সন্তোষী মাতার ব্রতকথা – পূজা পদ্ধতি, নিয়ম ও কাহিনি

সন্তোষী মাতা হলেন সন্তুষ্টি, শান্তি ও কল্যাণের দেবী। ভক্তদের মনোবাসনা পূরণে তাঁর ব্রত অত্যন্ত জনপ্রিয়। সরল নিয়ম, সহজ উপবাস এবং দ্রুত ফলপ্রদ হওয়ায় বাংলাসহ ভারতজুড়ে এই ব্রত পালিত হয়।
শ্রীশ্রী সন্তোষী মাতার ব্রতকথা
শ্রীশ্রী সন্তোষী মাতা


শ্রীশ্রী ব্রত পালনের নিয়ম

প্রতি শুক্রবার উপবাস করে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে, ধুপ-দীপ জ্বালিয়ে সন্তোষী মাতার ব্রত পাঠ করতে হবে। অপর কোন তিথি বা নক্ষত্রজনিত নিষেধ নাই।


সন্তোষী মাতার ব্রতের উপকরণ

 ধান, দুর্বা, ফুল, ছোলা, গুড় বা বাতাসা। ধূপ, প্রদীপ, ফুল, নারকেল, গুড়, চাল, মিষ্টি, কলসী, পানি এবং মা সন্তোষীর ছবি বা মূর্তি — এগুলোই প্রধান সামগ্রী।

শ্রীশ্রী সন্তোষী মাতার ব্রতের ফল

 ভক্তিভরে যে নারী এই ব্রত উদযাপন করবে তার সব কামনা সিদ্ধ হবে। গৃহে অর্থাভাব থাকবে না।

শ্রীশ্রী সন্তোষী মাতার ব্রতকথা

এক দেশে এক বৃদ্ধা রমণী বাস করত। বৃদ্ধার ছিল সাতপুত্র। বৃদ্ধার সাত পুত্রের ছয়। পুত্র বড় হয়ে অর্থোপার্জনে সক্ষম হল। কিন্তু সপ্তম পুত্রটি ছিল বেকার। বৃদ্ধা প্রতিদিন ভাল ভাল রান্না করে সকলকে খাওয়াইত। আর যে সকল খাদ্য অবশিষ্ট বা উচ্ছিষ্ট থাকত অর্থাৎ নিকষ্ট খাদ্যই সপ্তম পুত্রকে খেতে দিত। সপ্তম পুত্র অর্থাৎ, বৃদ্ধার কনিষ্ঠ পুত্র কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু জানত না। বৃদ্ধার কনিষ্ঠ পুত্র অর্থাৎ সপ্তম পুত্রের নাম রামু। রামু ভাবত যে, তার মা তাকে খুবই ভালবাসেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য ছেলেদের চাপে পড়ে এবং রামু আয় করত না বলে বৃদ্ধা মাও তাকে দু'চোখে দেখতে পারত না। যার টাকা পয়সা নেই বা এ সংসারে যে টাকা পয়সা উপার্জন করতে পারে না। তার কোন আদর থাকে না। অতএব ঐ পরিবারে রাম আর রামুর স্ত্রী অর্থাৎ ছোট বউয়ের কোন আদর ছিল না। রামতু কিন্তু এই ব্যাপারে কিছুই জানত না। সে হল প্রাণখোলা অকপট মানুষ। একদিন সে তার স্ত্রীকে বলল-জানো সাবিত্রী, মা এভং দাদারা আমাকে খুবই ভালোবাসেন। সবিত্রী সেদিন আর তার মনের দুঃখ চেপে রাখতে পারল না। সে স্বামীকে বলল- তোমার মা তোমাকে তোমাদের দাদাদের উচ্ছিষ্ট খেতে দেয়।
আমি ছয় বউয়ের পাতের উচ্ছিষ্টই খাই। স্ত্রীর কথা প্রথমে রামু বিশ্বাস করল না। পরদিন সে নিজেই দেখল- ভাল ভাল রান্না আর পিঠে। পায়েস সব দাদাদের খেতে দেওয়া হচ্ছে। আর দাদাদের পাতের উচ্ছিষ্ট রামুর জন্যে তুলে রাখা হচ্ছে। দাদাদের খাওয়া শেষে যখন মা রামুকে ডাকল, রামু অসুখের ভান করে শুয়ে রইল। শুয়ে শুয়ে সে দেখল- তার স্ত্রী সাবিত্রীকেও অন্যান্য বউদের পাতের উচ্ছিষ্ট খেতে দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া বউদিরা সবাই আরাম-আয়াসে থাকে। আর সাবিত্রীকেই বাসন পত্র মাজিতে হয়। রামুর মনে। খুব দুঃখ হল। সে ঠিক করল পরদিনই কাজের চেষ্টায় বেরিয়ে পড়বে। যদি দুর দেশেও যেতে হয়-তবুও সে পেছপা হবে না। পরদিন রামু তার মাকে প্রণাম করে বলল- মা দুরদেশে কাজের চেষ্টায় যাচ্ছি। মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে রামু তার স্ত্রী সাবিত্রীর কাছে। কাছে এল। সাবিত্রীর দু' চোখে অশ্রুর বন্যা নেমে এল। এতদিন তার স্বামী। বেকার হলেও কাছাকাছি ছিল-এখন দুরদেশে চলে যাচ্ছি। কাজ পাবে কি পাবে না, তার ঠিক নেই। কতদূর যেতে হবে তাই বা কে জানে? আর এতদিন সাবিত্রী স্বামী ছাড়া হয়ে কিভাবেই বা থাকবে? আর স্বামীর অর্বতমানে- না জানি সাবিত্রীকে কত দুঃখ-কষ্টেই দিন কাটাতে হবে। কিন্তু উপায় নেই, তাছাড়া রামু দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অতএব মনের দুঃখে স্বামীকে বিদায় জানাতে হল। বাড়ি হতে বহির হইয়া রামু এদিক ওদিক ঘুরিতে লাগল। কিন্তু কোথাও কোন কাজ পেল না। তবুও তার দৃঢ় পণ। নানা দেশ ঘুরিয়া অবশেষে দূরদেশে এক শেঠজীর দোকানে সে কাজ পেল। দোকানে আরও অনেক কর্মচারী ছিল, শেঠজী রামুর সততা দেখে- রামুকেই সব চেয়ে বেশি পছন্দ করতে লগলেন, ক্রমে ক্রমে রামু শেঠজীর ডানহাত হয়ে উঠিল। তারপর শেঠজীর অংশীদার হল। পরে সে নিজে বিরাট ব্যবসার মালিক হল।

