মহাপুরুষ শ্রীশ্রী শঙ্করদেব: জীবনী, শিক্ষা, ও অবদান
আজি হতে প্রায় ষোল পুরুষ পূর্বে বর্তমান আসামের নগাঁও জেলায় শ্রীশ্রী-শঙ্করদের আবির্ভূত হন। তিথিটা ছিল আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী। প্রায় ৫০০ বৎসর অতীত হইলেও আজও স্ত্রীস্ত্রী-শস্তরদেবের আবির্ভাবোৎসব মহাসমারোহে সমগ্র আসামে পালিত হয়।।
প্রায় ষষ্ঠ শতাব্দীতে উত্তর ভারতে তখন ভাগবত ধর্ম প্রচারিত হচ্ছিল এবং তখন পাল বংশ রাজত্বে বিষ্ণু এবং শিব পূজা প্রচলন ছিল।
![]() |
শ্রীশ্রীশঙ্করদেব |
এই সময় এখানে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর কিছু মানবের প্রমাণও পাওয়া যায়। একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে তখন দেশে শক্তিপুজা প্রবল হয়ে ওঠে। এই সময়কালে বৌদ্ধ মতাবলম্বী বিকৃত তন্ত্রের এবং কিছু তান্ত্রিক বৌদ্ধ হয়ে ওঠে। তাঁরা বৌদ্ধদেবীর পূজা বৌদ্ধ মতেই চলিবার জন্য দাবি করে। ইহার উপর কিছু বৌদ্ধ সামান্য কিছু ভাগবত্ শিক্ষা করিয়া পূর্ণরূপে আদি সম্প্রদায় সৃষ্টি করে।
এই সময় দেশের মধ্যে রাষ্ট্র বিপ্লব দেখা দেয়, স্তন্ত, পাল, খেন, ভূঁঞা, সূতিয়া, আহোম, কছারী, কোচ প্রভৃতি বহু রাজবংশের উত্থান পতনের ফলে এবং ভারতের পশ্চিমাংশে পাঠান। মোগলের দাঙ্গার সময় বহু মানুষ এই দেশে এসেছিল এবং ইহার ফলে সেই সময় সামাজিক রীতিনীতি এবং ধর্মমত সম্বন্ধে নানা ঘাত-প্রতিঘাত শুরু হয়ে যায়।
এই নানা ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্বভারতীয় সমাজ যখন অতিষ্ঠ হইয়া উঠে, তখন এই সমাজে পরিবর্তনের আশা আকাঙ্খা পূরণে আবির্ভাব হয় ভগবৎ মূর্তি স্বরূপ শ্রীশ্রী শঙ্করদেবের। আবির্ভাব লগ্নে মহাপুরুষের বীণার ঝংকারে দেশবাসীর 'মনপ্রাণ ভগবৎমুখী হয়ে ওঠে। শ্রীশঙ্করের বিভিন্ন নাম ছিল ডেকাগিরী, শঙ্কর, গদাধর, মহাপুরুষ, আচার্য্য, অন্ত, মহন্ত, আতা, গোমস্তা এবং জগন্নাথ।
শিশুকালেই শ্রীমন্ত শঙ্করের পিতৃদেব কুসুম্বর শিরোমণি ভুএল এবং মাতৃদেবী সত্যসন্ধ্যা আইর লোকান্তর ঘটে। পিতৃদেবের সমূহ কাজ পিতামহ জয়ন্ত ও মাধবে পালন করে এবং পিতামহী খেরসুতী আয়ে শ্রীশঙ্করকে লালন পালন করে। বারো বছর বয়সে শ্রীশঙ্করের আনচক্ষু ফুটে উঠে। সেই সময় রামরাম গুরু' আদির গৃহ ইইতে ধনু-কাঁড় হাতে নিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াতেন। বনের মধ্যে পশু-পক্ষীর সঙ্গে নানারকম ক্রীড়ায় রত থাকতেন। এও শোনা যায় এক সময় একটা শুয়ে থাকা ভয়ঙ্কর ভালুকের পিঠে চড়ে শ্রীশঙ্কর চারিদিক ঘুরে বেড়ান। শ্রীশঙ্করের শিশুকালের নানা ক্রীড়াকর্ম নিয়ে অনেকেই অনেক রকম ধারণা করতেন।
এরপর শ্রীমন্ত শঙ্কর গুরুগৃহে গমন করেন। গুরুগৃহে ৫ বৎসর থাকিয়া সমূহ পাঠ সমাপ্ত করিয়া গৃহে ফিরিয়া আসেন। গৃহে ফিরিয়া শ্রীমন্ত শঙ্কর যোগ অভ্যাস, ভাগবত চর্চা এবং বৈকুণ্ঠর পট অঙ্কনে মনোনিবেশ করেন। এরপর তিনি শুরু করেন 'চিহ্ন যাত্রা ভাওনা' এই চিহ্ন যাত্রার নাটিকা রচনা করিয়া পরে ভাওনা আরম্ভ করিলেন। এতে বহু লোক আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে। তার রচিত গান সমূহ শুনিয়া লোকে তন্ময় হইয়া যাইত। ক্রমে ক্রমে তিনি ভাগবত ধর্ম প্রকাশে মনোযোগ করেন। শ্রীমন্ত শঙ্করের এই উদ্যোগে সকলেই মনোনিবেশ করলেন। তাঁদের মন থেকে দূর হ'ল সকল ভয় ও সংশয়। সকলের মনে তখন একটি কথাই জন্মিল-সারা বিশ্বে হিংসা, দ্বেষ দূর করিয়া সকলের জন্য সমভাব।
