অশুদ্ধ অবস্থায় হরিনাম জপ করা যায় কি? জেনে নিন ধর্মীয় বিধান

হরিনাম জপ বা কীর্তন হিন্দু ধর্মে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি চর্চা। অনেকেই ভাবেন, অশুদ্ধ বা অপবিত্র অবস্থায় হরিনাম জপ করা যায় কি না? এই প্রশ্নটার উত্তর পেতে হলে আগে বুঝতে হবে, আসলে হরিনাম কি এবং এর আসল গুরুত্ব কি।

অশুদ্ধ অবস্থায় হরিনাম জপ করা যায় কি
অশুদ্ধ অবস্থায় হরিনাম জপ করা যায় কি

মানুষের জীবনে অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে - শারীরিক, মানসিক বা আধ্যাত্মিক। কিছু লোক মনে করেন যে পরিষ্কার না থাকলে বা অন্যভাবে খারাপ অবস্থায় হরিনাম জপ করা উচিত না। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, এই ধারণা ভুল। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, হরিনাম সব পাপকেই মিটিয়ে দিতে পারে। তাই পাপের অবস্থাতেও বেশি করে হরিনাম জপ করা উচিত। নামই মানুষকে পাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। শরীরে কেউ যদি অপরিচ্ছন্ন থাকে, তবুও হরিনাম জপ করা যায়। তবে পরিষ্কার হয়ে নামজপ করা হলে ভালো।


অশুদ্ধ বা অশুচি অবস্থায় হরিনাম জপ করলে লাভ না ক্ষতি? ধর্মীয় মত অনুযায়ী সঠিক ব্যাখ্যা

অনেকেই প্রশ্ন করেন—"আমি যদি অশুচি বা অশুদ্ধ অবস্থায় থাকি, তাহলে কি হরিনাম জপ করা উচিত? এতে লাভ হবে নাকি ক্ষতি?"

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই আমরা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে। চলুন ধর্মীয় মত ও শাস্ত্রবাণীর আলোকে জেনে নিই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।

এই কলিযুগে, মানুষ দৈহিক, মানসিক, ও বাকগত নানা কারণে প্রায়শই কোনও না কোনওভাবে অশুদ্ধ অবস্থায় থাকেই। কিন্তু কলিযুগের ধর্ম হলো শ্রীহরির নামসংকীর্তন—যা সকল পাপ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।

শ্রীস্কন্দ পুরাণে স্পষ্ট বলা হয়েছে

"ন দেশকালাবস্থাসু শুদ্ধ্যাদিকমপেক্ষতে।

কিন্তু স্বতন্ত্রমেবৈতন্মান কামমিতকামদম।।"

অর্থাৎ, শ্রীহরির নাম কীর্তনের জন্য দেশ, কাল, অবস্থা, বা শুদ্ধতার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। হরিনাম স্বয়ং সিদ্ধ, সর্ব অভীষ্টফল প্রদানকারী, এবং অন্য সকল আচারের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

শ্রীমদ্ভাগবত এবং বৈষ্ণব আচার্যদের মতে: কলিযুগে হরিনামই প্রধান ধর্ম। অশুচি অবস্থায় নাম জপ নিষেধ নয়, বরং অশুচিতা থেকে মুক্তির জন্য নাম জপ করা হল শ্রেষ্ঠ উপায়।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন: হরিনামে সব শক্তি রয়েছে।

শ্রীজীব গোস্বামী বলেন: নাম জপের জন্য শুচিতা দরকার নেই, কারণ নামই আমাদের শুচি করে।

 শ্রীস্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে—কোনও সময়, স্থান বা শারীরিক অবস্থার প্রয়োজন নেই। নাম নিজেই স্বতন্ত্র এবং ফলদায়ক।

তাই মনে রাখতে হবে—শরীর বা পরিবেশের কোনও অশুদ্ধতা হরিনামের পবিত্রতাকে কখনও ক্ষুণ্ণ করতে পারে না। বরং "হরিনামবিহীন অবস্থাই" প্রকৃত অশুচিতা, কারণ শাস্ত্র মতে হরিনামহীন জীবনই সর্বাপেক্ষা অকল্যাণকর।

অপবিত্র শরীর, অশুচি অবস্থা এবং গণনা ছাড়াও কি মন্ত্র জপ করা যায়? শাস্ত্র কী বলে?

