শিবের মাথায় বেলপাতা ও জল ঢাললে কী লাভ হয়? (শিব চতুর্দ্দশী বিশেষ)

শিব চতুর্দ্দশীতে ভগবান শিবের মাথায় জল ও বেলপাতা অর্পণ করলে কী ফল লাভ হয়?

চতুর্দ্দশীতে জল ও বেল পাতা দিলে কি ফল লাভ হয় এবং কি  করনীয়?চতুর্দ্দশীতে বর্জনীয় বিষয় কি!
শিবের মাথায় বেলপাতা ও জল ঢালার প্রচলন হিন্দু ধর্মের একটি গভীর আধ্যাত্মিক রীতি। এর কিছু মূল অর্থ ও লাভ হলো: শিবের প্রতি গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বেলপাতা ও জল নিবেদন করা হয়। এতে ভক্ত ও ঈশ্বরের মধ্যে এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, শিবলিঙ্গে জল ও বেলপাতা নিবেদন করলে পাপক্ষয় হয় এবং আত্মার শুদ্ধি ঘটে। বলা হয়, এই সাধনায় মানসিক শান্তি, দেহের সুস্থতা ও জীবনের বিভিন্ন বাধা দূর হয়। বেলগাছকে খুব পবিত্র মনে করা হয়। বেলপাতার তিনটি অংশ (ত্রিপত্র) শিবের তিনটি শক্তিকে (ইচ্ছা, জ্ঞান, কর্ম) প্রতিনিধিত্ব করে। শাস্ত্র অনুযায়ী, শিব সহজে সন্তুষ্ট হন ("ভোলেনাথ")। তাই যারা নিষ্ঠার সাথে এই নিবেদন করে, শিব তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়।

 ব্রতকথাঃ বহু কাল আগে বারাণসী তে এক ব্যাধ ছিল।দিবারাত্রি সে শুধু জীব হত্যা করত।একদিন ব্যাধ শিকার করতে গিয়ে সারা দিনে কোন শিকার পেলোনা শেষে একটি পাখি দেখতে পেলো এবং পাখিটিকে মেরে নিয়ে যেতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো অবসেষে ব্যাধ বাড়ির দিকে রওনা হল। কিন্তু ব্যাধ কিছুটা এগোতেই রাত্রি হয়ে গেল।অন্ধকার রাত্রিতে পথ দেখা যায় না।
শিবের মাথায় জল ঢালার ছবি hd
শিবের মাথায় জল ঢালার ছবি


