পৌষ সংক্রান্তি: ইতিহাস, তাৎপর্য ও রীতি

পৌষ সংক্রান্তি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। সাধারণত বাংলা মাসের শেষ দিনে, অর্থাৎ ৩০ পৌষ (কখনও ২৯ পৌষ, লিপ বছর অনুযায়ী) এই দিনটি উদযাপন করা হয়। এটি সূর্যদেবের দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়ণের দিকে যাওয়ার শুরুতে ঘটে। কৃষকদের জন্য এই দিনটাতে বিশেষ গুরুত্ব আছে, কারণ শীতকালীন ফসল ঘরে তোলার সময় এটি। বাংলার গ্রামের মানুষজন এই দিনটিকে উদযাপন করে আনন্দে।

পৌষ সংক্রান্তি ইতিহাস, তাৎপর্য ও রীতি
পৌষ সংক্রান্তি ইতিহাস, তাৎপর্য ও রীতি


পৌষ সংক্রান্তির সঠিক অর্থ: ‘সংক্রান্তি’ শব্দের অর্থ হলো সঞ্চার বা গমন। যখন সূর্য একটি রাশিচক্র থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করে, তখন সেই ঘটনাকেই বলা হয় সংক্রান্তি। শব্দটির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—‘সং’ অর্থ সাজানো বা সম্পৃক্ত, আর ‘ক্রান্তি’ অর্থ পরিবর্তন বা সংক্রমণ। অর্থাৎ, এটি হলো একটি নতুন রূপে, একটি ভিন্ন স্থানে গমন বা সঞ্চারের ইঙ্গিত।

বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, মাঘ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত সময়কে উত্তরায়ণ ধরা হয়, কারণ এই সময় সূর্য উত্তর দিকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে, শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত সময় পড়ে দক্ষিণায়ন-এর অন্তর্গত, যখন সূর্য দক্ষিণ দিকে গমন করে। পৌষ মাসের শেষ দিনে সূর্য দক্ষিণায়ন শেষ করে উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে; সেই কারণেই এই দিনটিকে উত্তরায়ণ সংক্রান্তি নামে অভিহিত করা হয় এবং এর একটি বিশেষ ধর্মীয় ও জ্যোতিষীয় গুরুত্ব রয়েছে।

ভীষ্মদেবের মহাপ্রয়াণ ও পৌষ সংক্রান্তির মাহাত্ম্য

ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে, মানুষের এক বছরের তুলনায় দেবতাদের এক দিন ও রাত সমান। মানুষের উত্তরায়ণের ছয় মাস এক দিনের মতো আর দক্ষিণায়ণের ছয় মাস এক রাতের মতো। রাতে মানুষ যখন সব দরজা বন্ধ করে ঘুমায়, দেবতাও একইভাবে দক্ষিণায়ণে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না, অর্থাৎ দেবলোক পুরোপুরি বন্ধ থাকে। দেবতাদের রাত পৌষ সংক্রান্তির দিন শেষ হয় আর তার পরের দিন সকালে তাদের দিনের শুরু হয়। সেই সময় স্বর্গে থাকা সবাই ঘুম থেকে ওঠে এবং ভগবতের সেবা শুরু করে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ব্রহ্মমুহূর্তে স্নান, নামযজ্ঞ, গীতাপাঠ ও শঙ্খধ্বনি দিয়ে দিনটাকে উদযাপন করেন। গঙ্গা পুত্র ভীষ্ম মনে রাখতেন যে, তার পিতা শান্তনু তাকে এক বিশেষ বর দিয়েছিলেন, যার ফলে তিনি নিজের ইচ্ছা ছাড়া মৃত্যুবরণ করতে পারবেন না। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীষ্ম ছিলেন এক প্রখ্যাত বীর, যিনি সর্বদা নিজের প্রতিজ্ঞার জন্য পরিচিত। উত্তরায়ণ সংক্রান্তি দিনটি তার মহাপ্রয়াণের স্মরণে আরও বিশেষ হয়ে ওঠে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবদের চারটি সেনাপতির মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান সেনাপতি।  যুদ্ধের দশম দিনে, সূর্যাস্তের কিছু আগে, অর্জুনের শরাঘাতে ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে যান।