আপনি যখন অপবিত্র শরীরে থাকেন, তখন কোনো মন্ত্র জপ করতে পারবেন না। মন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, গণনা ছাড়া জপকে বলা হয় রাক্ষসী জপ। তাই, মন্ত্র জপের আগে ভালোভাবে স্নান করুন এবং পরিষ্কার কাপড় পরুন। অন্যথায়, আপনার চেষ্টা বৃথা যাবে। 

ভগবানের মন্ত্রও আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মন্ত্র, যেমন হরে রাম, হরে কৃষ্ণ, গণনা ছাড়া যেকোনো জায়গায় জপ করা যায়, এমনকি আপনি যদি অশুদ্ধও হন। তবে, এই নিয়ম সব মন্ত্রের জন্য প্রযোজ্য নয়। 

অন্যদিকে, শিব, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, রামসহ অন্যান্য দেবতার নাম আপনার অশুদ্ধ অবস্থায় উচ্চারণ করতে পারেন। কিন্তু কিছু মন্ত্রের জন্য নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা বা শুদ্ধতা প্রয়োজন।

যদি আপনি কোনো গুরু থেকে বীজ মন্ত্র গ্রহণ করেন, তাহলে সেটি সব সময় জপ করতে পারবেন। যেকোনো পাপ সেখান থেকে গুরু বা সদগুরু নিয়ে নেবেন। তবে, জপ করার আগে অবশ্যই আপনার গুরু বা সদগুরুর কাছে জানতে হবে।

পন্ডিতদের মতবাদ: অশুদ্ধ অবস্থায় কৃষ্ণ নাম জপ

বহু পন্ডিত, আচার্য, ও বৈষ্ণব গুরুদের মতে, অশুদ্ধ অবস্থায় কৃষ্ণ নাম জপ করা ঠিক আছে। তারা বলেন এটা শাস্ত্রের ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে। নিচে কিছু পন্ডিতদের মতামত ও তাদের যুক্তিগুলো আলোচনা করা হলো যাতে বিষয়টি সহজে বুঝতে পারেন:

আধুনিক বৈষ্ণব পন্ডিতদের মত: অনেকে, যেমন ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর ও ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ (ISKCON), বলেন—“অশুচি অবস্থায় কৃষ্ণ নাম জপ শুরু করো, নামই তোমাকে শুচি করবে। শুচি হতে অপেক্ষা করলে কখনোই শুরু করা হবে না।” হরিনাম জপে বাধা নেই, বরং নাম জপের মাধ্যমেই শুচিতার শুরু।  শুচিতা মন্ত্রজপের আদর্শ, কিন্তু অশুচিতে নাম জপে কোনও বাধা নেই। কৃষ্ণ নাম শুদ্ধ ও চৈতন্যময়, এবং শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা নিয়ে জপ করলে সব ভালো হয়।

অশুদ্ধ অবস্থার মানে কী?

বিভিন্ন ধর্মীয় শাস্ত্রে অশুদ্ধ অবস্থার মূলত এই অর্থ:

- মলমূত্র বা প্রস্রাবের আগে বা পরে থাকা।

- খাবার খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ না যাওয়া।

- অমোচনীয় বা অশুদ্ধ কাজের পর থাকা।

- ধোয়া বা স্নান না করে থাকা।

- আর কোনো পবিত্রতার অভাব থাকা।


অশৌচকালে গৃহদেবতার পূজার্চনা করা যাবে কি না?

বৈষ্ণব মতে, অশৌচ বা শ্রীহরির পূজার নিয়মের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। স্মার্তপদ্ধতিতে মৃত্যু বা জন্মের সময় ‘অশৌচ’ পালন করতে হয়, কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মে এই বিষয়ে ভিন্ন ধারণা রয়েছে। স্মার্ত মতে, কিছুদিন গৃহদেবতার পূজা বন্ধ রাখা হয়, কিন্তু বৈষ্ণব আচার অনুসারে শ্রীবিষ্ণুর পূজা কখনো বন্ধ হয় না—জন্ম বা মৃত্যুর সময়েও নয়। কারণ, বৈষ্ণবেরা হরিনামে দীক্ষিত এবং বিষ্ণুর ভক্ত।

যেসব বাড়িতে নিয়মিত বিষ্ণু আরাধনা, নামকীর্তন ও পূজা চলে—সেখানে জন্ম এবং মৃত্যু আশীর্বাদ হিসেবে ধরা হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, শ্রীহরির নাম স্মরণ করলেই অশুচিতার সমাপ্তি ঘটায়। এই কারণে সমাজে জন্ম-মৃত্যুর সময়ে শঙ্খধ্বনি বা হরিধ্বনি প্রচলিত আছে, যেটা কেবল আচার নয়, বরং অশুচি মানসিকতারও প্রতিকার করে।