সে তখন একটি গাছের নিচে আশ্রয় নিল। মনে মনে ভাবতে লাগল, "সারা দিন পরিশ্রম করে সামান্য একটি পাখি পেলাম, এতে তো আমাদের দুজনের খাবারও হবে না!" এমন সময় হঠাৎ গভীর জঙ্গল থেকে হিংস্র পশুর গর্জন শুনে ভয়ে গাছের ডালে উঠে বসে পড়ল। গাছটি ছিল একটি বেলগাছ। তখন ব্যাধ মনে করল, "আজ আর বাড়ি ফেরা হবে না, রাতটা এই গাছেই কাটাতে হবে।" এইসব ভাবতে ভাবতেই তার চোখে ঘুম নেমে এল। কিছুক্ষণ পর এক দমকা বাতাসে ব্যাধের ঘুম ভেঙে গেল। ভয় পেয়ে ভাবল, "আজ হয়তো আমার মৃত্যুই হবে।" ভীত হয়ে সে তার মনের ভয় কাটাতে ভগবান শিবের শরণ নিল এবং মনে মনে 'ওঁ নমঃ শিবায়' মন্ত্র জপ করতে লাগল। মন্ত্র জপ করার ফলে তার মনে সাহস ফিরে এল। তখন ব্যাধ বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল এবং গাছের ডালে উঠে দাঁড়াল। গাছের নিচে ছিল একটি শিবলিঙ্গ। ব্যাধ গাছের ডালে নড়াচড়া করতেই শিশিরে ভেজা একটি বেলপাতা খসে পড়ে তার শরীর ছুঁয়ে সরাসরি শিবলিঙ্গের মাথায় গিয়ে পড়ল। ওই দিন ছিল শিব চতুর্দশী, আর ব্যাধ সারা দিন উপবাসী ছিল। অজান্তেই শিবের মাথায় বেলপাতা অর্পিত হওয়ায় ভগবান শিব অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। ব্যাধ কিছুই জানত না, তবুও সে শিব চতুর্দশী ব্রতের পূণ্য ফল লাভ করল। অবশেষে ব্যাধ বাড়ি ফিরে এলো। পরিবারের সকলে তার জন্য দুশ্চিন্তায় ছিল। তার স্ত্রী বাড়ির সামান্য খাবার তাকে দিল। এমন সময় এক অতিথি এলে, ব্যাধ নিজে না খেয়ে অতিথিকে সেই খাবার দিয়ে দিল। ফলে ব্যাধ সারাদিন ও সারারাত উপবাসী রইল, যার ফলে তার পূণ্য আরও বৃদ্ধি পেল। কিছুদিন পরে ব্যাধ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করল। যমদূতেরা তাকে নিতে এল, কারণ তার জীবনে অনেক পাপ ছিল। কিন্তু তখন শিবদূতরাও এসে হাজির হলেন। যমদূতরা জিজ্ঞেস করলেন, "আপনারা এখানে কেন এসেছেন?" শিবদূতরা বললেন, "সয়ং মহাদেব আদেশ করেছেন, ব্যাধকে কৈলাশে নিয়ে যেতে হবে।" যমদূতরা বলল, "ধর্মরাজ যমরাজের নির্দেশ, ব্যাধকে যমলোকে নিয়ে যেতে হবে।" এর ফলে দুপক্ষের মধ্যে একটি খণ্ড যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে যমদূতরা পরাজিত হয়, আর শিবদূতরা ব্যাধকে কৈলাশে নিয়ে চললেন। যমদূতরাও তাদের পেছন পেছন গেল। কৈলাশের দ্বারে নন্দী পাহারা দিচ্ছিলেন। যমদূতরা সব ঘটনা নন্দীকে জানাল। পরে তারা যমরাজকে গিয়ে সব খবর দিল। যমরাজ বললেন, "যে শিবভক্ত মুক্তি লাভ করে, তার উপর আমার কোনো অধিকার থাকে না। তারা শিবলোকে চলে যায়। একইভাবে যারা ব্রহ্মার ভক্ত, তারা মুক্তি পেলে ব্রহ্মলোকে যায়, আর বিষ্ণুভক্তরা মুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠে যায়। বিশেষ করে, যে শিবচতুর্দশী ব্রত পালন করে এবং যারা বারাণসীতে মৃত্যু বরণ করে, তাদের উপর আমার কোনো অধিকার থাকে না।" এই ঘটনার পর থেকে শিবচতুর্দশী ব্রতের মাহাত্ম্য চারদিকে প্রচারিত হয়। শিব হলো শক্তি শিব হলো মুক্তি, শিবের মাথায় ঢালো জল শিব তোমায় দিবে ফল" ঔঁ নমঃ শিবায়।সবার জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে।


শিবের প্রণাম মন্ত্র
"নমঃ শিবায় শান্তায় কারুণাত্রায় হেতবে,
নিবেদিতাঽমি চাত্মানং ত্বং গতিং পরমেশ্বর॥"

সরলার্থ:
যিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ, সেই শান্ত, করুণাময় শিবকে প্রণাম।
হে পরমেশ্বর! তুমিই পরম গতি। আমি নিজেকে তোমার শরণে সমর্পণ করি।