এদিকে সাবিত্রীর কষ্টের শেষ নেই। ঘরের কাজ করতে তো হয়ই, তাছাড়া জঙ্গল থেকে রোজ কাঠ কুড়িয়ে-কাঠের পাজা মাথায় করে আনতে হয়। এমন সুন্দরী সাবিত্রীও অতিরিক্ত হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রমে, কাহিল হয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু কাহিল হলেই বা শুনছে কে? এদিকে স্বামীর কোন খবর। নেই কোথায় আছে কিভাবে, কে জানে? একদিন দুরের বনে কাঠ কুড়োতে গিয়ে সাবিত্রী এক বিরাট। এ মন্দির দেখতে পেল। কৌতূহলবশে সাবিত্রী মন্দিরে প্রবেশ করে পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করল ইনি কোন এ দেবী? এই দেবীর আরাধনা করলে কি শুভ হয়?

পুরোহিত এবং অপরাপর ভক্তগণ বললেন- সন্তোষী মাতার মন্দির। প্রতি শুক্রবারে সন্তোষী মাতার পূজো হয়। সন্তোষী মাতার ব্রতপাঠে অপুত্রকে পুত্র হয়। সাবিত্রী তখন জিজ্ঞাসা করল- আমি সন্তোষী মাতার ব্রত পালন করব, আমার কি করতে হবে?

