কলা বৌ কি? কেন এই পূজা দেওয়া হয়? - বাংলায় সম্পূর্ণ তথ্য

বাংলার লোকজ সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কলা বৌ পূজা। এটা আসলে দুর্গাপূজা উদযাপনের সময় এক বিশেষ আচার, যা মহালয়ার পর বা মহাষষ্ঠীর সকালে করা হয়। বাংলার বিভিন্ন বাড়ি থেকে মণ্ডপ পর্যন্ত, সবার মধ্যে এই পূজার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। কলা বৌ পূজার মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতি, শস্য আর কৃষির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা তুলে ধরে।

সজ্জিত কলা গাছ
কলা বৌ পূজার ছবি


কলা বৌ পূজা: বাংলার এক অনন্য ঐতিহ্য

আমরা অনেকটাই জানি দুর্গা প্রতিমার কাঠামোয় শুধু দেবী দুর্গা নন, আরও কিছু দেব-দেবীর চিত্রও থাকে। দেবী দুর্গার বাম দিকে দেবী সরস্বতী এবং কার্তিক। ডান দিকে দেবী লক্ষ্মী আর গণেশ। ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আকারে আছেন শিব, যিনি দেবী দুর্গার স্বামী। তাই দেবী দুর্গাকে শিবানী বা শিবের স্ত্রী বলেও ডাকেন। গণেশের পাশে থাকে 'কলা বৌ', আর অনেকেই মনে করেন এই কলা বৌ গণেশের বউ।

এটা সত্যি নয়। আসলে আমরা এখানে যে কথা বলছি, সেটা হলো কলা বৌ। কলা বৌ শুধু একটা কলা গাছ নয়। এতে আরো নয়টি উদ্ভিদ আর লতা-বৃক্ষ আছে। তাই এর আসল নাম 'নবপত্রিকা'। নবপত্রিকা মানে হলো নয়টি উদ্ভিদের সমাহার যথা-কলা (প্রধান),  কচু, হরিদ্রা (হলুদ), যব, জয়ন্তী,  বিল্ব,  দাড়িম,  অশোক,  ধনিয়া।

 শাস্ত্রে বলা হয়েছে :

‘রম্ভা কচ্চী হরিডা চ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ।

অশোকো মানকচে¦ব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা\’

অর্থাৎ অনেক লোকের কাছে গল্প আছে কলাগাছ, কচুগাছ, মানকচু, হলুদ গাছ, জয়ন্তীর ডাল, বেল, ডালিম গাছ, অশোক ফুলের গাছ আর ধানগাছ এসব নিয়ে । শাস্ত্র অনুযায়ী গাছপালা দেবতাদের শোভা বলে মনে করা হয়। কলা বৌ নিয়ে অনেক রকম প্রচলিত কথাবার্তা আছে। অনেকেই জানেন, কলা বৌ হলেন গণেশের স্ত্রী।

কলা বৌ কি?

‘কলা বৌ’ মানে কলাগাছের তৈরি বউ। এটা এক রকম কলাগাছের কাণ্ড, যেটাকে কিছু নিয়মে স্নান করিয়ে শাড়ি পরানো হয়। অনেক মানুষ এটাকে ‘নবপত্রিকা’ বলেও চেনে, কারণ কলাবৌ-এর সঙ্গে কিছু পবিত্র গাছের পাতা বেঁধে দেবী দুর্গাকে পূজা করা হয়। কলা বৌ বলতে আমরা কলা গাছকে নববধূর মতো সাজিয়ে পূজা করার প্রথা বুঝি। এই প্রথায়:


1. একটা কলা গাছকে লাল শাড়ি পরিয়ে সাজানো হয়,
2. গাছটিকে সিঁদুর দেওয়া হয়,
3. নববধূর মতো অলংকার আর মাথায় মুকুট পরিয়ে সাজানো হয়।


