পণ্ডিত শিরোমণি চাণক্যের শ্লোক –নীতি, উপদেশ ও ব্যাখ্যা

চাণক্য কে? 

পাঞ্জাব রাজ্যের অন্তর্গত তক্ষশীলা নামে জনপদে জনৈক দরিদ্র ব্রাহ্মণের গৃহে চাণক্য জন্মগ্রহণ করেন। অনেকে মানে করেন চাণক্য ঋতির ঔরসে সঞ্চাত হওয়ায় সম্ভবান তাহার নাম চাণক্য রাখা হয় তৎকালে মগধের সিংহাসনে মহারাজ নন্দ অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই বংশের রাজত্বকাল সম্ভবতঃ ৩৭৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কায়াকাছি সময়ে। আনুমানিক ৩২২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত নন্দকুমারকে পরাজিত করে মৌখ্যরাজ প্রতিষ্ঠিত করেন। ননদ কর্তৃক অপমানিত ও লাঞ্চিত হয়ে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের সহযোগিতায়। নন্দবংশকে ধ্বংস করেন।চাণক্য অত্যন্ত কুটিল রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন তজ্জন্য লোক সমাজে ইনি কোটিল্য বলে পরিচিত ছিলেন। বিষ্ণুগুপ্ত এবং বিষ্ণুশর্মাও নামে অতি পরিচিত ছিলেন। চাণক্যের রচিত "অর্থশাস্ত্র” অতিশয় প্রসিদ্ধ গ্রন্ধ। তাঁহার প্রণীত নীতি বিষয়ক শ্লোকসমূহ নীতি শিক্ষার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। জনশ্রুতি এই যে চাণক্য মহাপণ্ডিত হইেিলও নাস্তিক ছিলেন। 

চাণক্যের শ্লোক pdf
চাণক্যের শ্লোক

মহাপণ্ডিত চাণক্যের কয়েকটি শ্লোক নিম্নে উদ্ধৃত হইল

চাণক্য, বা কৌটিল্য, শুধু রাজনীতির আচার্য নন—তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও নৈতিক দার্শনিক। তাঁর রচিত ‘চাণক্য নীতি/ শ্লোক মানুষের জীবন, সমাজ, রাজনীতি, শাসন ও ব্যক্তিগত সাফল্যের পথ নির্দেশ করে।

বিদ্বান ও রাজার প্রভেদ

বিদ্বত্বঞ্চ নৃপত্বঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন।

স্বদেশে পূজ্যতে রাজা জ্যতে রাজা বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে।।

বিদ্যাবত্তা ও রাজ্যপদ কখনও সকল স্থানে পূজা পেয়ে থাকেন। সপমর্যাভুক্ত নহে। রাজা নিজে দেশে পূজিত হন, আর বিদ্বান ব্যক্তি

পণ্ডিত ও মূর্খের প্রভেদ

পণ্ডিতে চ গুণাঃ সর্বে মুর্খে দোষা হি কেবলম।

তস্মামুর্খসহস্রেভ্যঃ প্রাজ্ঞ একো বিশিষ্যতে।।

পণ্ডিত ব্যক্তির সকলই গুণ, আর নির্বোধ ব্যক্তির সকলই দোষ। সেই হেতু সহস্র নির্বোধ ব্যক্তি অপক্ষো মাত্র বিদ্বান ব্যক্তি সম্মকান লাভ করে থাকেন।

পণ্ডিতের লক্ষণ

মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেয় লোষ্ট্রবৎ।।

আত্মবিৎ সর্বভূতেষু যঃ পশ্যতি স পণ্ডিতঃ।।

যিনি অপরের স্ত্রীকে মাতার ন্যায়, পরের জিনিষকে মাটির ঢেলায় ন্যায় ও সকল প্রাণীকে নিজের মত দেখেন তিনিই প্রকৃত পণ্ডিত বিবেচিত হন

পুত্রের পতি পিতার কর্তব্য

লালয়েং পঞ্চ বর্ষাণি দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ।

প্রাপ্তে তু ষোড়ষে বর্ষে পুত্রং মিত্রবদাচরেৎ।।

লান পারন করবে, তারপর দশ বৎসর পর্যন্ত (ছয় হতে পনের বছর পর্যন্ত) পাঁচ বছর পর্যন্ত পুত্রকে তাড়না (শাসন) করবে এভং সেই পুত্রের ষোড়শবর্ষ বয়ঃক্রম হইলে তার সহিত বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করবে।

গুণবান ও মুর্খ পুত্রের বৈশিষ্ট্য

বরমেকো গুণী পুত্রো ন চ মুর্খশতৈরপি।

একশ্চন্দ্রস্তমো হস্তি ন চ তারাগণৈরপি।।

একমাত্র গুণমান পুত্র অনেকাংশে ভাল, কিন্তুশত মুর্খপুত্রও ভাল নহে। একমাত্র চন্দ্র অন্ধকার দূর করতে পারে। কিন্তু অসংখ্য নক্ষত্রও সেই অন্ধকার দূর করতে পারে না।

