খনার বচন | বাংলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি প্রবাদ ও নীতিবাক্য
খনার বচন বলতে বোঝায় বাংলার পুরনো লোকজ জ্ঞানভিত্তিক উপদেশ গুলো, যা মূলত কৃষি, ঋতুচক্র, জ্যোতিষ, স্বাস্থ্য, সমাজনীতি আর দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার ওপর তৈরি হয়েছে। এগুলো খনা নামে পরিচিত এক মহিলা জ্যোতিষীর সাথে সম্পর্কিত, যিনি প্রাচীন বাংলার প্রথম মহিলা জ্যোতিষী ও দার্শনিক ছিলেন।
প্রশ্ন গণনা (প্রশ্নের শুভাশুভ বলিয়া দেওয়া)
সাত পাঁচ তিন কুশল বাত, নয়ে একে হাতে হাত।
কি করবে ছটে চটে, কার্য নাশ দুয়ে আটে ।।
জন্মলগ্নের শুভাশুভ নির্ণয়-সূর্য কুব্জ, রাহু মিলে,
গাছের দড়ি বন্ধন গলে। যদি রাখে ত্রিদশনাথ, তবু সে খায় নিচের ভাত । খনা বরাহেরে বলে কোন্ লগ্ন দেখ। লগ্নের সপ্তম ঘরে কোন গ্রহ দেখ । আছে শনি সপ্তম ঘরে, অবশ্য তারে খোঁড়া করে। থাকয়ে রবি ভ্রমায় ভূখণ্ড। চন্দ্র থাকয়ে ধরে নবদণ্ড। মঙ্গল থাকে করে খণ্ড খণ্ড! অস্ত্রাঘাতে যায় তার মুণ্ড ॥ থাকে বুধ বিষয় করায়, গুরু শত্রু থাকে বহু ধন পায়'। লগ্নে আঁকা, লগ্নে বাঁকা, লগ্নে থাকে ভান্তনুজা। লগের সপ্তম অষ্টমে থাকে পাপ, মরে জননী পীড়ে বাপ ॥ খালি ছাগলা বৃষে চাঁদা, মিথুনে পুরিয়ে বেদা। সিংহে বসু কি কর বসে। আর সব পুরিবে দশে ॥
![]() |
খনার বচনের সমস্ত শ্লোক |
পরমায়ু গণনা করতে হলে তিথি-বার আর জন্ম নক্ষত্র ভালোভাবে বিচার করো। যদি শ্বশুরবাড়ির লোক মন্দ চিন্তাশীল হয়, তাহলে মুহূর্তেই জীবন কেটে যেতে পারে অনেক বছরের মতো।যে ছেলে বিশটি হাতি বা গজের মতো ভোগ করে, সে অর্ধেক জীবনেই সব হারায়। যে বাইশটি বলদ আর তেরোটি ছাগল পোষে, সে নিজেই হয়ে যায় অর্ধেক বুদ্ধির মানুষ (পাগলা)।
দম্পত্তির মধ্যে অগ্র-পশ্চাৎ মরণ গণনা-অক্ষর দ্বিগুণ
মাত্রা চৌগুণ । করি সমতা নামে নামে ॥ হরে আন তাহে তিন দিয়ে। মরা বাঁচা যান ।। এক শূন্যে মরে পতি। থাকিলে দুই মরে যুবতী।
তিথি গণনা-রবি কুড়ি সোমে ষোল, পঞ্চদশ মঙ্গলে ভাল। বুধ এগারো বৃহস্পতি বারো, শুক্র ক্রু চৌদ্দ শনি তেরো।
হাঁচি জোঠি পড়ে যবে, অষ্টগুণ লভ্য হবে।'
যাত্রার শুভ সময় নিরূপণ-মঙ্গলের উষা বুধে পা, যথা
ইচ্ছা মানেই সব নয়—
রবি, মঙ্গল, গুরুর উষা কালে,
বাকিগুলো কেবল ফাঁকা ফসফসা বালে।
পাখি ডাকি, বাসা ছাড়ে না তবু,
উড়লে মনে হয়, খাবো এবারই কদাচিৎ স্বপ্নর রসদে ভরপুর।
ঘরে ফেরে পাখি, পথ পায় না—
অন্তরে বিভ্রান্তি, চেনা আলোয় ছায়া ছায়া।
খনা ডেকে বলে— ঐ যে উষা,
উড়লো পাখি, খেতে পারল না কিছুমাত্র।
তবে কেন গেল? বোঝে না কেউ ঠিক ঠিক।
যাত্রাকালীন শুভ লক্ষণ-শূন্য কলসী শুরুক্কা না। শুকনা
ডালে ডাকে কা। যদি দেখ মুকুন্দ চোপা। এক পা না বাড়াও বাপা। ভরা হতে শূন্য ভাল যদি ভরতে যায়। আগে হতে পিছে ভাল যদি ডাকে মায়। মরা হতে জ্যান্ত ভাল যদি মরতে যায়। বাঁয়ে হতে ডানে ভাল যদি ফিরে চায়। বাঁধা হতে খোলা ভাল মাথা তুলে চায়। হাসা হতে কাঁদা ভাল বাঁয়।