কলা বউ পূজার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

আমাদের সমাজে হাস্যরসাত্মক বহু গল্প প্রচলিত আছে, কিন্তু কলাবৌয়ের ধারণা মূলত মা দুর্গার সর্বত্র বিরাজমান রূপ থেকে উদ্ভূত। প্রাচীন বাংলায় দুর্গাপূজা আজকের মতো জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না। তখন সাধারণত ‘মগধেশ্বরী’র পূজা হত, যাকে স্থানীয় দুর্গারূপে পূজা করা হতো। সেই সময় বাংলার বড় একটি অংশ মগধ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মগধ ছিল এক বনাঞ্চলসমৃদ্ধ অঞ্চল, যেখানে শাক্ত এবং তান্ত্রিক উপাসনার প্রভাব ছিল প্রবল। তাই বনদেবী বা জগৎজননী মগধেশ্বরীকে কেন্দ্র করে দুর্গার পূজা প্রচলন লাভ করে। মগধেশ্বরীর পূজা সাধারণত বনভূমিতে, বিশেষ করে বটগাছের তলায় অনুষ্ঠিত হতো। আজও দেখা যায়, অনেক জায়গায় বটগাছকে শাড়ি পরানো হয়—আসলে সেটিও একপ্রকার দুর্গার আরাধনা। কোথাও কোথাও এ রূপকে ‘বনদুর্গা’ বলে অভিহিত করা হয়। সুন্দরবন অঞ্চলে বনদেবীর পূজা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। সেই এলাকায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই বনদুর্গার পূজা করে থাকেন। তাঁরা দেবীর এই রূপকে ‘বনবিবি’ নামে ডাকেন। সর্বোপরি, কথা যখন উঠেছে, তখন এটুকু না বললেই নয়—কলাবৌয়ের ধারণা, দুর্গার নানা রূপ এবং গ্রামীণ বাংলার পূজাপদ্ধতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

সুন্দরবনের প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, সুন্দরবনের রাজা দক্ষিণরায় আসলে একজন রাক্ষস, যিনি বাঘের আকারে মানুষের উপর আক্রমণ করেন। তাঁকে সামলানোর জন্য শুধু বনবিবি সক্ষম। এজন্য হিন্দু-মুসলিম সবাই বনবিবির পূজা করে। ডিপ ফরেস্ট থেকে বেরিয়ে আসা যাক জনবহুল জায়গায়। এখানে মা দুর্গা মানুষের জন্য রক্ষাকারী। এখন তিনি খাবার আর ফসলের মধ্যে আছেন। মানুষ তাকে ধন্যবাদ জানাতে আর জীবিকার জন্য দেবীকে অনেক জায়গায় পূজা করতে শুরু করেছে। আর ধীরে ধীরে সেই ছোট দুর্গাপূজাটি রাজবাড়ীর আঙ্গিনায় চলে এসেছে। তবে দেবী প্রকৃতি এখনও আগের মতোই রয়ে গেছেন। এখন তিনি সবার পরিচিত দেবী। যদিও কোনও বইয়ে খুঁজে পাওয়ার মতো উল্লেখ নেই, নবপত্রিকা বাংলার পুরনো একটি ঐতিহ্য। দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীর সকালে, এখনও মানুষ প্রথামতো জল দিয়ে মা দুর্গাকে পূজা মণ্ডপে নিয়ে আসেন।

নবপত্রিকা: প্রকৃতির ৯টি প্রতীক

মানব সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন হল এই নবপত্রিকা। দেবী প্রকৃতির আরাধনা এখানে নয়টি বিশেষ পত্রিকা বা গাছের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

এই নয়টি পত্রিকা হলো:

কদলী বা রম্ভা: কদলী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ব্রহ্মাণী।

কচু: কচু গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কালিকা।

হরিদ্রা: হরিদ্রা (হলুদ) গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন উমা।

জয়ন্তী: জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কার্ত্তিকী।

বিল্ব: বিল্ব বা বেল গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন শিবা।

দাড়িম্ব: দাড়িম্ব বা দাড়িম গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন রক্তদন্তিকা। 

