হিন্দু ধর্মে পশু বলি
শাস্ত্রে যে সকল পুজোয় পশুবলির কথা উল্লেখ রয়েছে আসলে সেই পুজোগুলোতে সত্যিকারের পশুকে বলি করার কথা বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে আমাদের কাম, ক্রোধ, হিংসা, লোভ প্রভৃতি কামনা গুলোকে বলি দেওয়ার জন্য। তাছাড়া মহাঙ্গানী শ্রীশঙ্করাচার্য বলেছেন "জীব ব্রম্মইব নপর" অর্থাৎ জীব ব্রম্ম ছাড়া কিছুই নয়।
পশু বলি কেন দেওয়া হয়?
পশু বলি মূলত ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত কারণে দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পশু বলির ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য রয়েছে। নিচে এর কিছু মূল কারণ তুলে ধরা হলো:
১. ধর্মীয় কারণ:
হিন্দু ধর্ম: অনেক হিন্দু সম্প্রদায় দেব-দেবীর সন্তুষ্টির জন্য পশু বলি দেয়। বিশেষত কালীপূজা, দুর্গাপূজা ও অন্যান্য শাক্ত সম্প্রদায়ের উপাসনায় পশু বলির প্রচলন দেখা যায়। এটি বিশ্বাস করা হয় যে বলির মাধ্যমে দেবতাদের সন্তুষ্ট করা হয় এবং তারা ভক্তদের আশীর্বাদ প্রদান করেন।
২. সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত কারণ:
অনেক সমাজে পশু বলি একটি পুরনো ঐতিহ্য যা শতাব্দী ধরে চলে আসছে। কিছু আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসের অংশ হিসেবে দেখা হয়।
৩. শুভ শক্তি আহ্বান ও অশুভ শক্তি নিবারণ:
কিছু সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে পশু বলির মাধ্যমে অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করা যায় এবং সমাজে সুখ-সমৃদ্ধি আনা সম্ভব হয়। এটি অনেক সময় দুর্ভাগ্য দূর করার বা বিশেষ সংকট মোকাবিলার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
৪. আনন্দ ও সম্প্রদায়বদ্ধতা:
অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পশু বলির মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ এবং সামাজিক সংহতির সৃষ্টি হয়।
ধর্মে পশু বলি |
হিন্দু ধর্মে পশু বলির তাৎপর্য?
পশু বলির তাৎপর্য ও কারণ
১. অশুভ শক্তি বিনাশ ও শুভ শক্তির বিকাশ
অনেক বিশ্বাস অনুযায়ী, পশু বলি অপশক্তির বিনাশ এবং দেবতার আশীর্বাদ লাভের মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। তামসিক শক্তির ত্যাগ বলিদানের মাধ্যমে ভক্তরা তাদের মোহ, কামনা ও তামসিক প্রবৃত্তি ত্যাগ করেন বলে মনে করা হয়।
যজ্ঞ ও বৈদিক প্রভাব
প্রাচীন বৈদিক যজ্ঞেও পশুবলি প্রচলিত ছিল, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন পুরাণ ও শাস্ত্রে স্থান পেয়েছে।
অনেক ভক্ত বিশ্বাস করেন, দেবতার প্রতি চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে বলি দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পশুবলির পক্ষে ও বিপক্ষে কিছু শ্লোক বা উক্তি বর্ণনা করা হলো:
