বাংলাদেশের হিন্দুদের তীর্থস্থান পরিচিতি
এই তীর্থস্থানগুলোতে ভক্তরা শুধু পূজা-অর্চনা করতে আসেন না; তারা খুঁজে পান মানসিক শান্তি, আত্মশুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক শক্তির স্পর্শ। প্রতিটি স্থানই নিজস্ব কিংবদন্তি, ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি ও বিশেষ ধর্মীয় তাৎপর্য ধারণ করে—যা যুগ যুগ ধরে ভক্তদের আকর্ষণ করে আসছে।
![]() |
| হিন্দুদের তীর্থ স্থান |
বাংলাদেশের প্রতিটি তীর্থস্থানই এক একটি জীবন্ত ইতিহাস—যেখানে মেলে দেব-দেবীর অলৌকিক কাহিনি, সাধুদের তপস্যার বর্ণনা এবং আঞ্চলিক হিন্দু সংস্কৃতির সমৃদ্ধ প্রকাশ। এই নিবন্ধে আমরা সেই সব তীর্থস্থানের পরিচিতি, তাদের গুরুত্ব, ইতিহাস, দর্শনীয় দিক এবং ভ্রমণ নির্দেশিকা তুলে ধরব, যাতে যে কেউ সহজেই নিজের তীর্থযাত্রা পরিকল্পনা করতে পারেন।
বাংলাদেশের হিন্দু তীর্থস্থান: ইতিহাস, গুরুত্ব ও পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি
বাংলাদেশের প্রধান হিন্দু তীর্থস্থানসমূহ
১। ঢাকা: লাংগলবন্দ মেলা
ব্রহ্মপুত্র সঙ্গমে চৈত্রমাসের অশোকাষ্টমীতে স্নান উপলক্ষে বিরাট মেলা হয়। নানা স্থান হতে লোক এসে স্নান করে পুণ্য অর্জন করেন।
২। ধামরাইয়ের রথ
রাজা যশোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রথের মেলায় বহুসহস্র জন সমাবেশ হয়।
শ্রীনগরের রথও প্রসিদ্ধ।
৩। বারদী শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম
শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম।
ইতিহাস ও গুরুত্ব
লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন এক মহান তপস্বী ও ভক্তবৎসল সাধক। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ অঞ্চলে তাঁর আশ্রমটি এখন কোটি ভক্তের তীর্থস্থান।
দর্শন ব্যবস্থা
প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত ধূপ-দীপ নিবেদন করেন। ১লা ভাদ্র (লোকনাথবাবার তিরোধান দিবস) বিশেষ উৎসব হয়।
৪। দেওভোগ আশ্রম
সাধু দূর্গাচরণ নাগ মহাশয়ের আশ্রম।
৫। ঢাকেশ্বরী মন্দির
ঢাকেশ্বরী মন্দির, রাজা রাজবল্লভের প্রতিষ্ঠিত। মালী বাজারের আখড়া বারভূঁইয়াদের স্থাপিত বুড়াশিবের মন্দির, সর্বাপেক্ষা প্রাচীন দেহস্থলী, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণজীর মন্দির, শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দের মন্দির, ঠাঁটারি বাজারের জয়কালীবাড়ী, চিনিসপুর কালিবাড়ী ইত্যাদিও সুপ্রাচীন।
৬। চট্টগ্রাম নলয়ার কালী
