বর্তমান সমাজে সনাতন ধর্মে জাতিভেদ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমেই বলি, সনাতন ধর্মে জাতিভেদের কোনো ভিত্তি নেই। এটা আসলে সমাজের তৈরি, এবং আজকের সনাতন সমাজে এই বিষয়টি আত্মঘাতী রূপ নিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে জাত-পাত এবং বর্ণপ্রথা একটা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দিক। এটা এক ধরনের পুরনো ব্যবস্থা, যেখানে চারটা প্রধান বর্ণ—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র—মোটামুটি দখল করে আছে। শুরুতে এটা মানুষের কাজ আর গুণের উপর ভিত্তি করে ছিল, কিন্তু পরে সেটা জন্মসূত্রে হয়ে যায়। এতে সমাজে বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতা দেখা দেয়। যদিও আধুনিক ভারতীয় সংবিধান জাতপাতের বিরুদ্ধে এবং সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে, এখনও অনেক জায়গায় এই প্রথার প্রভাব রয়ে গেছে। জাত-পাত ও বর্ণপ্রথা আজকের দিনে সমাজ সংস্কারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই সচেতনতা, শিক্ষা এবং মানবিক মূল্যবোধ বিকাশ করতে হবে।
 |
জাত-পাত ও বর্ণপ্রথা |
বর্ণপ্রথার উৎপত্তি কোথায়?
বর্ণপ্রথা মূলত এসেছে হিন্দু ধর্মের প্রাচীন লেখাগুলো, বিশেষ করে ঋগ্বেদ থেকে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে “পুরুষসূক্ত”-এ বলা হয়েছে, আদিপুরুষের শরীর থেকে চারটা বর্ণের জন্ম হয়েছে—
ব্রাহ্মণ হয়েছে মুখ থেকে,
ক্ষত্রিয় হয়েছে বাহু থেকে,
বৈশ্য হয়েছে উরু থেকে,
এবং শূদ্র হয়েছে পা থেকে।
এটার মানে হলো সমাজে আলাদা আলাদা শ্রেণি ভিন্ন কাজের জন্য নিয়োজিত ছিল— ব্রাহ্মণরা ধর্ম ও জ্ঞান নিয়ে, ক্ষত্রিয়রা সরকার ও রক্ষা নিয়ে, বৈশ্যরা ব্যবসা ও কৃষি নিয়ে, আর শূদ্ররা সেবামূলক কাজে।
প্রথমে বর্ণব্যবস্থা গুণ, কাজ এবং স্বভাবের ওপর নির্ভর করলেও পরে এটা জন্মসূত্রে নির্ধারিত হয়ে যায়, ফলে সমাজে কঠিন শ্রেণিবিন্যাস ও বৈষম্য তৈরি হয়। মনুসংহিতা আর অন্য লেখায় এই বর্ণবিভাজনকে আরও মজবুত করা হয়, যা জাতপাতের ভিত্তি স্থাপন করে। বর্ণপ্রথার মূল উৎপত্তি ধর্মগ্রন্থ থেকে হলেও, এর সামাজিক পরিবর্তন অনেক বছর ধরে হয়েছে এবং আজও এর প্রভাব আমাদের সমাজে রয়েছে।
জাত-পাত ও বর্ণপ্রথা সম্পর্কে বেদ ও গীতার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
পবিত্র বেদ এবং গীতায় জাত-পাত ও বর্ণপ্রথা নিয়ে কিছু আলোচনা আছে। বেদের বিভিন্ন অংশে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং দায়িত্বের উল্লেখ রয়েছে, যেখানে মানুষের উচিত নিজেদের কাজের মাধ্যমে নিজেদের মূল্য প্রমাণ করা। গীতায়ও একে কেন্দ্র করে কিছু কথা বলা হয়েছে, যেখানে সকল মানুষের সমান মর্যাদা ও কাজের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে, এসব তাত্ত্বিক আলোচনা বাস্তব জীবনে নানা উপায়ে বিভিন্ন জনগণের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছে। উপমহাদেশে আর্যীকরণের পর সমাজের শ্রেণী বিন্যাস করা হয়েছিল। এই বিন্যাসে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করত বিভিন্ন বর্ণের মানুষের গুণাবলী আর কাজের ওপর। উদাহরণ হিসেবে, ব্রাহ্মণদের ‘সত্ত্বা’ বা ভালোর রক্ষক হিসেবে দেখা হতো এবং তাদেরকে পবিত্র ও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হতো। মানে, ব্রাহ্মণদের পবিত্রতার জন্য অনেক কদর ছিল এবং তাদের দেবদূতের মর্যাদা দেওয়া হতো। লক্ষণীয় যে, পবিত্রতার এই ধারণা ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের জন্য কমে যেত, যথাক্রমে ‘রজ’ ও ‘তম’ হিসেবে গুণাবলীর ওপর ভিত্তি করে। আর শুদ্রদের তো এমন কোনো গুণ ছিল বলেও মনে করা হতো না। চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত এই বিন্যাসের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি ছিল ঋগ্বেদের পুরুষ সুক্ত মন্ত্র, যা পরে ব্যাখ্যা করা হয় বলে ধারণা করা হয়।
সনাতনধর্মে জাত-পাতের ভিত্তি আছে কি? বিচার করুন আপনি নিজেই
অনেকে প্রশ্ন করেন—সনাতনধর্মে কি আদৌ জাতিভেদ বা বর্ণভিত্তিক বিভাজনের কোনো স্থান আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের মূল ধর্মশাস্ত্র, বিশেষ করে বেদ ও গীতা দেখতেই হবে। আপনি নিজেই বিচার করুন, ধর্মের কোথাও কি জাতিভেদের ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়?