এইভাবে শঙ্করদেব নানান ধর্মকর্ম, তীর্থ পর্যটন, দেব উপাসনা করে সারা আসামে প্রতিটি মানবের মধ্যে • একটা ধর্মীয় উন্মাদনার প্রাদুর্ভাব করেছিলেন। সেই থেকে আজো মানুষ, সেই ধর্মীয় উন্মাদনার মধ্যেই শ্রীমন্ত • শঙ্করদেবের আবির্ভাব ও তিরোভাব নানা অনুষ্ঠানের মধ্যেই পালন করে আসছেন। শ্রীমন্ত শঙ্কর মানব কল্যাণে তাঁর সমূহ ক্রিয়াকর্ম শেষ করিয়া ভক্তগণের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ ফরিয়া অবশেষে ছয়কুড়ি (১২০) বৎসরে ১৪৯১ শকাব্দে ভক্তগণের হরিকীর্তনের মধ্যে বৈকুণ্ঠে গমন করেন।
শ্রী শ্রী শংকরদেবের জীবনী
বাংলা ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে শংকর দেবের জন্ম নওগাঁ জেলার আলিপুর বড়দরা নামক গ্রামে হয়েছিল তাহার পিতার নাম ছিল কুশবি আর মাতার নাম ছিল সতী। তার মাতা ও পিতা উভয় ধার্মিক ছিলেন।
শ্রী শ্রী শংকরদেবের শিক্ষা
শিক্ষা জীবন : শঙ্কর দেব শিশুকালে অসাধারণ বুদ্ধিমান ছিলেন। গুরু চরণ নামক এক বিদ্বান ব্রাহ্মণের শিষ্য থেকে তিনি শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল যে, তিনি বেদ, উপনিষদ, গীতা, ভগবত, রামায়ণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ অধ্যায়ন করতে ওখান থেকেই।
শ্রী শ্রী শংকরদেবের ধর্মীয় অবদান
শঙ্কর দেবের সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল অসমীয়া জাতি গঠনের ক্ষেত্রে। শংকরদেবের চিন্তা চেতনা সম্প্রদায় মুক্ত আছিল তিনি সকল জাতিকে উৎসাহিত করেছিল অসমীয়া জাতি গঠনে। তিনি সংগীত সাহিত্য নাটক চিত্রকলা প্রভৃতিতে যুগান্তকারী একক পরিবর্তন আনেন।
মহাপুরুষ শ্রী শ্রী শংকরদেবের জীবনী, শিক্ষা, অসমীয়া সংস্কৃতি প্রভৃতি হলো উল্লেখযোগ্য অবদান।
সংকর দেবের অবদান সনাতন ধর্মে
সংকর দেব ছিলেন একজন ভক্ত এবং সমাজ সংস্কারক, যিনি বিশেষ করে আসাম অঞ্চলে সনাতন হিন্দুধর্মের, বিশেষ করে বৈষ্ণব ধর্মের পক্ষে কাজ করেছেন। ১৫শ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া এই মহান ব্যক্তি ধর্মশিক্ষা ছড়িয়ে দিতে নানা উপায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সংকর দেবের কাজকর্মের কিছু মূল দিক:
১. একেশ্বরবাদী বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার:
তিনি শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে একেশ্বরবাদ প্রচার করেন, যা ভক্তি এবং নৈতিক জীবনযাপনের ওপর গুরুত্ব দেয়।
২. নামঘর ও সত্ৰ প্রতিষ্ঠা:
পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির জন্য তিনি আসামের গ্রামগুলোতে নামঘর এবং সত্ৰ প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলো ধর্মচর্চা সহজ করে তোলে এবং মানুষকে এক জায়গায় জমা করে।
৩. নাটক ও সংগীতের মাধ্যমে ধর্ম প্রচার:
তিনি ধর্মীয় শিক্ষা নাটক, সংগীত এবং নৃত্যের মাধ্যমে পরিচয় করিয়েছেন। “অঙ্কীয়া নাট” তার একটি উল্লেখযোগ্য কাজ, এবং তিনি পুরাণগুলোর অনুবাদ করেছেন অসমিয়া ভাষায়।
৪. বর্ণভেদ প্রথার বিরোধিতা:
সংকর দেব বর্ণপ্রথার বিরোধিতা করেন, বলেছিলেন যে ভগবানের নাম জপ এবং ভক্তি সবার জন্য উন্মুক্ত।
৫. ধর্মীয় পুনর্জাগরণ:
তিনি সমাজে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দয়া, সহানুভূতি, এবং পরোপকারকে সনাতন ধর্মের মূল জায়গায় রাখেন।
সংক্ষেপে, সঙ্কর দেব শুধুমাত্র একজন ধর্মগুরু ছিলেন না, তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের একজন নেতা। তার কাজের ফলে আসামের মানুষের মধ্যে সনাতন হিন্দুধর্মের নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে, যা আজও জীবন্ত।
সুন্দর হয়েছে