স্বয়ং উৎপন্না মা আপনাকে অনাবৃত করিয়া শক্তিরূপে পাষাণময়ী প্রতিমা দন্ডায়মানা। ১৩৭৩ সনের ২৬শে ফাল্গুন এ জাগ্রত পাষীণময়ী মূর্তি মাটি ভেদ করে উত্থিতা হন। দেবী আবির্ভূতা হবার সময় মূর্তির গায়ে যে চাপ চাপ মাটি ছিল এবং দৈবীর নিম্নাংশে বট-অশ্বথের যে শিকর জড়ানো ছিল সে মাটি ও শিকড় লোকেরা দৈব ঔষধ রূপে ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছে। নলুয়া গ্রামটি চট্টগ্রাম জিলান্তর্গত সাতকানিয়া থানায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম স্টেশন হইতে দোহাজারী লাইনে যাইতে হয়। মাত্র ২৯ মাইল দোহাজারী পুলটি পিছনে রেখে নৌকাযোগে মাত্র দেড় ঘন্টা পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলেই কালী বাড়ীর ঘাট।
৭। চন্দ্রনাথ ধামই চট্টগ্রাম জেলায় (হস্তাদ্ধ)
চট্টগ্রাম জেলায় (হস্তাদ্ধ) চন্দ্রনাশ পর্বতমালায় অবস্থিত। চন্দ্রনাথ ধামই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ তীর্থ। স্বয়ং মহাদেব বলেছেন, "কলিযুগে চন্দ্রশেখর পর্বতে আমি নিয়ত বাস করি।" ইহা মহাপীঠ। পীঠাধিষ্ঠাত্রী দেবী ভবানী ও ভৈরব চন্দ্রশেখর। সীতাদেবীর মন্দির, শম্ভুনাথ, বিরুপাক্ষশিব, ব্যাসকুন্ড, বাড়বকুন্ড প্রভৃতি বহু দেবস্থলীর সমাবেশ এ তীর্থ রয়েছে। এখানে শঙ্খর মঠ ও শ্রীশ্রী ১০৮ শ্রীমৎস্বামী ভোলানন্দ গিয়ি মহারাজের আশ্রম আছে। শিবরাত্রিকালে পক্ষকাল ব্যাপী মেলাতে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়।
৮। কক্সবাজার সমুদ্র পৃষ্ঠে গোরক্ষনাথের সাধন ভূমি
মৈনাক পর্বতে আদিনাথ শিব অবস্থিত। গোরক্ষনাথের সাধন ভূমি।
৯। কৈবল্য ধাম (শ্রীশ্রীরাম ঠাকুরের আশ্রম)
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর সন্নিকটে অবস্থিত। শ্রীশ্রীরাম ঠাকুরের আশ্রম অবস্থিত।
১০। চট্টলেশ্বরী বাসুদেব বিগ্রহ
চট্টলেশ্বরী কালিবাড়ী প্রসিদ্ধ। বোয়ালখালী থানার অন্তর্গত গোপাদিয়া গ্রামের পাষাণমূর্তি কালাচাঁদঠাকুর নামক বাসুদেব বিগ্রহ। প্রায় দুশত বৎসর পূর্ব হইতে প্রতিষ্ঠিত। দেশ-বিদেশ হইতে পুত্র-কন্যাদের অন্নপ্রাশন করাবার উদ্দেশ্যে বহু লোকের সমাগম হয়। কেহ কেহ অভিষ্টসিদ্ধির মানসে বাসুদেবের মন্দিরে ধারণা দিয়ে নিজ নিজ মনবাসনা পূর্ণ করে যান। এ উপলক্ষে তথায় বিরাট মেলা হয়।
১১। শ্রীশ্রী রাম ঠাকুরের সমাধি স্থান নোয়াখালী
নোয়াখালী চৌমুহনীতে শ্রীশ্রী রাম ঠাকুরের সমাধি স্থান। অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে তাঁহার তিরোভাব উৎসব উপলক্ষে প্রায় অর্ধলক্ষ নর-নারীর সমাবেশ হয়।
১২। কুমিল্লায় জগন্নাথের রথযাত্রা
কুমিল্লা শহরে জগন্নাথের রথযাত্রায় বহু জনসমাগম হয়।
১৩। মেয়ে মেহের কালীবাড়ী