আদর ও শাসনের ফলাফল

লালনে বহবো দোষাস্তড়নে বহবো গুণাঃ।

তস্মা? পুত্রঞ্চ শিষ্যঞ্চ তাড়য়েন্নতু লালয়েৎ।।

পুত্রকে আদর দিলে বহু দোষ জন্মে, কিন্তু তাকে শাসনে রাখলে অনেক গুণ দেখা যায়। সেই হেতু পুত্রকে ও শিষ্যকে শাসন করা উচিৎ আদর দেয়া উচিৎ নয়।

মুর্খের স্বরূপ

দূরতঃ শোভতে মুর্খো লম্বসাটপটাবৃতঃ।

তাব"চ শোভতে মুখো যাবৎ কিঞ্চিন্ন ভাষতে।।

মুর্খ ব্যক্তি সুন্দর বস্ত্র পরিধান কয়ে কোঁচা ঝুলিয়ে দুর হতে শোভা পাস আর মুর্খ ব্যক্তি যতক্ষণ কোন কথা, না বলে ততক্ষনই শোভা পায়।

প্রকৃত বন্ধু

উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্র-বিপ্লবে।

রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠ তি স বান্ধবঃ।।

যে সুসময়ে, বিবদকালে, থাকে সেই প্রকৃত বন্ধু। দুর্ভিক্ষকালে, রাষ্ট্রের বিপ্লবের সময়, বিচারালয়ে এবং শ্মশানে উপস্থিত

বিদ্যা মিত্রং প্রবাসে চ মাতা মিত্রং গৃহেষু চ।

বিভিন্ন অবস্থায় মিত্র

ব্যধিতস্যৌষধং মিত্রং ধর্মো মৃতস্য চ।।

বিদেশে বিদ্যাই হল বন্ধু, গৃহে মাতাই হল বন্ধু। ঔষধ হল রোগীর বন্ধু, আর ধর্ম হল মৃতজনের বন্ধু।

বিদ্বান দুর্জনের স্বরূপ

দুর্জনঃ পরিহর্ত্তবো বিদ্যয়ালয়ষ্কৃতোহপি সন। মণিনা ভূষিতঃ সর্পঃ কিসসৌ ন ভয়ঙ্করঃ।। দুষ্টুলোক বিদ্যাদ্বারা শোভিত হলেও, তাকে পরিত্যাগ করা উচিৎ। সর্প, মণি দ্বারা ভুষিত হলেও কি ভয়ানক নয়।

সর্পঃ ক্রুরঃ খলঃ সর্পাৎ ক্ররতরঃ খলঃ।

সর্প ও খল ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য

মন্ত্রৌষধিবশঃ সর্পঃ খলঃ কেন, নির্বার্য্যতে।।

সর্প নিষ্ঠুর স্বভাব, খল ব্যক্তিও নিষ্ঠুর, খল ব্যক্তি সর্প অপেক্ষাও অধিকতর নিষ্ঠুর। মন্ত্র ও ঔষধি দ্বারা সর্পকে বশে আনয়ন করা যায়, কিন্তু খল ব‍্যক্তিকে কেহ দমন করতে পারে না।

বর্জনীয় কি কি?

পরদাবান পুরদ্রব্যং পরীবাদং পরস্য চ।

পরিহাসং গুরোঃ স্থানে চাপল্যঞ্চ বিবর্জয়েৎ।। পরের স্ত্রী, পরের দ্রব্য, পরনিন্দা, গুরুজনের সকাশে হাস্য পরিহাস ও অস্থিরতা বর্জণীয়।

কিরূপ দেশ পরিত্যাজ্য

যস্মিন দেশে ন সম্মানো ন বৃত্তির্ন চ বান্ধবঃ। ন চ বিদ্যাগমঃ কশ্চিৎ তং দেশং পরিবর্জয়েৎ।।

যে দেশে সম্মান নাই। জীবিকা নির্বাহের কোন উপায় নাই, বন্ধু নাই এবং বিদ্যাশিক্ষার স্থান নাই সেই দেশ পরিত্যাগ করা উচিৎ।

সঙ্কল্প প্রকাশে বিঘ্ন

মনসা চিন্তিতং কর্ম বচসা ন প্রকাশয়েং।

অন্যলক্ষিত কায্যস্য যতঃ সিদ্ধির্ন জায়তে।। যে কার্য মনে মনে চিন্তা করা হয়েছে, তা বাক্য প্রকাশ করা উচিৎ নয়। যেহেতু অপর ব্যক্তি সেই

কার্যের কথা জানতে পারলে সাফল্য লাভ হয় না।

স্বর্গ সুখ ভোগের অধিকারী কে?