হাঁচি টিকটিকির ফল খনার জিভ কেটে বরাহ তা নিভৃতস্থানে রেখেছিলেন। কিন্তু একটি টিকটিকি খাদ্যদ্রব্য মনে করে তা খেয়ে নেয়। সেই থেকে টিকটিকির শব্দেও ভূত-ভবিষ্যৎ প্রকাশ করা হয় শয়নে ভোজনে উপবেশনে বা দানে।বস্ত্র পরিধানে আর বিবাহে বিবাদে ॥ অতি সুশোভন এই সপ্ত কর্মে হাঁচি।
অন্য কাজে কখনোই হয় না শুভ ফল,
বৃদ্ধ, শিশু বা কফ-জর্জর কেউ দিলে হাঁচি, তাহা নেব না অবহোল।
যত্নে থাকো—এই হাঁচি কখনোই মেনে নিও না ভুলে,
গোধনের কালে হাঁচি হলে, মৃত্যু ডেকে আনে গোপনে।
জ্যোতিষ বলেছে স্পষ্ট—এই হাঁচি গ্রহণ বারণ।
দিক নির্ণয় করো বুদ্ধি দিয়ে, বুঝে চলো রীতিমতো,
উর্ধ্বদিকে হাঁচি হলে, ধনলাভ আর কাজের সফলতা ঘটে নির্ভরতায়।
কিন্তু যদি হয় পূর্ব দিকে, অগ্নিকোণের কাছে—তাহলে ভয়ের বার্তা,
দক্ষিণ কোণে হাঁচি মানে, অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা।
নিশ্চয়। নৈর্ঝতে কলহ লাভ পশ্চিমেতে ভাব। বায়ুকোণে নববস্ত্র গন্ধ জয়লাভ। উত্তরেতে টিকটিকি হাঁচি স্ত্রীলাভ কারণ। ঈশানে
হইলে মৃত্যু কে করে বারণ ।।
রবিবার দোযে অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টির লক্ষণ-পাঁচ রবি মাসে পায়। ঝরা কিংবা খরায় যায়।
চৈত্র মাসে বারদোষে, জানো বৎসরের ফল,
মধুমাসের প্রথম দিনে যে বার পড়ে, তা বলে ভবিষ্যতের বল।
রবিবারে শুরু হলে চোষে বছর—মনে রাখো কষ্টের কাল,
মঙ্গলবার হলে দুর্ভিক্ষ আসে, ফসল হয় চরম বিফল।
বুধবার হলে শস্যহানির ভয়, খাদ্য মেলে কম, হয় অভাব জয়।
সোমবার, বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার হলে,
পৃথিবী আর সহে না শস্যের ভার—ধান-চালের পাহাড় গড়ে জলে।
আর যদি পাঁচটি শনিবার পড়ে মীন রাশির ভেতর,
তবে শকুনি পর্যন্ত মাংস না খায়—সব হয়ে পড়ে ঘুণে ভর।
শনির অবস্থাভেদে চৈত্র মাসের ফল-মধুমাসের ত্রয়োদশ দিনে যদি রয় শনি। খনা বলে সে বৎসর হবে শস্যহানি ॥
ধর্মার্থে উপবাসের দিন শয়ন উত্থান পাশমোড়া। তার
মধ্যে ভীম ছোঁড়া। দুই ছেলের জন্মতিথি। অষ্টমী নবমী দুটি ॥ পাগলার চোদ্দ পাগলীর আট। এই নিয়ে কাল কাট॥ ইহাও যদি না
করতে পারিস। ভগার খাদে ডুবে মরিস।
সময় বিশেষে ভূমিকম্প দ্বারা অমঙ্গল আশঙ্কা-ডার দিয়ে বলে মিহিরে স্ত্রী শুন হে পতির পিতা। ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা। রাজ্য নাশে গোধন নাশে হয় অগাধ বান। হাতে কাঠা গৃহী ফেরে কিনতে না পায় ধান ॥
তিথিভেদে ফাল্গুন মাসের ফল-ফগহুনে রোহিণী যত্নে
চাই। আগামী বৎসর গণিয়া পাই।। সপ্তমী অষ্টমী হয় ধান।
নবমীতে বন্যা দশমীতে নির্মূল পাতান ॥
বন্যা গণনা-পূর্ণ আষাঢ়ে দক্ষিণা বয়। সেই বৎসর বন্যা হয়। আমে ধান। তেঁতুলে বান। বামুন বাদল বান। দক্ষিণা পেলেই যান।
মড়ক গণনা-চৈত্রে কুয়া ভাদ্রে বান। নরের মুণ্ড
গড়াগড়ি যান।
গর্ভস্থ সন্তান পরীক্ষা-যত মাসের গর্ত নাবীর নাম যত অক্ষর। যত জন শুনে পক্ষ দিয়ে এক কর॥ সাতে হরি চন্দ্র নেত্র।
যদি ‘বাণ’ থাকে, আর তাতে পুত্রের পরে কন্যা জন্ম নেয়—
