আইভিএফ (IVF) নিয়ে ধর্মীয় বিধান: ইসলাম ও হিন্দুধর্ম মতামত
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে IVF /ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। কিছু ধর্ম এটিকে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করে, আবার কিছু ধর্ম এতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। তাই IVF বা সারোগেসির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
আইভিএফ: সন্তান লাভের আশা
আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) হচ্ছে একটি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি যা নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান নিতে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়ায় নারীর ডিম্বাণু এবং পুরুষের শুক্রাণু একসাথে করে, একটি ল্যাবরেটরিতে নিষিক্ত করা হয়। তারপর এই নিষিক্ত ভ্রূণ মাতৃগর্ভে প্রবেশ করানো হয়। যারা প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণে সমস্যা পাচ্ছেন, তাদের জন্য IVF অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর সমাধান। বর্তমানে বাংলাদেশসহ নানা দেশে আইভিএফ চিকিৎসা সহজলভ্য হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে অনেক পরিবারে নতুন প্রাণ আসছে।IVF কী?
IVF, বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন, একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা সেই দম্পতিদের জন্য তৈরি করা হয়েছে যারা সন্তান নিতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এই প্রক্রিয়ায়, একজন নারীর ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয় এবং তা ল্যাবরেটরিতে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিয়ে নিষিক্ত করা হয়। এরপর, সেই নিষিক্ত ভ্রূণটি আবার নারীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই পদ্ধতিতে স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ব্যবহার করা হয়। তবে যদি কারো ডিম্বাণু বা শুক্রাণু না থাকে, তাহলে ডোনারের সাহায্য নেওয়া হয়। সারোগেসির ক্ষেত্রেও একইভাবে কাজ করা হয়, যেখানে অন্য একটি নারীর গর্ভ ব্যবহার করা হয় গর্ভধারণের জন্য।
IVF নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলাম: ইসলামে IVF নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে। যদি স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ব্যবহার করে IVF করা হয়, তাহলে অনেক ইসলামিক স্কলার এটি অনুমোদন করেন। তবে তৃতীয় পক্ষের (ডোনার) সাহায্যে শুক্রাণু, ডিম্বাণু বা সারোগেসি গ্রহণ সাধারণত হারাম হিসেবে বিবেচিত হয়। সুন্নি মুসলিমরা তৃতীয় পক্ষকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়। এছাড়া, ভ্রূণ সংরক্ষণ করে পরে ধ্বংস করা বা গবেষণায় ব্যবহার করাও ইসলামিক নীতিতে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ ইসলাম ভ্রূণকেও জীবনের অংশ হিসেবে গণ্য করে।
হিন্দুধর্মে: হিন্দুধর্মে IVF বা সারোগেসির বিষয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্যতা দেখা যায়। যদি স্বামীর শুক্রাণু ব্যবহার করা হয়, তাহলে কৃত্রিম গর্ভধারণকে বৈধ মনে করা হয়।
হিন্দু ধর্মে: ভারতে সারোগেসি অনেক বছর ধরেই আলোচনার বিষয় এবং হিন্দু সমাজে এটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। হিন্দু ধর্ম সন্তান জন্ম দেওয়াকে ধর্ম ও কর্মের ধারাবাহিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, তাই অনেকেই এটিকে পুণ্যের কাজ হিসেবেও দেখেন। তবে, ভ্রূণ ধ্বংস বা লিঙ্গ নির্ধারণের মতো কিছু বিষয় নিয়ে কিছু মানুষের মধ্যে নৈতিক প্রশ্ন উঠতে পারে।
খ্রিস্টধর্ম: খ্রিস্টধর্মে এই বিষয়ে নানা মতামত রয়েছে। ক্যাথলিক মতবাদ অনুযায়ী, সন্তান হল ঈশ্বরের আশীর্বাদ, তাই স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম দেওয়া সঠিক। তারা সাধারণত IVF বা অন্য কোনো কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিকে অনৈতিক মনে করে, কারণ এতে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ হয় এবং কখনো কখনো ভ্রূণ ধ্বংসের ঝুঁকিও থাকে। প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, যদি IVF শুধুমাত্র বিবাহিত দম্পতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং ভ্রূণ ধ্বংস না হয়, তবে এটি গ্রহণযোগ্য। সময়ের সঙ্গে অনেক গির্জা এই পদ্ধতির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে শুরু করেছে।
বৌদ্ধ ধর্ম: বৌদ্ধ ধর্মে IVF বা সারোগেসি নিয়ে কোনো স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা নেই। বৌদ্ধ চিন্তায় উদ্দেশ্য ও কর্ম—এই দুইটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যদি একজন দম্পতি এই পদ্ধতিতে সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, এবং সেটি দয়া ও সহানুভূতির মনোভাব থেকে হয়, তাহলে তা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য। তবে, ভ্রূণ ধ্বংসকে অহিংসার নীতির পরিপন্থী হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ইহুদিধর্ম: ইহুদিধর্মে IVF সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুমোদিত। সন্তানের জন্ম দেওয়া ইহুদিদের জন্য একটি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। যদি স্বামী-স্ত্রী নিজেদের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ব্যবহার করে IVF করেন, তাহলে এটি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য। তবে কিছু রক্ষণশীল গোষ্ঠী ডোনার ব্যবহার বা সারোগেসি নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলতে পারে।
উপসংহার: IVF বা সারোগেসি আধুনিক বিজ্ঞানের একটি অসাধারণ উপহার। যেসব দম্পতি সন্তান নিতে পারছেন না, তাদের জন্য এটি সত্যিই একটি আশীর্বাদের মতো। তবে এই পথে পা বাড়ানোর আগে নৈতিক, ধর্মীয় এবং আইনি দিকগুলো ভালোভাবে বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের যেসব দেশে সারোগেসি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হয়, সেসব দেশের নিয়ম-কানুন, খরচ এবং চিকিৎসার মান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার প্রয়োজন রয়েছে। যদি আপনি বা আপনার পরিবার এই পথে এগোতে চান, তাহলে ঠান্ডা মাথায়, ভালোভাবে গবেষণা করে, সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে এবং ধর্মীয় ও নৈতিক অবস্থান বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়াই সবচেয়ে ভালো হবে।