নমস্কার না হরেকৃষ্ণ কোনটি সঠিক
"নমস্কার" এবং "হরেকৃষ্ণ" – উভয়ই সঠিক, তবে এগুলোর ব্যবহারের প্রসঙ্গ ভিন্ন।"নমস্কার" একটি সাধারণ অভিবাদন, যা হিন্দু সংস্কৃতিতে ব্যবহার করা হয়। এটি শ্রদ্ধা ও সৌজন্যের প্রকাশ।"হরেকৃষ্ণ" প্রধানত বৈষ্ণব ও ইসকন অনুসারীরা অভিবাদন বা কীর্তনের সময় ব্যবহার করেন। এটি ভগবান কৃষ্ণের নামের স্তব বা জপ।
নমস্কার বা হরে কৃষ্ণ কোনটি বলবেন? তা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। নমস্কার নাকি হরে কৃষ্ণ কোনটি আগে সেটি জানার জন্য সর্বপ্রথমে আমাদের জানতে হবে সমান কত প্রকারের এবং সেগুলো কি কি?
সম্মান পাঁচ প্রকার।
প্রত্যুথান --- কোন ব্যক্তিকে সম্মান জানানোর জন্য উঠে দাঁড়ানোকে প্রত্যুথান বলে।।
নমস্কার --- হাত জড়ো করে সৎকার করা।
উপসংগ্রহণ বা প্রণাম --- বয়জ্যেষ্ঠদের পা ছোঁয়া।
স্রাষ্টাঙ্গ --- পা, হাটু, পেট, কপাল ও হাতের সাহায্যে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে সম্মান জানানো।
প্রত্যাভিবাদন --- অভিনন্দনের বদলে অভিনন্দনের জবাব দেয়া।
নমস্কারম্ হলো পাঁচ প্রকার সম্মানের মধ্যে এক প্রকার।
![]() |
নমস্কার না হরেকৃষ্ণ |
নমস্কার কি? কাকে নমস্কার দেওয়া যাবে? কেন নমস্কার জানাতে হাত জোড় করা হয়? বৈদিক শাস্ত্র কি বলে জেনে নিন………
"নমস্তে" বা "নমস্কার" সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বৈদিক যুগ থেকে প্রচলিত একটি সম্মানসূচক অভিবাদন। এটি মূলত "নমস্" (অর্থাৎ প্রণতি) ও "তে" (তোমাকে) শব্দদ্বয়ের সংমিশ্রণে গঠিত, যার অর্থ "তোমাকে প্রণাম"। সাধারণত দুই হাত জোড় করে এই শব্দটি উচ্চারণ করা হয়, যা অঞ্জলি মুদ্রা বা প্রণাম নামেও পরিচিত। এটি ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং বিনয় প্রকাশের প্রতীক।
নমস্কার" শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে সংস্কৃত শব্দ "নমঃ" থেকে, যার আভিধানিক অর্থ হলো—"সম্মান সহকারে নত হওয়া" বা "বিনম্রভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা।
সম্প্রতি সনাতন ধর্মবিরোধী কিছু কুচক্রী গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে যে—‘নমস্কার’ শব্দটি যেহেতু ‘অবনত হওয়া’ বা আত্মসমর্পণের অর্থবহন করে, তাই সাধারণ মানুষকে নমস্কার জানানো উচিত নয়। এই বক্তব্য মূলত সনাতন সংস্কৃতির গভীরতা ও ভক্তিপূর্ণ রীতিনীতিকে অপমান করার একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।
দেখা যাক, এ সম্পর্কে বৈদিক শাস্ত্র কি বলে!