ভীষ্মদেব মাটি স্পর্শ করেননি; তিনি পরম ধৈর্যের সঙ্গে আটান্ন দিন ধরে শরশয্যায় শুয়ে ছিলেন, শুধুমাত্র উত্তরায়ণ শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। অবশেষে পৌষ সংক্রান্তির দিন, যোগবলে তিনি দেহত্যাগ করেন। আজও গ্রামবাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই দিন ভোরবেলায় খড় ও বাঁশ জ্বালিয়ে আগুন ধরানো হয়—যাকে ভীষ্মের প্রতীকী চিতা হিসেবে ধরা হয়।এই দিন থেকেই সূর্য উত্তর দিকে হেলতে শুরু করে, এজন্য একে মকর সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণ সংক্রান্তি বলা হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, ভীষ্মদেব দেহত্যাগের পর সরাসরি ভগবদ্ধামে যাননি, কারণ তিনি ছিলেন ‘দৌ’ মতে অষ্টবসুদের একজন—‘দ্যু’ নামক দেবতা, যিনি মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপে মানবজন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নিয়তি ছিল দেবলোকেই ফিরে যাওয়া। দক্ষিণায়নের সময় দেবলোকের রাত্রিকাল চলে, তখন দেবতারা কর্মে অচল থাকেন। সেই সময় কেউ দেহত্যাগ করলে দেবলোকে প্রবেশ করতে হলে তাকে অপেক্ষা করতে হয়। ভীষ্মদেব ইচ্ছামৃত্যুর অধিকার রাখলেও, তিনি এই অশুভ সময় দেহত্যাগ না করে অপেক্ষা করাকে শ্রেয় মনে করেন। কারণ, উত্তরায়ণের সূচনা শুভ, এবং তখন দেবতারা জাগ্রত ও কর্মক্ষম থাকেন। সেই সময় দেহত্যাগ করলে দেবলোকে প্রবেশ সহজ হয় এবং মোক্ষলাভ সম্ভব হয়।

তিনি জানতেন, উত্তরায়ণের শুরুতে মৃত্যু হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্য, সৎসঙ্গ ও দেবলোকে প্রবেশ—সবই একসাথে লাভ করা সম্ভব। দেবলোকে একা বসে অপেক্ষা করার চেয়ে, শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্যে থেকে জীবনশেষ করাই ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। তাই প্রায় ৫৬ দিন ধরে শরশয্যায় শুয়ে থেকে, অবশেষে পৌষ সংক্রান্তির রাতে ভীষ্মদেব যোগবলে দেহত্যাগ করেন এবং দেবলোকে প্রত্যাবর্তন করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে, প্রায় ৫০০০ বছর ধরে পৌষ সংক্রান্তির সকালে বাঙালি সহ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা খড়-কুটো জড়ো করে ভীষ্মদেবের প্রতীকী চিতা জ্বালিয়ে তাঁর অন্তিম যাত্রার স্মরণ করে। অনেকে ভুলবশত এই দিনটিকে ‘শবদাহের দিন’ ধরে নিয়ে মাছ-মাংস খান, যা ধর্মীয় দৃষ্টিতে অনুচিত। কারণ, এই দিনটি একান্তভাবে শ্রদ্ধা, অন্তেষ্টিক্রিয়া ও পূর্বপুরুষদের স্মরণের দিন।

এই দিন ভোরে ব্রাহ্ম মুহূর্তে স্নান, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, গীতাপাঠ, ভগবানের নামকীর্তন ও দান-ধ্যানের মাধ্যমে দিন শুরু করা উচিত। কারণ, এই দিন স্বর্গের দেবতারা এবং পিতৃপুরুষরা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন—তাঁদের পুজো ও শ্রাদ্ধ করলে অশেষ পুণ্য লাভ হয়। ভীষ্মদেবের মহাপ্রয়াণের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে পৌষ সংক্রান্তি সনাতন ধর্মে এক গম্ভীর ও গৌরবময় তাৎপর্য অর্জন করেছে, যা আত্মিক উন্নতির পথপ্রদর্শক হিসেবে চিহ্নিত।