সাবিত্রীর কথা শুনে পুরোহিত বললেন, আজ তো শুক্রবার। তুমি যদি এখনও উপবাস থাক, তবে এ ব্রত আজ থেকেই পালন করতে পার। কেবলমাত্র ছোলা আর কিছু গুড় নিয়ে দেবীর ব্রতকথা শোন। তাছাড়া প্রতি শুক্রবারে এ ব্রত পালন করবে। একবেলা উপবাস, ব্রত ভঙ্গে নিরামিষ আহার। সম্ভব হলে প্রতি। শুক্রবারে সন্তোষী মায়ের ভোগ দেবে। বালক ভোজন ও ব্রাহ্মণ ভোজন করাবে। পান, সুপারি, বাতাসা, ছোলা আর গুড়ই যথেষ্ট। কিন্তু ব্রত পালনের দিন কখনই টক খাবে না বা কাউকে খাওয়াইবে না। সাবিত্রী সেদিন থেকে ব্রত পালন করল, কেঁদে কেঁদে সন্তোষী মাকে তার দুঃখের কথা নিবেদন করল। সন্তোষী মা সেই দুর দেশে রামুকে স্বপ্নে দর্শনে বললেনঃ তুমি কি তোমার স্ত্রী সাবিত্রীর কথা একেবারে ভুলে গেছ? রামু মার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললঃ না, মা ভুলিনি।

সেদিনের পর থেকে রামু প্রতি মাসেই সাবিত্রীর নামে মানি অর্ডারে টাকা পাঠাতে লাগল। কিন্তু সতী স্ত্রী টাকায় সন্তুষ্ট হবে কেন স্বামীর সঙ্গই যদি না পেল। সাবিত্রী আবার সন্তোষী মাতার কাছে কাতর আবেদন জানাল। সন্তোষী মাতার কপা হল।

রামু প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। সাবিত্রীর যখন কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরল, রামু তাকে প্রথমে চিনতেই পারেনি। এ কী কঙ্কালসার দেহ হয়েছে সাবিত্রীর, কোথায় সেই কনকচাঁপা রং। রামু সাবিত্রীর জন্য নতুন শাড়ী আর অলঙ্কার এনেছিল। সাবিত্রী তা পরল। রামু নতুন বাড়ি করে। সাবিত্রীকে নিয়ে গেল সেই বাড়িতে। প্রচুর ধনসম্পদ রামুর। সাবিত্রীরও স্বামী সুখে সুখী। কিন্তু রামুর বাউদির সাবিত্রীর এই সুখে হিংসায় জ্বলতে লাগল। তারা ভাবল, যে করেই হোক সাবিত্রীকে সন্তোষী মার বিষ নজরে ফেলতে হবে।

তারা তাদের ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে দিত, আজ শুক্রবার, তোদের ছোট কাকীমা ব্রত পালন করবে মিঠার মা খেতে ভুলবি না। তার কাছে টক খেতে চাইবি। অতএব তাদের ছেলেমেয়েদের সাবিত্রীর কাছে টক খেতে চাইল। কিন্তু সাবিত্রী বলল আজ তো

টক খেতে নেই। কিন্তু বাচ্চারা আবদার করল। অতএব সাবিত্রীকে পয়সা দিতে হল। সেই পয়সা দিয়ে বাচ্চারা টক কিনে খেল। ফলে সাবিত্রী সন্তোষী মায়ের বিষ নজরে পড়ল। রাজার লোকেরা এসে রামুকে ধরে নিয়ে গেল এবং তার ধন-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করল। তারপর রামুর সন্তোষী মায়ের কাছে কাতর ভাবে। আবেদন জানিয়ে বলল, মা এমন ভুল আর কখনও করব না। আমায় ক্ষমা কর। ভক্তের কান্নায় সন্তোষী মায়ের আসন টলিল। তিনি রাজাকে স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন, ধন-সম্পদ সহ রামুকে মুক্তি দিতে, নইলে রাজার ঘোর অকল্যাণ ঘটবে।

স্বপ্নে সন্তোষী মাতার নির্দেশ পেয়ে রাজ। ভীষণ ভয় পেয়ে গেল, পরদিন প্রভৃত ধন-সম্পদসহ রামুকে মুক্তি দিল। অতএব সাবিত্রী সংসারে আবার সুখ ফিরে এল। সন্তোষী মায়ের কৃপায় তার পুত্রসন্তানও হল। ধনে-জনে গৃহপূর্ণ হল। কোন দুঃখ রইল না। একদিন সন্তোষী মাতা ভয়ঙ্কর মুক্ষিকারূপে সাবিত্রীর ঘরে আসিল, তারপর নিজ মুর্তি ধারণ করিয়া বললেন তোমার মতো ভক্তি ও নিষ্ঠা নিয়ে যে আমায় ব্রত পালন করবে আমি তার গহে চিরকাল বিরাজ করব।'


সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (Normal Form FAQ)

১. সন্তোষী মাতার ব্রত কবে পালন করা হয়?