যারা পশুবলির পক্ষে বা বিপক্ষে মত দেন, তারা প্রায়শই নিজস্ব মতবাদ প্রচারে ব্যস্ত। আমি সংক্ষেপে বিষয়টির মর্ম উন্মোচন করতে চাই। এখানে মূলত দুটি দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান – হিংসা ও অহিংসা। অনেকেই বলিকে কেবল হিংসার চোখে দেখেন। কিন্তু মহাশয়, আপনার দৈনন্দিন জীবন কি বলিবিহীন? একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন। প্রতিটি জীবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বলির সাথে জড়িত। পরমেশ্বর যেমন আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তেমনি প্রতিটি প্রাণীকে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা দিয়েছেন। এই জীবন চক্রেই নির্ধারিত হয়েছে কে খাদ্য হবে আর কে খাদক। আপনি মাছ-মাংস খান বা শাকসবজি – প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো প্রাণের বলি দিতে হয়। এমনকি উদ্ভিদও প্রাণবান, তাদের ছেদন করেই তো আমরা খাদ্য পাই। এখন প্রশ্ন – আপনি কোন অধিকারে এসব প্রাণ হত্যা করে খাদ্য গ্রহণ করেন? তাদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। উত্তরটি সহজ – ভগবানই আমাদের বাঁচার জন্য এই খাদ্যশৃঙ্খল সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু শাস্ত্রমতে, এই গ্রহণ তখনই পাপমুক্ত হয় যখন তা যথাযথভাবে উৎসর্গীকৃত হয়। আমরা দেবতাকে নিবেদন করে যে বলি দিই, তা পুনরায় প্রসাদরূপে গ্রহণ করি। সনাতন ধর্মে বলিকে পঞ্চমহাযজ্ঞের অন্তর্গত করা হয়েছে। শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের আদেশে যুধিষ্ঠিরসহ অসংখ্য রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ করে ছেন,যার পূর্ণাহুতিতে অশ্ববলি প্রদান করা হতো। আমাদের ঋষি-মুনিরা যুগ যুগ ধরে এই বিধান রেখে গেছেন। বলি বিরোধী দের যুক্তি অনুযায়ী মনে হয়, আমাদের প্রাচীন ধর্মগুরুদের জ্ঞানই অসম্পূর্ণ ছিল! কলিযুগে আপনারা সবাই অবতার হয়ে তাদের 'ভুল' ধরিয়ে দিচ্ছেন। আমি মনগড়া কিছু বলছি না – শাস্ত্র ও যুক্তির সমন্বয়ে এই সত্য উপস্থাপন করছি। নিম্নে এর শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা প্রদান করা হলো।
১. বিষ্ণু সংহিতায় উল্যেখ আছে→
"যজ্ঞার্থং পশবঃ সৃষ্টা স্বয়মেব স্বয়ম্ভুবা।
যজ্ঞোহি ভূত্যৈ সর্ব্বস্য তস্মাদ যজ্ঞে বধোহবধঃ।।"
অর্থাৎঃ-স্বয়ং ব্রহ্মা যজ্ঞ সম্পাদনের জন্যই পশু সৃষ্টি করেছেন, আর যজ্ঞ সর্বসাধারণের হিতার্থে প্রতিষ্ঠিত। তাই যজ্ঞের জন্য পশুবলি দিলে তা বধজনিত পাপ থেকে মুক্ত।
২. বলিপ্রদান দ্বারা মুক্তি ও স্বর্গলাভ হয়, এবং নৃপতিগণ এর মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
"বলিভিঃ সাধ্যতে মুক্তির্ব্বলিভি:
সাধ্যতে দিবং।
বলিদানেন সততং জয়েচ্ছত্রূন্নৃপান্নৃপঃ।।
(কালিকা পুরান৬৭/৬)
৩.উল্যেখ আছে নীতিশাস্ত্র যেআহবেষু মিথোহন্যোন্যং জিঘাংসামহীক্ষিত যুদ্ধমানা পরংশক্ত্যা স্বর্গযান্ত্যপরাঙ্মুখা।
যজ্ঞেষু পশবো ব্রাক্ষণহন্যন্তে সততং দ্বিজৈ সংস্কৃতা কিল মন্ত্রৈশ্চ তেহপি স্বর্গমবাপ্নুবন্।।
