অম্বুবাচী কি? এর ইতিহাস, গুরুত্ব ও করণীয় এবং বর্জনীয়

অম্বুবাচী অনেকে আবার আমাতী নামে ডাকে। আসলে অম্বুবাচী মানে কামাখ্যার দেবীর শরীরের ঋতুস্রাব। তাই এই সময় দেবীর দেখা পাওয়া যায় না। তাই কামাখ্যা মায়ের মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। অম্বুবাচী হল হিন্দু ধর্মের একটি বিশেষ উৎসব, যা কামাখ্যা দেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনার কারণে পালন করা হয়। এই উৎসব প্রতি বছর আষাঢ় মাসের সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত চার দিন ধরে উদযাপন করা হয়। বিশেষ করে আসাম রাজ্যের কামাখ্যা মন্দিরে এই সময় অনেক ভক্তের সমাগম হয়।

অম্বুবাচী কি এর ইতিহাস, গুরুত্ব
অম্বুবাচী কি এর ইতিহাস, গুরুত্ব


অম্বুবাচীর ধর্মীয় ইতিহাস: কিভাবে অম্বুবাচী শুরু হলো, তার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই কোনো বইতে বা শাস্ত্রে। তবে কিছু মানুষের কথা, তন্ত্রের বিশ্বাস আর কামাখ্যা দেবীর গল্প থেকে এই উৎসবের শুরু মনে করা হয়। ভাবা হয়, কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরের সঙ্গে এই উৎসবের জন্ম, যা দেবী মায়ের ভক্তদের জন্য খুব পবিত্র একটা জায়গা। পুরোনো দিনের গল্পে আছে, যখন দেবী সতীর শরীর ভগবান শিব কাঁধে নিয়ে নাচতে শুরু করেন, তখন বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে সতীর শরীর টুকরো করে দেন। সেই সময় সতীর যে "যোনি" অংশ পড়ে যায়, সেটাই হলো "কামাখ্যা"। এখানে দেবীকে "যোনি শক্তি" বা "নতুন কিছু তৈরির দেবী" হিসেবে পুজো করা হয়।

মানুষের বিশ্বাস, প্রতি বছর আষাঢ় মাসে এই মন্দিরের মাটি লাল হয়ে যায়, আর গুহার ভেতর থেকে রক্তের মতো স্রোত দেখা যায়। এটাকে দেবীর ঋতুস্রাব বলা হয়। এই সময় মন্দির বন্ধ থাকে, কোনো পুজো বা মন্ত্র পড়া হয় না, কারণ এটা দেবীর আরামের সময়। এই বিশ্বাস থেকেই অম্বুবাচী উৎসবের শুরু, যা পরে তন্ত্র মন্ত্র, ফসল আর প্রকৃতির সঙ্গে জুড়ে এক গভীর ধর্মীয় উৎসবে দাঁড়িয়েছে।

তাই, অম্বুবাচী মূলত শক্তি আর নতুন কিছু তৈরির দেবীর পূজার পুরোনো দিনের নিয়ম থেকে এসেছে। কামাখ্যা মন্দির থেকে এটা ধীরে ধীরে পুরো ভারতে, বিশেষ করে পূর্ব আর উত্তর-পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে গেছে।

অম্বুবাচীর তাৎপর্য: অম্বুবাচী নামটা এসেছে "অম্বু" মানে জল আর "বাচী" মানে শুরু, মানে যেখানে জীবনের শুরু। এই সময় কামাখ্যা মায়ের শরীর খারাপ থাকে, তাই তিনি একটু চুপ করে থাকেন। এই কটা দিন মন্দিরের দরজা বন্ধ, কোনো ঠাকুর পুজোও হয় না। এটা মায়ের খারাপ সময়ের মতো, তাই মাটির ক্ষমতাকেও এর সাথে মেলানো হয়। এটা মেয়েদের শরীরকে সম্মান জানানোর পুরনো নিয়ম।