সন্তোষী মাতার ব্রত প্রতি শুক্রবার পালন করা হয়। সকালে স্নান-শুচিতা রেখে উপবাস ও পূজা করা হয়।

২. সন্তোষী মাতার ব্রতে টক কেন নিষিদ্ধ?

ব্রতকথা অনুযায়ী, টকযুক্ত খাবার খেলে বা ব্যবহার করলে মা সন্তুষ্ট হন না। এতে ব্রতের ফল নষ্ট হতে পারে বলে বিশ্বাস।

৩. সন্তোষী মাতার ব্রত কতদিন পালন করতে হয়?

ভক্তদের সুবিধা অনুযায়ী ৭, ১১, ২১ বা ৪৮ শুক্রবার এই ব্রত পালন করা যায়।

৪. ব্রতে কী কী জিনিস ব্যবহার করা হয়?

ধূপ, প্রদীপ, ফুল, নারকেল, গুড়, চাল, মিষ্টি, কলসী, পানি এবং মা সন্তোষীর ছবি বা মূর্তি — এগুলোই প্রধান সামগ্রী।

৫. সন্তোষী মাতার ব্রত কি যে কেউ পালন করতে পারে?

হ্যাঁ, যে কেউ ভক্তিভরে পালন করতে পারে। বয়স, লিঙ্গ বা ধর্মীয় যোগ্যতা নিয়ে কোনো বাধা নেই।


সন্তোষী মাতার ব্রতের মূল উদ্দেশ্য

পরিবারে শান্তি

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক উন্নতি, পরিবারের অশান্তি দূরীকরণে এই ব্রত বিশেষ কার্যকর বলে মানা হয়।

অর্থনৈতিক উন্নতি

ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থিতি, দারিদ্র্য নাশ ও কর্মফল সুপ্রবাহিত হয়।

মনোবাসনা পূরণ

কোনো বিশেষ মানত পূরণের জন্যও ভক্তরা এই ব্রত গ্রহণ করেন।

সন্তোষী মাতার ব্রতের সারমর্ম

সন্তোষী মাতার ব্রতকথা ও পূজাপদ্ধতি হিন্দু ধর্মাবলম্বী, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে, এক অত্যন্ত জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় আচার। এই ব্রতটি মূলত পরিবারে শান্তি, সন্তানের মঙ্গল, অভাব দূরীকরণ এবং মনোবাঞ্ছা পূরণের কামনায় পালন করা হয়। সম্পূর্ণ ব্রতকথাটি একটি সরস ও শিক্ষণীয় আখ্যান যা ভক্তির মাধ্যমে দেবীর কৃপা লাভের মহিমা বর্ণনা করে। কাহিনিটির কেন্দ্রে থাকে এক ভক্ত এবং সন্তোষী মাতার কৃপায় তার জীবনে আসা আমূল পরিবর্তন, যা শ্রোতা বা পাঠকদের ধর্মীয় কাজে আবদ্ধ করে।

পূজা পদ্ধতিটি বেশ নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি ও সহজলভ্য উপকরণ দ্বারা সমৃদ্ধ। এটি সাধারণত শুক্রবারে পালন করা হয়, কারণ এই দিনটি সন্তোষী মাতার প্রতি উৎসর্গীকৃত। উপবাস রাখা, হলুদ বস্ত্র পরিধান করা এবং হলুদ রংয়ের নৈবেদ্য (যেমন, বেসনের লাড্ডু, গুড় ও চানা দাল) উৎসর্গ করা এর মূল অঙ্গ। পূজার সময় 'সন্তোষী মাতা কী আর্টি' গেয়ে ব্রতকথা পাঠ বা শোনা হয়, যা ভক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করে।

সার্বিকভাবে, সন্তোষী মাতার ব্রত কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয়, বরং এটি এক সুগভীর আধ্যাত্মিক অনুশীলন যা সহজ সরল নিষ্ঠা, নিয়মশৃঙ্খলা এবং অটল বিশ্বাসের মহত্ত্ব প্রদর্শন করে। এই ব্রত ও এর কাহিনি যুগ যুগ ধরে লোকবিশ্বাসে প্রেরণা ও সান্ত্বনার উৎস হয়ে রয়েছে, যা গৃহস্থালির জীবনে ঐশ্বরিক কৃপা ও শান্তি আনে বলে বিশ্বাস করা হয়।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url