আরেকটি শিব প্রণাম মন্ত্র:
"তস্মৈ নমঃ পরমকারণ কারণায়,
দীপ্তোজ্জ্বলজ্জ্বলিত পিঙ্গললোচনায়।
নাগেন্দ্রহাররচিত কুণ্ডলভূষণায়,
ব্রহ্মেন্দ্রবিষ্ণু বরদায় নমঃ শিবায়॥"

সরলার্থ:
যিনি সকল কারণের পরম কারণ,
যাঁর উজ্জ্বল দীপ্তিময় পিঙ্গল বর্ণের চক্ষু,
যাঁর গলায় কুণ্ডলিত নাগরাজের হারের অলংকার,
এবং যিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও ইন্দ্রকে বর প্রদান করেন,
সেই পরম শিবকে আমি প্রণাম জানাই।

শিবের ধ্যান ও পূজা পদ্ধতি

ধ্যান
একটি ফুল হাতে নিয়ে (সম্ভব হলে কূর্মমুদ্রায় ধরে) ভগবান শিবের ধ্যান করবেন।
নিচে শিবের সাধারণ ধ্যানমন্ত্র ও বাণেশ্বর ধ্যানমন্ত্র দেওয়া হলো:

শিবের সাধারণ ধ্যানমন্ত্র:
"ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং
রত্নাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্।
পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং
বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্॥"

অর্থ:
চিরকাল ধ্যান করি মহাদেবের,
যিনি রৌপ্য পর্বতের মতো শুভ্র, মনোহর চাঁদ্রকলায় শোভিত,
রত্নসম অলংকরণে দীপ্তিমান, হাতে পরশু, হরিণ ও বরমুদ্রা ধারণকারী,
পদ্মাসনে আসীন, দেবতাদের দ্বারা বন্দিত,
ব্যাঘ্রচর্ম পরিধানকারী,
বিশ্বের আদিস্বরূপ, বিশ্ববীজ, সমস্ত ভয়ের বিনাশকারী,
পাঁচমুখী ও ত্রিনেত্রধারী শিব।

বাণেশ্বর ধ্যানমন্ত্র:
"ঐঁ প্রমত্তং শক্তিসংযুক্তং বাণাখ্যঞ্চ মহাপ্রভাং।
কামবাণান্বিতং দেবং সংসারদহনক্ষমম্॥
শৃঙ্গারাদিরসোল্লাসং বাণাখ্যং পরমেশ্বরম্।
ধ্যাত্বা বাণলিঙ্গং যজেত্তং পরমং শিবম্॥"

অর্থ:
প্রমত্ত শক্তি-সহযোগী, অনির্বচনীয় দীপ্তিমান, কামবাণে সমন্বিত,
সংসারের দাহনক্ষম বাণেশ্বর শিবের ধ্যান করে,
বাণলিঙ্গরূপ শিবের উপাসনা করা উচিত।

স্নান
শিবের ধ্যানের পর তাঁকে স্নান করাবেন।
শুদ্ধ গঙ্গাজল বা জল ও চন্দন মিশিয়ে, ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে শিবের স্নান করাবেন।
স্নান মন্ত্র:

"ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ॥"

এছাড়া আরেকটি মন্ত্র পাঠ করা যেতে পারে:

"ওঁ তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি
তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াত্ ওঁ।"

বি.দ্র:
 উভয় ক্ষেত্রেই একই স্নানমন্ত্র প্রযোজ্য সাধারণ শিবলিঙ্গ ও বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ।

প্রধান পূজা
স্নানের পর আবার পূর্বোক্ত ধ্যানমন্ত্র পাঠ করে শিবের ধ্যান করবেন।
তারপর মনে মনে সমস্ত উপচার (পুষ্প, ধূপ, দীপ, ফল ইত্যাদি) শিবকে উৎসর্গ করে মানসপূজা করবেন।

 👉 সবাইকে জানানোর জন্য শেয়ার করুন। ধন্যবাদান্তে- সীমা সরকার
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url