একাদশীর ব্রতকথা ও মাহাত্ম্যকে পাঠ করিলে সকল মনস্কামনা পূর্ণ হয়। একাদশীর ব্রতকথা বিভিন্ন একাদশী অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হয় (যেমন উৎপন্না, মোক্ষদা, নির্জলা, শয়নী ইত্যাদি)। তবে, ব্রতকথাগুলির মূল বার্তা একই—ভগবানের প্রতি ভক্তি ও ব্রত পালনের ফল।
একাদশীর ব্রতকথা
বৈশাখেতে কৃষ্ণপুক্ষে নাম বরুথিনী।
যাহা মোবু অতি প্রিয় বড়ু ভালোবাসি।।
মহফলদায়ী এই একাদশী ব্রত।
একাদশী স্বর্ণাদি গো-দানে যেবা হন ব্রত।।
বৈশাখের শুক্লপক্ষ যখন আসিবে।
মোহিনী একাদশী উদয় হইবে।।
ভক্তিভরে যেবা করে এই ব্রত।
তাহার সকল পাপ হয় বিদুরিত।।
জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে অপরা নামেতে।
যিনি এই একাদশী পালেন ভক্তিতে।।
অপরা ব্রতের কথা শুনে যেইজন।
সিংহসম হয় সেই শাস্ত্রের বচন।।
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু পক্ষে একাদশী হয়।
নির্জলা নামেতে তাহা আছে পরিচয়।।
সর্বশেষ্ঠ এই ব্রত শাস্ত্রেতে প্রকাশ।
ব্রতফলে সবাকার পুরে মনো আশা।।
আষাঢ় মাসেতে যবে কৃষ্ণপক্ষ হয়।
সেইকালে যে একাদশীর উদয়।।
যাহার কারণে নাহি থাকে যমভয়।
যোগিণী নামেতে তার আছে পূরিচয়।।
আষাঢ়ের শুক্লপক্ষে যে একাদশী হয়।
শয়নাকাদশী নামেতে শাস্ত্রে পরিচয়।।
এই ব্রত বিধিমত করিলে পালন।
তাহাতে মহাসুখী হইবে সর্বজন।।
শ্রাবণ মাসেতে কৃষ্ণপক্ষ যবে আসে।
কামিকা নামেতে একাদশী উপবাসে।।
এই ব্রত যেই নর এক মনে-পালে।
ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পূজা তাহে ফলে।।
শ্রাবণের শুক্লপক্ষে যে একাদশী হয়।
পবিত্র নামে খ্যাত হয় জগৎময়।।
ব্রতে পালনকারী নরকে না যায়।
অন্তিমেতে স্বর্গলোকে উপনীত হয়।।
ভাদ্র কৃষ্ণপক্ষে হয় অন্নদা একাদশী।
মহাপুণ্যপ্রদা সর্ব পাপের বিনাশী।।
যিনি এই ব্রত বিধিমত করেন পালন।
স্বজনের সহকারে স্বর্গেতে গমন।।
ভাদ্র শুক্লায় নাম ধরে পার্শ্ব একাদশী।
এই একাদশী স্বর্গ মোক্ষ প্রদায়িনী।।
এই একাদশী ব্রত পরম মঙ্গল।
ইহাতেই লভে নর অশ্বমেধ ফল।।
আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষে যে একাদশী হয়।
ইন্দিরা একাদশী তার হয় পরিচয়।।
এই ব্রত পাপরাশি করেন নিধন।
মুক্ত করেন যত অধোগামী জনু।।
আশ্বিনের শুক্লপক্ষে যে একাদশী হয়।
প্রাশাঙ্কুশা নামে খ্যাত শাস্ত্রেতে কয়।।
পিতৃকূল মাতৃকুল ও পত্নীকুলেতে।
মুক্ত দশ পুরুষ ব্রত প্রভাবেতে।।
কার্তিকে কৃষ্ণা একাদশী রমা নামেতে।
দুঃখ-পাপ বিনাশিনী বিখ্যাত জগতে।।
এই ব্রত যেইজন ভক্তিভাবে করে।
পরম সুকৃতি পায় জানিবে অন্তরে।।
কার্তিকে শুক্লপক্ষে হয় প্রবোধিনী একাদশী।
এই ব্রত পালিবে অবশ্যই নগরবাসী।।
নিষ্ঠাতে এই ব্রত করিলে পালন।
ব্রতী অবশ্যই লভিবে সর্ববিধ ধন।।
অগ্রহায়ণের কৃষ্ণপক্ষে হয় উৎপন্না একাদশী।
শ্রীহরির প্রিয় হয় এই একাদশী অতি।।
সৎপাত্রে এইদিন যেবা করে দান।
সেইজন কভু নাহি যম ঘুরে যান।।
অগ্রহায়ণে শুক্লা একাদশী তিথি।
মোক্ষদা নামে তার পাপনাশি খ্যাতি।।
ভক্তিভাবে এই ব্রত যে করে পালন।