প্রথমেই বলি—ধর্মে জাতিভেদের কোনো স্থান নেই। অনেকেই মনে করেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই শ্রেণিবিভাগ জন্মসূত্রে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, সনাতন ধর্মশাস্ত্রে এসব বর্ণভেদ নির্ধারিত হয়েছে গুণ ও কর্ম অনুযায়ী, জন্ম অনুযায়ী নয়। চলুন দেখি বেদে কী বলা আছে:
কে ব্রাহ্মণ?
যে ব্যক্তি ঈশ্বরের প্রতি গভীরভাবে ভক্ত, নিষ্ঠাবান, সুশৃঙ্খল, বেদ প্রচারকারী, অহিংস, বেদজ্ঞ—সে-ই প্রকৃত ব্রাহ্মণ।
ঋগ্বেদ ৭.১০৩.৮
কে ক্ষত্রিয়?
যে সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, রাজনৈতিকভাবে জ্ঞানসম্পন্ন, অসৎ-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামী, ধর্মরক্ষায় দৃঢ় এবং অহিংস সে-ই ক্ষত্রিয়।
ঋগ্বেদ ১০.৬৬.৮
কে বৈশ্য?
যিনি দক্ষ ব্যবসায়ী, দানশীল, কর্মনিষ্ঠ এবং কর্মসংস্থানে সহায়ক—তিনিই বৈশ্য।
অথর্ববেদ ৩.১৫.১
কে শূদ্র?
যিনি কষ্টসহিষ্ণু, লোভমুক্ত, অক্লান্ত পরিশ্রমী এবং জরা যাকে সহজে স্পর্শ করতে পারে না—তিনিই প্রকৃত শূদ্র।
ঋগ্বেদ ১০.৯৪.১১
তাহলে গীতায় বর্ণভেদ কেন বলা হলো?
অনেকে বলেন—ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো গীতায় বলেছেন তিনি চার বর্ণ সৃষ্টি করেছেন! তাহলে কি সেখানেও জন্মভিত্তিক বিভাজন রয়েছে? না, মোটেই নয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১৩তম শ্লোকে স্পষ্টভাবে বলেছেন:
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪.১৩)
অর্থঃ আমি গুণ ও কর্ম অনুযায়ী মানব সমাজে চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছি। যদিও আমি এই সৃষ্টির কর্তা, তবুও আমায় মনে করো অকর্তা ও অব্যয়।
এখানে “গুণ” ও “কর্ম” কথাটিই মূল কথা—জন্ম নয়। গুণ বলতে ব্যক্তির চরিত্র, প্রকৃতি ও নৈতিকতা বোঝায়, আর কর্ম মানে তাঁর কাজ বা পেশা। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন জন্ম নয়, গুণ ও কর্মই মানুষকে বর্ণ নির্ধারণ করে।
বেদে সাম্যের বার্তা
বেদের আরেকটি শ্লোক থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে সনাতনধর্ম জাতিভেদের নয়, সাম্যের পক্ষে কথা বলে:
“মানবের মধ্যে কেহ বড় নয়, কেহ ছোট নয়, কেহ মধ্যম নয়। তাহারা সকলেই উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা করছে। তারা জন্ম থেকেই কুলীন, তারা আমার নিকট সত্যপথে আসুক।”
ঋগ্বেদ ৫.৫৯.৬
জাত-পাত কি ধর্মীয় নাকি সামাজিক সমস্যা?