মহাপুরুষ সর্বানন্দ ও পূর্ণানন্দ এখানে সিদ্ধিলাভ করেন। দীপান্বিতা ও পৌষ সংক্রান্তিতে এখানে পক্ষ কালাধিক পূজা ও বিরাট মেলা হয়।
১৪। মেড্ডার কালভৈরবু
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্নিকটে মেড্ডার বিরাটকায় কালভৈরব। দর্শনীয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আনন্দময়ী কালীবাড়ীতে নববর্ষে সপ্তাহকালব্যাপী ভূবন-মঙ্গল উৎসবে প্রায়। অর্ধলক্ষ নর-নারীর সমাগম হয়। এখানে সাধক নকুল ঠাকুরের আশ্রম অবস্থিত।
১৫। ফরিদপুর শ্রীঅঙ্গণ
শ্রীশ্রী জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রমে ৪০ বৎসর যাবৎ অহোরাত্র অবিরাম নাম সংকীর্ত্তণ চলিতেছে।
১৬। খাটরা
বাসুদেব বাড়ী মহাপ্রভু চৈতন্যদেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।
১৭। বাজিতপুর শ্রীশ্রীপ্রণবানন্দ আশ্রম
শ্রীশ্রীপ্রণবানন্দ প্রতিষ্ঠিত আশ্রম অবস্থিত।
১৮। শ্রীধাম ওড়াকান্দি
পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রীহরি ঠাকুরের লীলা নিকেতন ও ভগবান শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থান ও লীলা নিকেতন। ইহা মতুয়া সম্প্রদায়ের মহাতীর্থ ক্ষেত্র ও পীঠস্থান। বরিশাল-পূর্বোল্লোখিতমাতৃতীর্থ পরিক্রমার 'ক্রমিক নম্বর ৩' দেখুন।
১৯। খুলনা: যশোরেশ্বরীর মন্দির
মহারাজ প্রতাপাদিত্য এ প্রতিষ্ঠা করেন।
২০। যশোহর পানিপদ্ম
(দেবী যশোরেশ্বরী বৈরবচন্ড)
২১। যশোর লক্ষ্মীপাশার কালী মন্দির
লোহাগড়ায় লক্ষ্মীপাশার কালী মন্দির প্রসিদ্ধ ও জাগ্রত। প্রত্যহ জাঁকজমকের সহিত মায়ের পূজা ও বহু সংখ্যক ছাগ বলিদান হয়। এখানে পূণ্যসঞ্চয়ার্থে বহু দূরদেশ হইতে লোকের সমাগম হয়।
২২। বেনাপোল: শ্রীশ্রী হরিদাস ঠাকুরের সাধনভূমি।
২৩। চাঁচড়া: দশ মহাবিদ্যার মন্দির অবস্থিত।
২৪। কামাখ্যাদেবীর মন্দির
ময়মনসিংহ: কিশোরগঞ্জের হরবৎ নগরের আখড়া বৃহত্তম বৈষ্ণব আখড়া। ২৫। ময়মনসিংহ: জেলার ঘোষ গাওয়ের কামাখ্যাদেবীর মন্দির প্রসিদ্ধ।
২৬। শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুরের জন্মভূমি
রাজশাহী: খেতুর পদ্মাতীরে শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুরের জন্মভূমি।
২৭। রাজা রামকৃষ্ণের সাধন পীঠ
নাটোর: রাজা রামকৃষ্ণের সাধন পীঠ।
২৮। শঙ্খচক্রগদাপদ্মাধারী শ্রীশ্রীবিষ্ণুর মন্দির
রংপুর: নীলফামারী নবগয়া ধাম। শঙ্খচক্রগদাপদ্মাধারী শ্রীশ্রীবিষ্ণুর মন্দির।