'যো দেবো_অগ্নৌ যো অপসু যো বিশ্বং ভূবনাবিবেশ য ওষধীষু যো বনস্পতি_তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ॥'(শ্বেতাশ্ব তর উপনিষদ ২-১৭)
যোগ যেমন পরমাত্মা দর্শনের উপায় বা সাধন তেমনি নমস্কারাদিও অনুরূপ বলিয়া তাঁহাকে জানাই নমস্কার।তিনি কিরুপে?তিনি দেব অর্থাত্ পরমাত্মার প্রকাশভাব। তিনি কোথায়? আছেন জলে,তৃণ -লতাদিতে, অগ্নিতে,জলে,তৃণ -লতাদিতে, অশ্বাথাদি বৃক্ষে, তিনি এই বিশ্বভুবনে অন্তর্যামীরুপে অণুপ্রবিষ্ট হইয়া আছেন। তাই যখন কাউকে নমস্কার জানানো হয় তখন মূলত সর্বজীবে অন্তর্যামীরুপে অবস্থিত পরমাত্মাকেই প্রণতি নিবেদন করা হয়, কোন মনুষ্যদেহকে নয়। সুতরাং, নমস্কার সকলকেই জানানো যায়। দুইহাত জোড় মূলত অহম্ ত্যাগ পূর্বক বিনয়ভাব প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়,কিছুটা বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায় সংস্কৃতি ভেবে। যেমন একজন সাধক যখন দেবতাকে উদ্দেশ্য করে প্রণাম করেন, তখন তিনি মাথার উপরে দুহাত জোড় করে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। আর কোনো সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতে নমস্কার জানানোর সময়, বুকে দুহাত জোড় করে অঞ্জলি মুদ্রায় পরমাত্মার প্রতি প্রণতি ও আয়ুষ্মান—অর্থাৎ দীর্ঘায়ু ও কল্যাণ কামনার বার্তা প্রদান করা হয়। ইসকনের ভক্ত হোন বা অন্য যে কেউ—যখন ‘নমস্কার’, ‘হরেকৃষ্ণ’ বা ‘রাধে রাধে’ বলেন, তখন মুখের উচ্চারণের পাশাপাশি অঞ্জলি মুদ্রা, অর্থাৎ হাতজোড় করে ভক্তিসহকারে সম্মান প্রদর্শন করাটাই আসল বিষয়। শুধু মুখে নমস্কার বললে তা যথেষ্ট নয়; যদি সেই সঙ্গে যথাযথভাবে অঞ্জলি মুদ্রা না থাকে, তবে সেটি সম্পূর্ণ ‘নমস্কার’ হিসেবে গণ্য হয় না। একইভাবে, যখন আমরা ‘হরেকৃষ্ণ’ বলি, তখন কেবল একটি শব্দ উচ্চারণ করছি না—বরং সেই সঙ্গে আমরা এই শুভাশীর্বাদটিও দিচ্ছি: “ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপা আপনার উপর বর্ষিত হোক।
হরেকৃষ্ণ বলার মাহাত্ম্যঃ
শিক্ষণীয় গল্প একসময় এক সাধু বাবা ভারতের রাজস্থানের চৈত্রি মাসের খরা আবহাওয়ায় রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন অনেকগুলি হাঁস তার পিছু পিছু একই দিকে যাচ্ছে। সাধুবাবা ও হাঁস গুলি যতদূর ই যাচ্ছে তারা কোনো নদী খুঁজে পাচ্ছিলো না। তখন হাঁস গুলি সাধুবাবা কে দেখে বললেন,হে সাধুবাবা আমরা খুবই তৃষ্ণার্ত আমরা কোনো জলের সন্ধান পাচ্ছি না। আপনি কি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাস করবেন তিনি কবে আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, নদী-নালা জলাশয় গুলা আবার কবে জলে ভরে উঠবে? তখন সাধুবাবা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ শেষ করে ভগবানের নিকট দুই হাত উঠালেন। তখন এক দৈবীবাণী এলো,''আপনি ওদের কে বলে দেন আগামী ৩০দিনে কোনো বৃষ্টি হবে না'সাধুবাবা সম্বিত ফিরে আসলে উক্ত হাঁস গুলিকে বললেন, আগামী ৩০ দিন কোনো বৃষ্টি হবে না। হাঁস গুলিএক বাক্য উচ্চারণ করলেন,''হরেকৃষ্ণ'',আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। আর এই কথাটার সাথে সাথে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হল। এরপর আকাশ থেকে শুরু হলো অবিরাম বৃষ্টিপাত। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে ইন্দ্রদেব তৎক্ষণাৎ আদিষ্ট হয়ে আকাশমণ্ডল থেকে বর্ষণ ঘটালেন—প্রকৃতির এই রহস্যময় কার্যধারা যেন স্বয়ং ভগবানের ইচ্ছার প্রকাশ। বৃষ্টির মাঝেই এক সাধুবাবা হাতে ভিক্ষার মতো করে বৃষ্টির জল ধরছিলেন এবং তা শ্রদ্ধাভরে পান করছিলেন। তাঁর পাশেই হাঁসগুলো নিচু জমিতে জমে ওঠা জলে নেমে পড়েছিল—এই দৃশ্য যেন প্রকৃতি ও প্রাণের মধ্যে এক নিরব, নিবিড় সখ্যতার চিত্ররূপ। ঠিক তেমনই, যখন কেউ হৃদয় থেকে ‘হরেকৃষ্ণ’ বলেন, তখন সেটি শুধুই একটি শব্দ নয়—তা এক গভীর আত্মনিবেদন, এক আত্মসমর্পণের ঘোষণা:
“ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাই হোক আমার ইচ্ছা।”এই বাক্য উচ্চারণের মধ্য দিয়েই ব্যক্ত হয়—ভক্ত নিজেকে পরমেশ্বরের ইচ্ছার সাথে একাত্ম করে তুলেছেন। ‘হরেকৃষ্ণ’ শব্দের আরেকটি অন্তর্নিহিত অর্থ হলো—"হরে" মানে হরণকারী, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ যেন আমার দুঃখ, পাপ, ভ্রান্তি ও অহংকার হরণ করেন। তিনি যা হরণ করবেন, তা আমার মঙ্গলেই হবে। তাই ‘হরেকৃষ্ণ’ বলা মানে কেবল এক অভিবাদন নয়, এক আত্মসমর্পণ ও শুভাশীর্বাদও বটে। অন্যদিকে, ‘নমস্কার’ শব্দটির মূল সংস্কৃত শব্দ হলো ‘নমঃ’, যার অর্থ—ভক্তিপূর্ণভাবে অবনত হওয়া বা আত্মসমর্পণ করা। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (২/১৭)-এ বলা হয়েছে, "যজ্ঞে যাঁর উদ্দেশে আহুতি প্রদান করা উচিত, তিনি হলেন পরমেশ্বর, যিনি সর্বভূতের অন্তরে বিরাজমান।" ‘নমঃ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করলে পাই: নমস্ + কৃ + আ = নমস্কার অর্থাৎ, আমি যা কিছু আছি বা যা কিছু আমার আছে—সবকিছু ভগবানের চরণে সঁপে দিচ্ছি। এই কারণেই ‘নমস্কার’ শুধুমাত্র পরমেশ্বর বা গুরুদেবকে প্রদান করা উপযুক্ত, যাঁরা প্রকৃত প্রাপ্তির যোগ্য। তবে ‘প্রণাম’ দেওয়া যায় সকলকে, কারণ সেটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের একটি সামাজিক রীতি। যারা ইসকনের দর্শন ও সাধনার পথ অনুসরণ করে, তারা জানে ‘হরেকৃষ্ণ’ শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়—এটি ভগবানের নাম উচ্চারণের মাধ্যমে একে অপরকে সম্মান ও কল্যাণকামনা জানানোর মাধ্যম। এর আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ রূপ হলো ‘রাধামাধব’—ভগবান ও ভক্তের নিখাদ মিলন। এই নাম উচ্চারণ করলে, উচ্চারক ও শ্রোতা উভয়েই পাপমুক্ত হন, এমনটাই শাস্ত্রে বলা আছে।
।। হরেকৃষ্ণ।।
তাই একে অপরকে হরেকৃষ্ণ বলে সম্বোধন করুন।🌿
Comments
Post a Comment