জাত-পাত বা বর্ণপ্রথা আসলে একটা জটিল সমস্যা, যা ধর্ম এবং সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। হিন্দু ধর্মে বর্ণগুলো চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। যদিও পুরনো ধর্মগ্রন্থে এটার কথা লেখা আছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা কঠোর পদ্ধতিতে বর্ণelভেদ তৈরি করেছে, যেখানে নিম্ন বর্ণের মানুষের প্রতি বৈষম্য দেখা যায়। ইসলাম, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মে সমতা এবং সাম্যের কথা বলা হলেও, সমাজে জাত-পাতের প্রভাব পুরোপুরি শেষ হয়নি। এছাড়া, জাত-পাত আসলে একটা গুরুতর সামাজিক সমস্যা। এটি মানুষের মর্যাদা, সুযোগ এবং অধিকারগুলোর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সমাজে উচ্চ এবং নিম্ন বর্ণের মধ্যে বিভেদ, বিয়েতে বাধা, কাজের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং কখনও কখনও হিংসা এই বর্ণপ্রথার ফলাফল। যদিও আজকাল আইন অনুযায়ী জাত-পাতের বিরুদ্ধে প্রচার চলছে, সমাজের কিছু ধারণা এবং সংস্কারের কারণে এটি এখনও টিকে আছে। তাই, জাত-পাত শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং একটি সামাজিক সমস্যা, যার সমাধানের জন্য ধর্মীয় সংস্কার এবং সামাজিক সচেতনতা উভয়ই প্রয়োজন।
আধুনিক সমাজ আইনি ও নীতিগতভাবে বর্ণপ্রথার বিরোধিতা করলেও, সামাজিক বাস্তবতায় এর প্রভাব পুরোপুরি দূর হয়নি। বরং, এটি অনেক সময় রূপান্তরিত হয়ে সংস্কৃতি, অভ্যাস বা রাজনীতির ছায়ায় রয়ে গেছে।
আজকাল বর্ণপ্রথা সম্পর্কে বলতে গেলেও, সমাজে এর নানা প্রভাব এখনও স্পষ্ট দেখা যায়।
বিশ্লেষণ:
১. আইনি এবং সাংবিধানিক দিক: ভারতসহ অনেক দেশে বর্ণভিত্তিক বৈষম্য নিষিদ্ধ। আমাদের সংবিধানে অস্পৃশ্যতা নিয়ে কঠোর আইন আছে। দলিত এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণির উন্নয়নের জন্য সংরক্ষণ নীতি চালু আছে।
২. বাস্তব সমাজে প্রভাব: বিবাহে বর্ণভেদ এখনও অনেক জায়গায় দেখা যায়। আন্তর্বর্ণ বিয়েটা খুবই কম এবং অনেক পরিবারে এটি নিয়ে বাধা থাকতেই পারে। শিক্ষা, চাকরি, এবং সামাজিক সম্পর্কেও উচ্চ এবং নিম্নবর্ণের মধ্যে পার্থক্য এখনো রয়েছে। গ্রামে অনেক সময় নিম্নবর্ণের মানুষকে আলাদা পাত্রে খেতে হয়, এবং মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয় — যদিও এটা বেআইনি।
৩. আধুনিক মনোভাব ও পরিবর্তন: শহরাঞ্চলে তরুণদের মধ্যে বর্ণের প্রভাব কমছে, কিন্তু নিশ্চয়ই এটি পুরোপুরি চলে যায়নি। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাঁদের বর্ণ পরিচয় আবার তুলে ধরছেন, যেমন: “আমি ব্রাহ্মণ”, “আমি ক্ষত্রিয়”।
৪. রাজনীতিতে বর্ণভিত্তিক পরিচয়: ভোটের রাজনীতিতে অনেক দল বর্ণভিত্তিক গণনার ওপর গুরুত্ব দেয়। এটি এক দিকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করলেও, অন্য দিকে বর্ণ পরিচিতিকে আবারও সামনে নিয়ে আসে।
উপসংহার
সনাতনধর্মে মানুষের প্রকৃত পরিচয় জন্ম নয়, তার গুণ ও কর্ম। জাত-পাত বলে কিছু নেই; এগুলো পরে সমাজে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর তৈরি করা বিভাজন। প্রকৃত সনাতন ধর্মগ্রন্থসমূহ জাতিভেদ নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ, সাম্য, কর্মনিষ্ঠা ও আত্মোন্নতির কথা বলে।