২৯। পাবনা: হিমাইতপুরধাম শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের পণ্য জন্মভূমি ও লীলাভূমি, অবস্থিত। সৈয়দপুর-রংপুর, সি এন্ড বি রোডের উত্তর দিকে তারাগঞ্জ হাট হইতে ১ মাইল উত্তরে নবগয়াধীম। মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে নবগয়াধামে সহস্র নরনারী আগমন করে উত্তর বাহিনী পূণ্যতোয়া ফন্ডুরূপ যমুনেশ্বরী নদীতে স্নান, তর্পন অস্থিক্ষেপণ, অক্ষয় বটে কোল, শঙ্খ-চক্র, গদা-পদ্মাধারী শ্রীবিষ্ণু মন্দির প্রদক্ষিণ ও মৃত পিতৃমাতৃগণের আত্মার সদপতির জন্য শ্রীশ্রীবিষ্ণুর পাদপদ্মো পিন্ডদান করে উদ্দেশ্য সাফল্যমন্ডিত করে থাকেন।
৩০। বগুড়া সারস্বত আশ্রম
বগুড়া: করতোয়া সঙ্গমে ভবানী উত্তরায়ন সংক্রান্তিতে মকর স্নানে সহস্র সহস্র জনসমাবেশ হয়। শ্রীশ্রী নিগমানন্দ পরমহংস প্রতিষ্ঠিত সারস্বত আশ্রম আছে।
৩১। বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের বাসর ঘর
মহাস্থানের: পশ্চিমে দুই মাইল দূরে চাঁদ সদাগরের স্নান, দোল মন্ডপ, চাঁদের স্থাপিত হাট ও হিন্দু পল্লী চাঁদমুহা আজিও বর্তমান। তথা হইতে ১ মাইল পূর্বে বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের বাসর ঘর ও দক্ষিণে ধন্বন্তরী স্বিন্তরী ওঝার ওঝার বাড়ী ও লাট আজিও পাতিত অবস্থায় বিরাজমান।
৩২। শ্রীমৎ মহাপ্রভুর পিতনিবাস
শ্রীহট্ট ঢাকা দক্ষিণ: শ্রীমৎ মহাপ্রভুর পিতনিবাস। মহাপ্রভুর প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। আছে। চৈত্র মাসের প্রতি রবিবারে, রথযাত্রায় মেলা এবং প্রতি বৎসর আবির্ভাব উৎসব অনুষ্ঠিত হইতেছে।
৩৩। পনাতীর্থ
পনাতীর্থ: শ্রীমৎ অদ্বৈত প্রভুর জন্মস্থান। চৈত্রমাসে বারুণীস্নানে বহু জনসমাবেশ হয়। ইহ লাউড় পাহারে অবস্থিত।
৩৪। নিন্মাই শিব
নিন্মাই শিব: শ্রীমঙ্গল ও মৌলভী বাজারের সন্নিকটবর্তী। বারুণী ও অষ্টমী এবং শিবরাত্রিতে মেলা হয়।
৩৫। গোটাটিকির জৈনপুর ভৈরব ও পীঠস্থান
শ্রীহট্টো: (গ্রীবা, দেবী মহালক্ষ্মী, ভৈরব শম্বরানন্দ) গোটাটিকির জৈনপুর ভৈরব ও পীঠস্থান অবস্থিত। শিবরাত্রি ও অশোকাষ্টমীতে মেলার অনুষ্ঠান হইয়া থাকে।
৩৬। সাধক রামকৃষ্ণ গোঁসাইর সহস্রতম আখড়া
বিথঙ্গল: সাধক রামকৃষ্ণ গোঁসাইর সহস্রতম আখড়া। আদি আখড়া হবিগঞ্জ, মাছুলিয়া গ্রামে।
৩৭। শ্রীশ্রীসন্তদাস বাবাজী ও শ্রীশ্রী দয়ানন্দের জন্মস্থান
বামৈঃ শ্রীশ্রীসন্তদাস বাবাজী ও শ্রীশ্রী দয়ানন্দের জন্মস্থান। দয়ানন্দ প্রতিষ্ঠিত মন্দির অবস্থিত।
৩৮। ঠাকুর বাণীনাথের পীঠস্থান
শতক: সিদ্ধ মহাপুরুষ ঠাকুর বাণীনাথের পীঠস্থান। সিদ্ধ তেঁতুল তলায় মাঘ মাসে। মেলা হয়।
৩৯। মদন মোহনের আখড়ায় ঝুলনযাত্রা
বালাগঞ্জ: মদন মোহনের আখড়ায় ঝুলনযাত্রা অতি প্রসিদ্ধ।
৪০। পঞ্চখন্ড
বাসুদেব বাড়িতে উল্টারথে মেলা। রঘুনাথ শিরোমণি ও শ্রীবাস পন্ডিতের জন্মস্থান। বাসুদেব বাড়িতে অগ্রহায়ণের শুক্লা একাদশীতে গীতাজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