পৌষ সংক্রান্তি কিছু আচার অনুষ্ঠান

পৌষ সংক্রান্তির সময় বাংলা ঘরগুলোতে খুশির উৎসব চলতে থাকে। সকালে স্নান করে অনেকেই সূর্যদেবকে জল, ফুল আর চিঁড়া-দই দেন। অনেকে গঙ্গাস্নান করতে যান, পাপ মাফের আশা নিয়ে। গ্রামে গ্রামে মেলা বসে, যেখানে লোকের ভিড় থাকে, হাতে তৈরি জিনিস আর মিষ্টি খাবার কেনার জন্য।

এদিন নারীরা সকালে পিঠে বানান, যেমন পাটিসাপটা, দুধপুলি, চিতই, সেমাই পিঠে। ধান ভেঙে চিঁড়া তৈরি করা আর নতুন গুড় দিয়ে রান্না করাও বিশেষ কাজ। অনেকেই পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেন। নতুন ধানের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে ধন্যবাদ জানানোরও রীতি আছে। পৌষ সংক্রান্তির আচারগুলি কৃতজ্ঞতা, পবিত্রতা আর পরিবারিক সম্পর্কের জমজমাট একটি ছবি তৈরি করে।


 এ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর... 

Q: পৌষ সংক্রান্তি কেন পালন করা হয়?

A: পৌষ সংক্রান্তি পালন করা হয় সূর্যদেবের দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়ণের যাত্রার শুরু হিসেবে। এই দিন থেকে সূর্যের উত্তরগমন শুরু হয়, যার মানে দিনের সময় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। হিন্দু ধর্মে এইসময়টাকে খুবই পবিত্র ও শুভ বলে মনে করা হয়, আর এই সময়ে যেকোনো ধর্মীয় কাজ, দান অথবা তীর্থযাত্রা খুব ভালো ফল দেয়। পৌষ সংক্রান্তি আসলে একটা শস্য-উৎসব।

Q: পৌষ সংক্রান্তিতে কি ধরনের পিঠা তৈরি করা হয়?

A: পৌষ সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতির এক মজার উৎসব, যেখানে পিঠা বানানো হয়। এই সময় নতুন চালের গুঁড়ো, খেজুর গুড় এবং নারকেল নিয়ে নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয়গুলোর মধ্যে পাটিসাপটা রয়েছে, যেখানে নারকেল ও গুড়ের পুর চালের পাতলা রুটির মধ্যে মুড়ে দেওয়া হয়। দুধপুলি আরেকটি পছন্দের পিঠা, যেটিতে নারকেল-গুড়ের পুর দিয়ে আটা বা চালের আবরণ তৈরি করে দুধে সেদ্ধ করে। চিতই পিঠা সাধারণ হলেও সুস্বাদু, এবং এটা খেজুর গুড় বা নারকেল দিয়ে পরিবেশন করা হয়। কিছু অন্য পিঠার মধ্যে সেমাই পিঠা, সরা পিঠা, ভাপা পিঠা, কুলি পিঠা, আড়ষ পিঠা ও টিকিয়া পিঠা রয়েছে, যেগুলি অনেক পরিবারে তৈরি হয়।

মন্তব্য: পৌষ সংক্রান্তি শুধু একটা ঋতুর উৎসব নয়, এটা বাঙালি কৃষক সমাজের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এর ইতিহাস অনেক পুরনো, আর এটা আর্য ও বৈদিক সংস্কৃতির সূর্য পূজার সঙ্গে জড়িত। সূর্যের উত্তরায়ণ গমনের সময় এই উৎসব আসে, যা নতুন জীবনের শুরু এবং প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রতীক। পৌষ সংক্রান্তির অনেক রীতিনীতি আছে, যেগুলো ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। পিঠে তৈরি, বাড়িতে বাথ বা গঙ্গাস্নান, সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়া, আর নতুন ফসল নিয়ে আনন্দ উদ্‌যাপন—এসব মিলিয়ে এই উৎসব একদিকে আধ্যাত্মিক, অন্যদিকে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে একতার জয়গান করে। তাই “পৌষ সংক্রান্তি” আমাদের সংস্কৃতি স্মরণ করিয়ে দেয় এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের উৎসাহ জোগায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url