অর্থাৎঃ যেমন একজন রাজা বা ক্ষত্রিয় যখন ধর্মযুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের সঙ্গে সংগ্রাম করেন, এবং যুদ্ধ করতে করতেই মৃত্যু বরণ করেন, তখন তিনি স্বর্গলোকে গমন করেন—ঠিক তেমনি, একজন ব্রাহ্মণ যখন বিধি মেনে মন্ত্রোচ্চারণসহ যজ্ঞে পশুবলি দেন, তখন তাতেও স্বর্গ লাভ হয়। এইভাবে, যজ্ঞের আয়োজনকারীও দেবতাদের আশীর্বাদ লাভ করে এবং আত্মার উন্নতিতে উচ্চগতি প্রাপ্ত হন। সুতরাং, যেমন ধর্মসম্মত যুদ্ধে শত্রু বধকে একমাত্র হিংসা বলা যায় না, তেমনি বিধিবদ্ধ যজ্ঞে পশুবলিও কেবল হিংসার কাজ হিসেবে গণ্য হয় না। কারণ এই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী, এমনকি বলিদানকৃত প্রাণীও, পরবর্তী জন্মে উন্নতি ও আশীর্বাদ লাভ করে।
৪. একটি শ্লোকে বলেছেন আদি পিতা মনু বলেছেন→
"যা বেদ বিহিতা হিংসা নিয়তাস্মিংশ্চরাচরে।
অহিংসামেব তান্বিদ্যাদ্বেদাদ্ধর্ম্মোহি নির্ব্বভৌ।।৫/৪৪
বেদই ধর্মের মূল উৎস ও প্রকাশস্থল। অতএব, বেদানুসারে এই চরাচর জগতে জীববধের যে বিধান বিদ্যমান, তা প্রকৃতপক্ষে অহিংসারই অন্তর্গত জ্ঞান করতে হবে। অর্থাৎ, এতে বধজনিত কোনো পাপ স্পর্শ করে না।
৫. বশিষ্ঠ সংহিতার ৪র্থ অধ্যায়ে উল্যেখ আছে→
"ন কৃত্বা প্রানিনাং হিংসাং মাংস মুৎপদাতে কচৎ।
ন-চ প্রাণী বধঃ স্বর্গ্য স্তষ্প্রাদ যাগে বধো ই বধঃ।।"
অর্থাৎঃ প্রাণীহিংসা না করলে মাংস উৎপন্ন হয় না, আবার সাধারণভাবে প্রাণীবধ স্বর্গপ্রদানকারী নয়। এই কারণে, যজ্ঞের নিমিত্তে যে বধ সংঘটিত হয়, তা প্রকৃতপক্ষে 'অবধ' বা অহিংসারই পর্যায়ভুক্ত। অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল— স্বর্গলাভ।
৬. দেবীভাগবত পাঠক্রমে জানা যায়→
"দেব্যগ্রে নিহতা যান্তি পাশবঃ স্বর্গমব্যয়ং।
ন হিংসা পশু জাতত্র নিঘ্নতাং তৎকৃতেহনঘ।।"
অর্থাৎঃ-হে অনঘ,,দেবীর সম্মুখে যে পশুকে নিধন(বলি প্রদান) করা যায়,,,সেই সমস্ত পশু অক্ষয়।স্বর্গলাভ করে এবং সেই হনন হিংসা নয়।যজ্ঞে প্রত্যক্ষ পশুবধ দেখা যায়,,সেই বধ অহিংসা।।
এই সত্যটি হৃদয়ে ধারণ করুন – যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে এটা উপলব্ধি করবে, সে কখনই পশুবলির পথে পা বাড়াবে না।
হিন্দু ধর্মে পশু বলি একটি প্রাচীন ও বিতর্কিত প্রথা, যা মূলত শক্তি উপাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত, যেখানে দেবী কালী, দুর্গা বা অন্যান্য শক্তির দেবীদের তুষ্ট করার জন্য পশু বলি দেওয়া হয়। তবে এই প্রথার তাৎপর্য এবং গ্রহণযোগ্যতা অঞ্চল ও সম্প্রদায়ভেদে ভিন্ন হতে পারে।
আধুনিক যুগে পশু বলির বিতর্ক ও বিকল্প
বর্তমানে অনেক মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পশু বলির পরিবর্তে কুমড়ো, আখ, নারকেল ইত্যাদি বলি দিয়ে প্রতীকীভাবে প্রথা পালন করে। অনেক সমাজে পশু বলি নিষিদ্ধ বা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, এবং অহিংস উপাসনার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বেদান্ত ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাবে অনেক হিন্দু সম্প্রদায় নিরামিষ খাদ্যের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।
বর্তমানে, পশু বলি নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কও রয়েছে, বিশেষত নৈতিকতা ও পশু-অধিকার নিয়ে। কিছু দেশ ও অঞ্চল পশু বলি নিষিদ্ধ করেছে, আবার কিছু সম্প্রদায় এতে পরিবর্তন এনে প্রতীকী বা নিরামিষ বলির প্রচলন করছে।
Comments
Post a Comment