৪১। শ্রীহট্ট
শহরে যুগলটিলার আখড়া, দুর্গাবাড়ী প্রভৃতি বহু প্রাণীর দেবস্থলী আছে। নিম্বার্ক
আশ্রমে-জ্যৈষ্ঠমাসের ভগীরথ দশহরায় শ্রীসন্তদাস কাঠিয়া বাবার জন্মোৎসব হয়। শ্রীহট্টে সাধক মদন মোহন রায়ের (পাগলবাবা) একটি আশ্রম আছে। ইহা ভাগবৎধর্ম প্রচারের কর্মস্থল।
বাংলাদেশের তীর্থস্থানগুলোর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশের হিন্দু তীর্থস্থানগুলো শুধু ধর্মীয় উপাসনার স্থান নয়—এগুলো দেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যুগযুগ ধরে এসব তীর্থস্থানে জমে ওঠা উৎসব, লোকগাথা, মন্দিরস্থাপত্য, আচার-অনুষ্ঠান ও সাধু-ঋষিদের কাহিনিগুলো একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি করেছে, যা বাঙালি পরিচয়ের সাথে গভীরভাবে জড়িত।
প্রতিটি তীর্থস্থানই একটি আঞ্চলিক সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। এখানে স্থানীয় মানুষের জীবনধারা, ভাষা, সঙ্গীত, রীতিনীতি ও খাদ্যসংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। রথযাত্রা, শিবচতুর্দশী, দুর্গাপূজা, দূর্গোৎসব, রাস পূর্ণিমা কিংবা অন্নপূর্ণা পূজার মতো ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে তীর্থস্থানগুলো একেক সময় পরিণত হয় মিলনমেলায়—যেখানে ধর্ম ছাপিয়ে সৃষ্টি হয় সামাজিক ঐক্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ।
তীর্থস্থানগুলো দেশের ঐতিহাসিক স্থাপত্য-ঐতিহ্য সংরক্ষণেরও গুরুত্বপূর্ণ ভরকেন্দ্র। দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের টেরাকোটা শিল্প, মহাস্থানগড়ের প্রত্ননিদর্শন, সিলেটের প্রাচীন শৈব ও বৈষ্ণব কেন্দ্র—এসব স্থান বাংলার প্রাচীন শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ধর্মীয় ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। ফলে তীর্থস্থানগুলো শুধু ভক্তদের জন্য নয়, গবেষক, পর্যটক ও ইতিহাস-অনুরাগীদের জন্যও সমান আকর্ষণীয়।
উপসংহার:বাংলাদেশের হিন্দু তীর্থস্থানগুলো ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, লোকসংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিকতার এক বিশাল ভাণ্ডার। প্রতিটি স্থানই ভক্তদের অন্তরে জাগায় ঈশ্বরভক্তি, শান্তি ও মানবিকতার বার্তা। তাই তীর্থযাত্রা শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়—এটি এক গভীর সাংস্কৃতিক যাত্রা, যা বাঙালি হিন্দু সমাজের অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