শাস্ত্রবাক্যে প্রমাণ:

 বৃহন্নারদীয় পুরাণ-এর অদিতি-মাহাত্ম্যে শ্রীল সূত গোস্বামী বলেন: "যত্র পূজাপরো বিষ্ণোস্তত্র বিঘ্নো ন বাধতে।

রাজা চ তস্করশ্চাপি ব্যাধয়শ ন সন্তি হি।।

প্রেতাঃ পিশাচাঃ কুষ্মাণ্ডা গ্রহ বালগ্রহাস্তথা।

 ডাকিন্যো রাক্ষসাশ্চৈব ন বাধন্তে হচ্যুতার্চকং।।"

  অর্থাৎ, যেখানে বিষ্ণুভক্ত পূজার্চনায় নিয়োজিত থাকেন, সেখানে কোনও রাজা, চোর, রোগ, ভূত, পিশাচ, গ্রহ, বা অশুভ শক্তি বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না। শ্রীহরির পূজক সর্বদা সুরক্ষিত

শাস্ত্রবাক্যে বলা হয়েছে, যেখানে বিষ্ণুভক্তি নিয়োজিত থাকে, সেখানে কোনও অশুভ শক্তি বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না। তাই বৈষ্ণব ভক্তরা সব সময় সুরক্ষিত থাকেন। শ্রীবিষ্ণুর পূজা নিয়মিত করা উচিত, কারণ এটি পুণ্যজনক। শ্রীবাস ঠাকুরের পুত্রের মৃত্যুর সময়েও কখনো হরিনামের কীর্তন বন্ধ হয়নি। বরং, শোকের মধ্যেও কীর্তন চলেছে। আর শ্রীল গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুরের ক্ষেত্রে, পুত্রশোকে পূজা ভুলে যাওয়ায় তিনি স্বপ্নে শ্রীগোপীনাথের বার্তা পান যে, তাঁর পূজা কখনো স্থগিত হওয়া উচিত নয়—এমনকি মৃত্যু শোকেও নয়।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)

১. খাবার খাওয়ার পরে কি সঙ্গে সঙ্গে হরিনাম জপ করতে পারি?

হ্যাঁ, অবশ্যই পারবেন তবে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া ভালো। মুখটা ধুয়ে নিতে পারেন।


২. প্রস্রাব বা মলত্যাগের পর কি তাড়াতাড়ি জপ করা যাবে?

শরীর এবং মন পুরোপুরি পরিষ্কার না হলে অপেক্ষা করা ভালোতাতে ছিল অসংখ্য সাদা ক্রস মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি এগুলো শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের সমাধি।


৩. হঠাৎ কোনো অশুদ্ধ অবস্থায় জপ করতে হলে কি করব?

যদি মনে ভক্তি থাকে, তবে ঈশ্বর তা গ্রহণ করেন। পরে শুদ্ধ হয়ে নিয়ম মেনে চলুন।


পরিশেষে বলা যায়, অশুদ্ধ অবস্থায় কৃষ্ণ নাম জপ করা খুব ভালো ও উপকারি। ভগবানের নাম নিজেই শুদ্ধ, তাই নাম জপ করলে অশুদ্ধি দূর হয়। শাস্ত্রে বলা আছে, নাম আখণ্ড — নামের মধ্যে সব শক্তি আছে। যে কেউ অশুদ্ধ অবস্থায়ও হৃদয় থেকে নাম নিয়ে ভালো ফল পায়। নাম জপের জন্য শুদ্ধ হওয়া বাধ্যতামূলক নয়, বরং শুদ্ধতা পেতে এই নাম জপ করা একটা উপায়। অচেতন অবস্থায়ও কেউ ‘হরি’ বললে তার পাপ মিটে যায়। ভক্তির গুরুত্ব বেশি, বাহ্যিক শুদ্ধতা কম। তবে চেষ্টা করে যতটা সম্ভব শুদ্ধ থেকে নাম জপ করা ভালো। নাম জপের মাধ্যমে শুদ্ধতা আসে এবং আত্মশুদ্ধির পথ খুলে যায়। তাই সংকোচ না করে, সব অবস্থায় ভগবানের নাম জপ করুন। যেহেতু সৃষ্টিকর্তা হলেন অসীম মনের অধিকারী তাই অশুদ্ধ অবস্থায়ও তার নাম জপ করলে তিনি হয়তোবা কিছু মনে করবেন না আসুন আমরা সকল কাজে হরিনাম জব করি এবং হরি প্রেমে পাগল হয়ে যায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url