মহাযোগী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আবির্ভাব ও তিরোভাব

আবির্ভাব-বাংলা ১১৩৭ সাল, ইংরাজী ১৭৩০ সাল, ১৮ই ভাদ্র শুভ জন্মাষ্টমী . তিরোভাব-বাংলা ১২৯৭ সাল ১৯শে জ্যৈষ্ঠ।

ত্রিকালদর্শী মহাযোগী শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবা কলির পাপীতাপীদের উদ্ধারের জন্য ১১৩৭ বঙ্গাব্দে (১৭৩০ খ্রীঃ) জন্মাষ্টমীর দিন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট থানার স্বরূপনগর-কচুয়া গ্রামে আবির্ভূত হন। পিতা রামকানাই ঘোষাল, জননী কমলাদেবী।

লোকনাথ ব্রহ্মচারী
লোকনাথ ব্রহ্মচারী


যখন লোকনাথের বয়স এগার বছর, তখন গুরু ভগবান গাঙ্গুলী তাঁকে ও তাঁর বাল্যবন্ধু বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপনয়ন ও সন্ন্যাসদীক্ষা দেন এবং তাঁদের সঙ্গে নিয়ে গৃহত্যাগ করেন (১১৪৮) বঙ্গাব্দ, ১৭৪১ খ্রীঃ)।


প্রথমে তাঁরা আসেন কালীঘাটে, সেখান থেকেই দুই নবীন সন্ন্যাসীর সাধনারস্ত। শুরু প্রথমে শিষ্যদের নানা ব্রত পালন করতে শেখান-নক্তব্রত, একান্তরা, ত্রিরাত্রি, পঞ্চাহ, নবরাত্রি, দ্বাদশাহ পক্ষাহ ও মাসাহব্রত। অর্থাৎ সারাদিন 'উপবাস থেকে রাতে আহার, এইভাবে একদিন, তিনদিন, পাঁচদিন, বারোদিন, পনেরোদিন, শেষে টানা একমাস উপবাসের পরে আহার।


এভাবে নানা ব্রত উদ্যাপনের পর তাঁরা যান হিমালয়ে। এরপর দীর্ঘ নব্বুই বৎসর বরফের উপর কঠোর সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করলেন। এইভাবে পূর্ণ-ব্রহ্মত্বলাভের পর লোকহিতার্থে পৃথিবীর নানা দেশে পর্যটন করেন পায়ে হেঁটে। বিভিন্ন ধর্মের তত্ত্ব ও তথ্য সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে মক্কা-মদিনা সহ বিশ্বপরিক্রমা করেন। কাবুলে থাকার সময় মোল্লা-সাদীর কাছে কোরান শরীফ পাঠ করেন।


বিশ্বপরিক্রমার পর বন্ধু বেণীমাধবকে সঙ্গে নিয়ে ১৩৩ বছর বয়সে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যান (১৮৬৩ খ্রীঃ)। এখান থেকে বেণীমাধব চলে যান কামাখ্যায় আর লোকনাথ বাবা লোকহিতার্থে অবতরণ করেন সমতলে-তাঁর লীলাক্ষেত্র 'বারদী' গ্রামে।'


প্রথমে কেউই সেই সন্ন্যাসীকে চিনত না। একদিন, দুই ব্রাহ্মণ যুবকের পৈতে মারা গিয়েছিল। তারা সন্ন্যাসীর কাছে সাহায্য চাইলে, তিনি গায়ত্রী জপ করে হাততালি দেন, আর তার পরে পৈতেটা একটু অসম্ভবের মতো খুলে যায়। সেখান থেকেই চারদিকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পড়ে। সবাই তাঁকে 'বারদীর ব্রহ্মচারী' নামেই চিনতে শুরু করে।


এমন একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে আত্মপ্রকাশ করলেন-যে ঘটনা প্রতীক হয়ে রইল। হ্যাঁ, যন্ত্রযুগের জটিল জীবনযাত্রায় প্রতিমুহূর্তে মানুষের জীবনে জট লাগছে-


