তান ধার্মিক ও সদাচারী স্বভাবের হয়।

6. গবেষণায় বলা হয়েছে যে, গর্ভধারণকালে পিতা-মাতার চিন্তা, মানসিকতা ও আচার-ব্যবহার সন্তানের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। তাদের ভাবনা, মনোভাব ও কামনা-বাসনার প্রতিফলন সন্তানের রক্ত ও বীর্যে প্রকাশ পায়। ফলে, সেই সন্তান যেমন চরিত্র, ধর্মবোধ ও গুণের অধিকারী হবে, তা অনেকাংশে পিতা-মাতার চিন্তাভাবনার প্রতিফলন হিসেবে প্রতিফলিত হয়।


গর্ভাধানের আগে এই মন্ত্র পাঠ করতে হয়।


গর্ভং ধেহি সেনাবালি গর্ভং ধেহি প্রথুষ টুকে।
গর্ভং তে অশ্বিনী দেবাবাধাতাং পুষ্কর স্রজৌ।।

অর্থাৎ হে সেনাবলি দেবী! হে প্রথুষটুকা দেবী, তুমি এই স্ত্রীকে গর্ভধারণের শক্তি দান করো এবং তার গর্ভকে পুষ্ট করো। কমলমালা ধারিণী অশ্বিনীকুমার ভাতৃদ্বয়ও তার গর্ভকে পুষ্ট করুন।

ইসলামিক দৃষ্টিকোণে উত্তম সময়

ইসলামে সুসন্তান পাওয়ার জন্য কিছু বিশেষ সময় এবং পদ্ধতির কথা বলা হয়। চলুন, সেগুলো সম্পর্কে একটু আলোচনা করি।

👉 প্রথমত, শুক্রবারের রাতকে বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ মনে করা হয়। ইসলামিক স্কলারদের মতে, শুক্রবার দিন এবং রাত উভয়ই আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদা রাখে। এই সময়টা দোয়া করার জন্য অনেকেই প্রার্থনা করেন, কারণ তারা বিশ্বাস করেন, এতে আল্লাহর রহমত বেশি থাকে।

👉 এরপর রয়েছে আরাফার দিন, যা জিলহজ মাসের ৯ তারিখে পড়ে। এই দিনটি হজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এতে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে বিশেষ ফজিলত লাভ হয়। অনেকেই এই দিনকে নিজেদের জন্য এবং পরিবারের জন্য দোয়া করার সময় হিসেবে বেছে নেন।

👉 আরেকটি বিশেষ সময় হলো পবিত্র রমজান মাস, বিশেষ করে লাইলাতুল কদরের রাত। এই রাতটি মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রচুর মুসলমান এই রাতের কদর জানেন এবং তারা আশা করেন, তাদের প্রার্থনা আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে।

👉 তাহাজ্জুদ নামক রাতের শেষ তৃতীয়াংশের প্রস্তুতি নিয়েও কথা বলতেই হয়। এই সময় দোয়া এবং ইবাদতের জন্য বিশেষভাবে উত্সাহিত করা হয়। যারা রাতে উঠেন এবং আল্লাহর কাছে গভীরভাবে প্রার্থনা করেন, তাদের জন্য একটা বিশেষ ওয়াদা আছে। 

সব মিলিয়ে, ইসলামের এই সময়গুলো সুসন্তানের জন্য দোয়ার এক অনন্য সুযোগ দেয়, যা সত্যিই অনেকের জীবনে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে জড়িয়ে যায়।

সহবাসের আগে কিছু কিছু মুসলিম সাধারণত দু'রাকাত নফল নামাজ পড়ে থাকেন। এটা ঐতিহ্যবাহী একটি কর্মকাণ্ড, যা অনেকের বিশ্বাস অনুযায়ী, মঙ্গল এবং শান্তির জন্য সহায়ক। নামাজ শুরু করার সময় বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলে একটা ভালো অনুভূতি আসে এবং মনে হয় যেন আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। এর পর বিশেষ দোয়া পড়ার অভ্যাসও অনেকের। এই দোয়া সহবাসের সময় শান্তি এবং বিশেষ বরকত পেতে সাহায্য করে। 

অনেকে মনে করেন, এই সবকিছু করার ফলে সম্পর্ক আরও মজবুত হয় এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা এবং সহযোগিতা বাড়ে। সব মিলিয়ে, এগুলো এমন কিছু পদক্ষেপ, যা স্বামী-স্ত্রীর সর্ম্পকে ভালো চিন্তা এবং সুন্দর আবহ তৈরি করে। বরাবরের মতো ছোট ছোট কাজগুলোর মধ্যে এ ধরনের আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড সম্পর্ককে আরও বিশেষ করে তোলে এবং ভালোবাসা বাড়িয়ে তোলে।


প্রায়শ জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (H3)

Q: কি কি বিষয় সুসন্তান লাভে সহায়ক?

A: ধর্মীয় বিধান মেনে চলা, পুষ্টিকর খাদ্য, ইতিবাচক চিন্তা ও নিয়মিত প্রার্থনা। শাস্ত্র অনুযায়ী ভালো সন্তান পেতে প্রথমে শ্রদ্ধা ও পরিশুদ্ধ আচরণ দরকার। দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতা বজায় রাখা, ব্রহ্মচার্য ও সৎসঙ্গ মেনে চলা ভালো। শুদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত, যা সৎবৃত্তি গড়ে তোলে। গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত দিন, তিথি ও নক্ষত্র মানা জরুরি, যা সন্তানের গুণাবলীকে প্রভাবিত করে। সবশেষে, ঈশ্বরের উপাসনা ও বিশ্বাসের সঙ্গে প্রার্থনা করলে সন্তান ভালো গুণের আর ধার্মিক হয়ে জন্ম নেয়।

Q: কোন সময়সীমা এড়িয়ে চলা উচিত?

A: ইসলামে ঋতুস্রাবের সময়, হিন্দু ধর্মে অমাবস্যা ও কৃষ্ণপক্ষের কিছু নির্দিষ্ট দিন। শাস্ত্র মতে, গর্ভধারণের জন্য অমাবস্যা, চতুর্দশী, অষ্টক, রাহুকাল ও কেতুকাল এড়াতে বলা হয়েছে, কারণ এগুলোকে অশুভ মনে করা হয়। বিশেষ করে সংক্রান্তি ও অশুভ যোগের দিনগুলিতে গর্ভধারণ করলে সন্তানের স্বাস্থ্যে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। দ্বাদশী ও চতুর্দশী তিথি, যেখানে চন্দ্রের প্রভাব কম থাকে, সেগুলোও এড়ানো উচিত। রাতে, বিশেষ করে অর্ধরাত্রি থেকে মধ্যরাত্রির মধ্যে গর্ভধারণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সবশেষে, অশুদ্ধ পরিবেশ এবং দুঃশ্চিন্তা থেকে গর্ভধারণ করলে সন্তানের মনোবিদ্যার ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।

উপসংহার: শাস্ত্র মতে, সন্তানের জন্ম কেবল শরীরের বিষয় নয়, এটা আসলে এক ধরনের পবিত্র সৃষ্টি। মানে, যখন আমরা সময়মতো গর্ভধারণ করি, তখন সেই সন্তানের চরিত্র, স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে পারি, তার বুদ্ধিমত্তা ও সৌভাগ্যও বাড়িয়ে তোলা সম্ভব হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url