অন্তিমে পরম ধাম পায় সেইজন।।
পৌষমাসের কৃষ্ণপুক্ষে হয় সফলা একাদশী।
এই ব্রত পালনকারীর কভু না হয় দুর্গতি।।
সফলা একাদশী যে করে পালন।
যশ ও মুক্তি তার থাকিবে বন্ধুন।।
পৌষের শুক্লপক্ষে যে একাদশী ব্রত।
পুত্রদা নামেতে হয় জগৎ বিখ্যাত।।
পুত্রদাত্রী হয় এই শ্রীপুত্রদা ব্রত।
অশ্বমেধ ফল পালনেতে বিধিমত।।
মাঘী কৃষ্ণা একাদশী তিলা নামে।
পাপরাশি নষ্ট হয় তাহার পালনে।।
ষটতিলা ব্রত যেবা করে পালন।
তাহার সকল পাপু হয় বিনাশন।।
অতএব আমলকী একাদশী ব্রত।
অভীষ্ট পূরণ হয় বাঞ্ছা যে যাহার।।
শুক্লা চৈত্রে হয় কামদ্য একাদশী।
পুত্রদানকারী আর সর্বপাপ নাশী।।
সর্বপাপনাশী হয় শ্রীকামদা ব্রত।
পালনকারীর হয় পূর্ণ মনোরথ।।
মাঘী শুক্লা একাদশী জয়া নাম ধরে।
দেবরাজ ব্রতীগণে নমস্কার করে।।
সকল দানের ফল এ ব্রত কারণে।
সর্বযজ্ঞ ফল প্রাপ্ত হয় ব্রতীজনে।।
ফাল্গুনী কৃষ্ণাকাদশী হয় শ্রীবিজয়া।
করই এই ব্রত শাস্ত্র বিধান মানিয়া।।
যথাবিধি পালনেতে এ ব্রত কেবল।
সম্ভব হইবে বিনাশিতে শত্রুবল।।
ফাল্গুনে শুক্লপক্ষে যেই একাদশী হয়।
আমলকী নাম হয় তার শাস্ত্রেতে কয়।।
সবাকার কল্যাণ হয় শাস্ত্র বিহিত।
কৃষ্ণা চৈত্রে একাদশী শ্রীপাপমোচনী।।
অবশ্য বিনাশে পাপ শাস্ত্র মধ্যে শুনি।
পূর্ণ হয় হয় মনোবাঞ্ছা পুণ্য বাড়ে তার।।
মলমাস মধ্যে শুকুপক্ষে একাদশী।
নাম হয় শ্রীপদ্মিনী সর্বপাপ নাশী।।
এই মহাপুণ্য ব্রত যে করে পালন।
ধুন-পুত্র লাভ হয় সদা সুখে রন।।
শ্রীপরমা একাদশী কৃষ্ণ মলমাসে।
যথাবিধি পালনেতে সর্বদুঃখ নাশে।।
ভক্তিভাবে যেবা করে এই ব্রত।
তাহে দারিদ্রতা হবে বিদূরিত।।
 |
| একাদশীর ব্রতকতা |
একাদশীর মাহাত্ম্য, ব্রতকথা ও ছন্দোবদ্ধ বর্ণনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, এই তিথিটি কেবল একটি ধর্মীয় উপবাস নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক গুরুত্বের এক অপূর্ব সমন্বয়।
এই ব্রতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শ্রীহরির প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি। ব্রতকথা অনুসারে, একাদশী দেবী স্বয়ং ভগবানের দেহ থেকে উৎপন্ন শক্তি, যা পাপস্বরূপ মুরা দৈত্যকে বিনাশ করে। এই কাহিনীর মাধ্যমে আমাদের শিক্ষণীয়—বাহ্যিক উপবাসের চেয়েও মুখ্য হলো ইন্দ্রিয় দমন এবং ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ, যা আমাদের ভেতরের পাপ বা 'দৈত্য' শক্তিকে বিনাশ করতে সাহায্য করে।
ছন্দোবদ্ধ উপস্থাপনাটি প্রমাণ করে যে, সনাতন ধর্মের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্রতটি কেবল নিয়ম-কানুনের সমষ্টি নয়, বরং এটি লোকমুখে শ্রুতিমধুরভাবে প্রচারিত হওয়ার মতো এক ঐতিহ্যবাহী গাথা। খাদ্য-শস্য বর্জনের নিয়ম এবং ভজন-কীর্তনে জাগরণের বিধান ব্রতধারীকে জাগতিক মোহ থেকে দূরে রেখে পারমার্থিক জীবনের দিকে চালিত করে।
এক কথায়, একাদশী ব্রত হলো—আত্মশুদ্ধির এক উপায়, যা ধর্মীয় অনুশাসন, পৌরাণিক কাহিনী ও ভক্তিযোগের মিশ্রণে জীবকে বৈকুণ্ঠের পথে চালিত করে।