এই সময় চাষবাস বন্ধ থাকে, মাটিও একটু জিরিয়ে নেয়। এই উৎসব মেয়েদের শক্তি বা "শক্তি" পূজার খুব দরকারি একটা সময়। কামাখ্যা মা এখানে শক্তির একটা রূপ – যিনি সব কিছু তৈরি করেন। যারা জাদুবিদ্যা করে তারা ভাবে, এই সময় তাদের ক্ষমতা খুব বেড়ে যায়। অনেক যোগী এই সময় কামাখ্যায় আসেন নিজের শক্তি বাড়ানোর জন্য। অম্বুবাচীর সময় লাল কাপড় বা সিঁদুর রক্তের মতো ব্যবহার করা হয়। অম্বুবাচী শেষ হলে "দ্বারোৎসব" হয় – মানে মায়ের দরজা আবার সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই উৎসবে মন্দিরে খাবার দেওয়া হয় আর অনেক কিছু তাহার উদ্দেশ্যে দান করা হয়। কামরূপ-কামাখ্যায় এটা বিশাল একটা মজার দিনের মতো হয়। এই উৎসব জাদুবিদ্যার একটা বড় সময়। সবাই নিজেদের ঘরেও কিছু নিয়ম মানে – যেমন রান্না না করা, কিছু না খাওয়া, এইসব। অনেকে মায়ের জন্য এই কটা দিন কিছু না খেয়ে থাকেন।

এটা হলো মানুষ আর প্রকৃতির একসঙ্গে থাকার একটা দারুণ উদাহরণ। অম্বুবাচী আমাদের মনে করিয়ে দেয় – মেয়ে হওয়া আর মা হওয়া শুধু শরীর নয়, এটা শক্তি আর নতুন কিছু তৈরির পরিচয়।

অম্বুবাচী পার্বণের ধর্মীয় গুরুত্ব:

অম্বুবাচী পার্বণ হিন্দুধর্মে, বিশেষত শাক্ত আর তান্ত্রিক রীতিতে এক গভীর মানে নিয়ে আসে। এই উৎসবটা মূলত দেবী মায়ের ঋতুস্রাবের সময় পালন করা হয়। মনে করা হয় মা বসুমতী বা পৃথিবীও যেন বিশ্রাম নেন। হিন্দুধর্মে প্রকৃতি আর নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকে খুব পবিত্র ভাবা হয়। অম্বুবাচীর সময় এই রজঃস্রাবকে দেবীর একটা আসল রূপ ভাবা হয়। তাই ভক্তরা মায়ের বিশ্রামের সময় মন্দিরে ঢোকা, পুজো করা, বা হোম করা বন্ধ রাখেন।

এই পরব আমাদের মনে করায়, প্রকৃতিও একজন মা। তিনি বানান, বাঁচান, আর তাঁরও ক্লান্তি লাগে। তাই এই তিন দিন তাঁকে পুরো ছুটি দেওয়া হয়। চতুর্থ দিনে "শুদ্ধি" করে আবার তাঁর পুজো করা হয়। তান্ত্রিকরা মনে করেন, এই সময় দেবীর ভেতরের শক্তি জেগে ওঠে, যা কিছু পাওয়ার জন্য খুব ভালো সময়। তান্ত্রিক যোগীরা মন্ত্র, তপস্যা, আর যজ্ঞের মাধ্যমে নিজের ভেতরের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করেন।
সব মিলিয়ে দেখলে, অম্বুবাচী শুধু একটা উৎসব নয়। এটা প্রকৃতি, নারীর শরীর, আর নতুন কিছু তৈরির ক্ষমতাকে সম্মান জানিয়ে এক গভীর কথা বলে। এখানে বিশ্রাম, পবিত্রতা, শক্তি, আর সৃষ্টি একসঙ্গে মেশে।

 হিন্দু মতে অম্বুবাচীর সময় করণীয় এবং বর্জনীয়

অম্বুবাচীর সময় বর্জনীয়

১. অম্বুবাচীতে মাটি খোঁড়া আর গাছ লাগানো ভালো না। কারণ, এই সময় धरती माँ ঋতুমতী হন।