'লোকনাথ' মহানাম স্মরণমাত্র সেই জট খুলে যাচ্ছে-এ কথা মহাসত্য। মাঝে মাঝেই তিনি বলতেন-'আমাকে ঠাকুরের আসনে বসিয়ে তিনবেলা পুজো করার প্রয়োজন নেই। শুদ্ধ ভক্তিতে স্মরণমাত্র প্রত্যেকে আমার সাড়া পাবে।' ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের (১২৯৭ বঙ্গাব্দ) ১৯শে জ্যৈষ্ঠ ১৬০ বৎসরের পুরাতন মানবদেহ পরিত্যাগ করার ঠিক আগে সকলকে বলে যান-'আমি নেই এ কথা মনে করবি না-আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো।'


শুধু সুখের সময় নয়, 'রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিও। আমি-ই রক্ষা করিব।'-এই চিরসত্য রাণীই আজ সাধারণ মানুষের অভয়মন্ত্র।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী শুধুমাত্র একজন সাধক ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন জীবন তো আশ্রম যার করুণায় কোটি কোটি মানুষ তাদের দুঃখ কষ্ট দূর করার শক্তি খুঁজে পেত। বাবা লোকনাথের অন্তরের অন্তর স্থল থেকে উঠে আসা ভালোবাসা এবং নির্ভীকতার শিক্ষা আজও আমাদের তথা সনাতনীদের ধর্মীয় পথ দেখায়। 

শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর একটি ছবি যাঁর ঘরে আছে তাঁর কখনো অন্নের অভাব হবে না, যাঁর কাছে একটি ছবি রয়েছে তিনি যে-কোন বিপদ থেকে উদ্ধার পাবেন-এ কথা সর্বাংশে সত্য।

বাবা লোকনাথের কিছু অলৌকিক গুণ:

১. অন্তর্যামী শক্তি

বলতে হয়, বাবা লোকনাথ কারোর কোনও কথা বলার আগেই তার মনের ভাব বুঝতেন। যখন কেউ তাঁর কাছে আসত, তিনি তার কষ্ট বা সংকট বলে দিতেন এবং সাহায্য করতেন।

২. কঠিন রোগের চিকিৎসা

অনেক মানুষ ধরেন যে, বাবার আশীর্বাদে তাঁরা কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা না করতে পারলেও, বাবার দর্শন বা পায়ের ছোঁয়ায় অনেকেই সুস্থ হয়ে ওঠেন, এই কথা ভক্তরা বলে।

৩. অগ্নি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ

একবার একটা গ্রামে আগুন লাগলে, বাবা লোকনাথ সেখানে গিয়ে বললেন, “আগুন, থাম!” শুনেই ভক্তেরা বিশ্বাস করে যে, সেই সঙ্গে আগুন নিভে যায়।

৪. মৃত্যুকে বিলম্বিত করার ক্ষমতা

অনেকে মনে করেন, বাবা ইচ্ছেমতো তাঁর মহাপ্রয়াণ বিলম্বিত করতেন যাতে ভক্তেরা বিপদে না পড়েন। প্রার্থনা করলে তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেন তারপরই মৃত্যুস্বীকার করতেন।

৫. বহু স্থানে উপস্থিতি

কিছু ভক্ত দাবী করেন, তাঁরা বাবাকে একসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দেখেছেন বা অনুভব করেছেন। এটা বলা হয় যোগসিদ্ধি দ্বারা উপস্থিতি।

৬. পূর্বজন্মের কথা জানা

বাবা লোকনাথের জানা ছিল খুব গভীর। তিনি অন্যের পূর্বজন্মের পাপ-পুণ্যও বলে দিতে পারতেন।

তাঁর নামে নেই কোন মন্ত্র, নেই কোন দীক্ষা। তাঁর নাম স্মরণই মহামন্ত্র। এই মহানাম যত বেশী উচ্চারিত হবে, মানবের তত বেশী কল্যাণ হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url