অস্তি পুত্রো বশে যন্য ভূত্যে ভাৰ্য্যা তথৈব চ।

অভাবে সতি সন্তোষঃ স্বর্গস্থোহসৌ মহীতলে।। যে ব্যক্তির পুত্র অনুগত, যাঁহার ভত্য ও পত্নী ঐরূপ অনুগত, অভাবের মধ্যেও যিনি সন্তোষ অনুভব

করেন, এ জগতে তিনি স্বর্গবাসী অর্থাৎ এই পৃথিবীতে বাস করেও তিনি স্বর্গসুখ অনুভব করেন।

অতিরিক্ত মাত্রায় পরিণাম

অতিদর্পে হতা লঙ্কা অতিমানে চ কৌরবাঃ।

অতিদানে বলিবদ্ধঃ সর্বমত্যন্তগর্হিতম্।।

অত্যাধিক অহঙ্কার বশতঃ লঙ্কা বধিস্ত হয়োছিল, অত্যধিক অভিমান বশতঃ কৌরবদিগের বিনাশ হয়েছিল, অতিরিক্ত। দানে বলিরাজ (পাতালে) বদ্ধ হয়েছিলেন, সকল কার্যে বাড়াবাড়ি নিন্দিত হয়ে থাকে (কারণ উহা অনর্থ ঘটিয়ে থাকে)।

সাধু সঙ্গের ফল

সাধুনাং দর্শনং পূণ্যাংতীর্থভতা হি সাধবঃ। তীর্থৎ ফলতি কালেন সদ্যঃ সাধুসমাগমঃ।।

সাধুদিগের দর্শন পুণ্যাত্মক, সাধুগণ হইলেন তীর্থ স্বরূপ (অর্থাৎ সাধুসঙ্গে থাকিলে তীর্থদর্শনের সমান ফল লাভহয়), তীর্থ দর্শনের ফল বিলম্বে ফলে (অর্থাৎ পরকালে), (কিন্তু) সাধুসঙ্গের ফল সদ্য সদ্যই ফলিয়া থাকে।

কিসের কাহার বল

দুর্বলস্য বলং রাজা বালানাং রোদনং বলম্। বলং মুখস্য মৌনিত্বং চৌরাণামনৃতং বলম্।। রাজা হলেন দুর্বলের বল (শক্তি, রক্ষক), ক্রন্দন হল শিশুদের বল, নীরবতা হল মুখ ব্যক্তির বল এবং মিথ্যা কথা হল চোরের বল।

অন্নদাতা ভয়ত্রাতা ষস্য কন্যা বিবাহিতা।

পঞ্চপিতা

জনয়িতোপনতা চ পঞ্চৈতে পিতরঃ।।

যিনি অন্নদান করেন, যিনি ভয় হতে রক্ষা করেন, যিনি কন্যা দান করেন (শ্বশুর), যিনি জন্মদান করেন (পিতা), যিনি উপনয়ন দান করেন এই পাঁচজনই পিতা বলে কথিত হন।

সপ্তমাতা

আত্মমাতা গুরোঃ পুত্নী ব্রাহ্মণী রাজপত্রিকা। ধেনুর্ধাত্রী তথা পৃথী সপ্তৈতে মাতরঃ স্মৃতাঃ।। নিজের মাতা, গুরুপত্নী, ব্রাহ্মণী, রাজপত্নী, গাভী, ধাইমা এবং পৃথিবী এই সাতজন মাতা বয়ে কথিত হন। এইরূপ আরও বহু শ্লোক আছে। স্থানাভাবে সমস্ত শ্লোক উল্লেখ করা সম্ভবপর হল না।

স্বপ্ন তত্ত্ব

স্বপ্ন আকারে স্বপ্ন বিদ্যার বিশ্লেষণ সম্ভব নয় বিধায় পঞ্জিকায় প্রকাশ করা হলো না। স্বপ্ন বিষয়ক বিষদ জানতে ড. কে.সি.পাল কর্তৃক রচিত "বৃহৎ স্বপ্ন তত্ত্ব" বইটি সংগ্রহ করতে পারেন

উপসংহার: পণ্ডিত শিরোমণি চাণক্যের শ্লোক শুধু উপদেশ নয়—এগুলো জীবনের বাস্তব শিক্ষা। এসব নীতি অনুসরণ করলে ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন ও সমাজজীবন আরও সুসংগঠিত, পরিপূর্ণ ও সফল হতে পারে।

FAQ (Normal Question–Answer)

প্রশ্ন: চাণক্যের নীতি কী শেখায়?

চাণক্যের নীতি মানুষকে বাস্তবতা, সতর্কতা, সম্পর্ক, জ্ঞান, শত্রু-বিশ্লেষণ ও সাফল্যের পথ দেখায়।

প্রশ্ন: চাণক্যের কোন শ্লোকটি সবচেয়ে জনপ্রিয়?

“যে বিপদে পাশে থাকে, সেই সত্য বন্ধু”—এই শ্লোকটি সর্বাধিক পরিচিত ও জীবন্ত সত্য।

প্রশ্ন: চাণক্যের নীতি কি আধুনিক জীবনে কার্যকর?

হ্যাঁ, চাণক্যের নীতি আজও সম্পর্ক উন্নয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নেতৃত্ব ও জীবনের বাস্তব সমস্যায় অত্যন্ত কার্যকর।


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url