অশোক: অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা।  

মান: মানকচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা।  

ধান: ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।

এই নয় দেবী একত্রে পূজিতা হন "নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা" রূপে। তাঁদের উদ্দেশ্যে উচ্ছারিত হয় পবিত্র মন্ত্র:

"ॐ নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ"।


কলা বৌ পূজার সামাজিক তাৎপর্য

কলাবৌ পূজা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব, যা সাধারণত দুর্গাপূজার সময় উদযাপিত হয়। এই পূজা মূলত নারীদের সম্মিলিত উদ্যোগে চলে এবং এর মাধ্যমে সমাজের একতা ফুটে ওঠে। কলাবৌয়ের প্রতীক হিসেবে একটি কলাগাছকে ধরা হয়, যেটা জীবনের প্রাচুর্য এবং সুসম্পর্কের চিহ্ন।

এখানে নারীরা নিজেদের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করে এবং পরিবারের মঙ্গল কামনায় দোয়া করে। কলাবৌ পূজায় সাধারণত গান-বাজনা ও আনন্দ-উৎসব হয়, যা সমাজের মধ্যে ভালোবাসা ও সঙ্গীতের পরিবেশ তৈরি করে। এই পূজা সামাজিক সমাবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যেখানে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা একসঙ্গে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করেন। এটি পারিবারিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। সব মিলিয়ে, কলাবৌ পূজা সমাজে সহমর্মিতা ও একতার প্রতিনিধিত্ব করে।

কলা বৌ পূজার উদ্দেশ্য 

কলা বৌ পূজার উদ্দেশ্য হল জীবনের সুখ, সমৃদ্ধি এবং ফসল উৎপাদনের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা। দুর্গাপূজার অংশ হিসেবে এই পূজায় কলা গাছকে কলা বৌ হিসাবে পূজনীয় মনে করা হয়, যা দেবী দুর্গার প্রতীক। কলা বৌ পূজার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতি, গাছপালা এবং জীবন শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চাই। কৃষি-ভিত্তিক সমাজে এই পূজার উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাছাড়া, নারীদের সুখ, পরিবার ও সূশীল সমাজের শান্তি কামনাও এই পূজার অন্য উদ্দেশ্য। কলা বৌ পূজা একদিকে যেমন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তেমনি এটি সামাজিক ঐক্য ও সহমর্মিতার প্রতীকও।

এই পূজার তিনটা উদ্দেশ্য আছে:

১. সন্তান লাভের আশা: বিবাহিত মহিলারা সন্তান পেতে এই পূজা করেন।

২. গৃহশান্তি: পরিবারের মধ্যে শান্তি আর উন্নতি আসবেই এমন কামনায়।

৩. সৌভাগ্য কামনা: দাম্পত্য জীবনে সুখী থাকার জন্য।

উপসংহার: হিন্দু ধর্মের কলা বউ আসলে দুর্গাপূজার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটা মূলত একটা কলাগাছ, যা দুর্গা মায়েদের শক্তির প্রতীক হিসেবে পুজা হয়। এর মাধ্যমে প্রকৃতি এবং শস্যের পুজা করা হয়, যা কৃষি ও জীবনের সমৃদ্ধিকে বোঝায়। কলা বউ নবপত্রিকার অংশ হিসেবেও পরিচিত, যেখানে আরও আটটা পাতা বা গাছের অংশ থাকে। এই নবপত্রিকা দেবী দুর্গার নয়টি আকারের প্রতীক। কলা বউ পুজার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির জন্য ও ফসলের উৎপাদনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং সমাজে সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি কামনা করি। সাধারণত মহাষষ্ঠীর সকালে কলা বউ পুজা হয়, যা দুর্গাপূজার শুরু। এতে নারীরা বিশেষভাবে অংশ নেয়, পরিবার ও সমাজের মঙ্গল কামনায়। কলা বউ পুজা হিন্দু সমাজের ঐতিহ্য এবং পারিবারিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url