তবে জেনো নিশ্চিত, পূর্বলক্ষণেই ফল ঠিক হয়ে রয়।
বাণের পিঠে আরেক বাণ রাখো,
পেটের সন্তান সংখ্যায় গণো—দুই, তিন, যত হয়, রাখো।
যদি দুই, চারি মিলে হয় ছয়—
তবে জেনো সে কন্যা হয় নিশ্চয়।
আর যদি সংখ্যাটি হয় শূন্য বা সাত,
তবে নারীর গর্ভ থাকে না, হয় গর্ভপাত।
গ্রামের গর্ভিণী যদি থাকে ফলসহ,
তিন দিয়ে ভাগ করো—হর পূতা তাহা সত্য পথ।
এক দিলে হয় সূত (পুত্র), দুই দিলে সূতা (কন্যা),
যদি ভাগে পড়ে শূন্য, তবে গর্ভ মিথ্যা।
যদি এই গণনা ভুল প্রমাণিত হয়,
তবে সে সন্তান মায়ের নয়, অন্য বংশের পরিচয়।
জন্মের মাস নাও, তার সঙ্গে মাসের দিন মিলাও,
দুই দিয়ে গুণ করো—তখন ফল দেখাও।
যদি আট দিয়ে ভাগ করলে পড়ে হরি (শূন্য),
তবে পুত্র হয় নিশ্চিন্তে, পূর্ণ।
বিষম সংখ্যা দিলে নারী, আর সমে পুত্র জন্ম—
এ জ্ঞান রাখো মনে, ফল মেলে নির্দ্বিধায় গর্ব।
বন্যা গণনা, ধান্যাদি গণনা, বৃষ্টি গণনা, কুয়াশা গণনা ও মৎস্যাদি গণনা দিনে জল রাতে তারা। এই দেখবে শুকোর ধারা । পৌষে গরমি বৈশাখে জাড়া। ভরবে গাড়া প্রথম আষাঢ়ে । খনা বলে শুন হে স্বামী। শ্রাবণ ভাদর নেইকো পানি!! পূর্বেতে উঠিল কাঁড়। ডাঙা ডোবা একাকার। চাঁদের সভার মধ্যে তারা। বরষে পানি, মুষল ধারা । চৈত্রেতে থর থর। বৈশাখে ঝর পাথর ॥ জ্যৈষ্ঠেতে তারা ফুটে। তবে জানবে বর্ষা ঘটে। কি কর শ্বশুর লেখা জোখা। মেঘেই বুঝবে জলের লেখা ॥ কোদালে কুড়ালে মেঘের গা। মধ্যে মধ্যে দিচ্ছে বা। বল গে চাষায় রাঁধতে আল। আজ না হয় জল হবে কাল।। দুর সভা নিকট জল। নিকট সভা রসাতল ॥ পশ্চিমে ধনু নিত্য খরা। পূবের ধনু বরষে কড়া ॥ ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন। শীঘ্র বৃষ্টি হবে।
জেনো। বৎসরের প্রথম ঈশানে বয়। সে বৎসর বর্ষা হবে খনায় কয়। পৌষের কুয়া বৈশাখের ফল। যতদিন কুয়া ত'দিন জল ॥ শনির সাত মঙ্গলের তিন। আর সব দিন দিন ॥ ভাদুরে মেঘ বিপরীত বায়। সে দিন ঝড় বৃষ্টি হয়। কর্কট ছরকট সিংহু শুকা কন্যা কানে কান। বিনা ব্যয়ে তুলা বর্ষে কোথা রাখবি ধান । যদি বর্ষে আঘনে ॥ রাজা যান মাগনে । যদি বর্ষে পৌষে। কড়ি হয় তুষে। যদি বর্ষে মাঘের শেষ। ধন্য রাজা পুণ্য দেশ । যদি বর্ষে ফাল্গুনে। চিনা কাউন' দ্বিগুণে। জ্যৈষ্ঠে শুকো আষাঢ়ে ধারা। শস্যের ভার না সহে ধরা। মাঘ মাসে বর্ষে দেবা। রাজা ছেড়ে প্রজায় সেবা। জ্যৈষ্ঠে মারে আষাঢ়ে ভরে। কাটিয়া মাড়িয়া ঘর করে। যদি বর্ষে মকরে। ধান হবে টেকরে। যদি হয় চৈত্রে বৃষ্টি। তবে হবে ধানের সৃষ্টি । কাতির পূর্ণিমা কর আশা। খনা ডেকে বলে শোনের চাষা । নির্মল মেঘে যদি বাত বয়। রবি খন্দের ভার ধরণী না সয় ॥ মেঘ করে রাত্রে আর হয় জল। তবে জেনো মাঠে যাওয়াই বিফল ॥ আষাঢ়ে নবমী শুকল পাখা। কি করো শ্বশুর লোখাজোখা। যদি বর্ষে মুষলধারে। মধ্য সমুদ্রে বগা চরে । যদি বর্ষে ছিটে ফোঁটা। পর্বতে হয় মীনের ঘটা। যদি বর্ষে ঝিমি ঝিমি। শস্যের ভার না সয় মেদিনী। হেসে চাকি বসে পাটে। শস্য সেবার না হয় মোটে।