২. এই সময় নতুন ঘরে যাওয়া, বিয়ে বা ভালো কাজ করা ঠিক না। এগুলো করলে খারাপ কিছু হতে পারে।

৩. এই সময় বিশেষ পূজা না করাই ভালো। তবে রথযাত্রা হলে, সেটা নিয়ম মেনে করা যায়। কারণ, এটা রোজকার কাজ, বিশেষ কিছু নয়। রথযাত্রা হলো দরকারি কাজ।

৪. কালী, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, শীতলা বা চণ্ডীর ছবি বা মূর্তি যাঁরা পূজা করেন, তাঁরা লাল কাপড়ে ঢেকে রাখবেন।

৫. পূজার সময় মন্ত্র না পড়ে শুধু ধূপ-দীপ দেখালেই হবে।

৬. অম্বুবাচীতে ছবি বা মূর্তি ধরবেন না। শেষ হলে কাপড় সরিয়ে ধুয়ে আগের মতো পূজা করে আম-দুধ দেবেন।

৭. তুলসীর গোড়ায় মাটি দেবেন। যারা শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষিত, তাঁরা জপ করতে পারবেন। জপে দোষ নেই।

৮. গুরুর পূজা চলবে। গুরু যদি নারী হন, তবুও পূজা করা যাবে। 


অম্বুবাচীর সময় করণীয়

১. গুরু দেওয়া মন্ত্র বেশি করে জপ করুন।

২. সৌভাগ্যকুণ্ডের কাছে গণেশ দেখলে পূজা করুন। পশ্চিম দিকে স্নান করে তর্পণ করুন।

৩. নিজের মনের পদ্মে জপের আগুন জ্বালিয়ে ইষ্ট মন্ত্রে হোম করুন। (এটা সাধকদের জন্য)

৪. রাতের বেলা ফল পাওয়ার জন্য কামাখ্যা দেবীর কাছে মনে মনে কিছু চান। অবশ্যই আপনাদের মনের ইচ্ছা পূরণ হবে।


উপসংহার: অম্বুবাচী বা অম্বুবাচী উৎসব হলো হিন্দু ধর্মের একটা জরুরি নিয়ম, যেটা প্রত্যেক বছর আষাঢ় মাসের শুরুতে প্রায় তিন দিন ধরে চলে। এটা আসলে কামাখ্যা মায়ের সঙ্গে যুক্ত, যার প্রধান জায়গা হলো আসামের কামাখ্যা মন্দির। অম্বুবাচী মানে হলো ‘জলের ধারা’, যা প্রকৃতির নতুন কিছু করার আর সৃষ্টির একটা চিহ্ন। হিন্দু ধর্মানুসারে, এই সময় দেবী মায়ের ঋতুস্রাব হয়, তাই মনে করা হয় পৃথিবী মা হিসেবে অপবিত্র থাকে। এই তিন দিন মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে, কোনো পূজার কাজ বা চাষের কাজ করা যায় না। চতুর্থ দিনে দেবীর শুদ্ধ রূপ দেখা যায়, তাই উৎসবের মতো করে মন্দিরের দরজা খোলা হয়, আর অনেক লোক দেবীকে দেখতে আসে। 

এই উৎসব তান্ত্রিকদের কাছেও খুব দামি, কারণ এটা তাদের শক্তি দেখানোর ও সাধনা করার সময়। অম্বুবাচী উৎসব হলো মা, প্রকৃতি আর নতুন সৃষ্টির শক্তিকে সম্মান জানানোর একটা বিশেষ ধর্মীয় কাজ। এই সময়ে অম্বুবাচী পূজা ধর্মীয় ভাবনার পরিচয় দেয়, তেমনই এটি মেয়েদের শ্রদ্ধা, জমির উর্বর শক্তি ও নতুন কিছু তৈরির চিহ্ন। এটা পুরনো ভারতীয় সমাজের এক কঠিন কথা মনে করায়।




 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url