বিপত্তারিণী ব্রতকথা পাঠ | কেন পালন করা হয় এই ব্রত?
বিপত্তারিণী ব্রতকতাঃ
![]() |
বিপত্তারিণী |
অতিরিক্ত নিয়ম-ব্রতের আগের দিন হবিষ্য করতে হয়। ব্রতের দিন ব্রতকথা শুনে সেই আসনে বসেই ফল-মূল ও মিস্টার কিংবা লুচি খেয়ে উপবাস ভাঙতে হয়। লাল সুতো পুরুষদের ডানহাতে এবং স্ত্রীলোকদের বাম হাতে বাঁধবে, পুরোহিতকে ফলমূল ও যথাসাধ্য দক্ষিণা দিতে হয়। ব্রতের ফল-এই ব্রত করলে সংসারের সকল বিপদ কেটে যায়।
এ সম্পর্কে আরেকটি উপাখ্যান:
এক সময় বিদর্ভ দেশে একটি রাজা ছিল। তাঁর রানী কেমন ভক্তিমতী আর বন্ধুবৎসল। তিনি নিয়মিত বিপত্তারিণীর ব্রত পালন করতেন। এক মুচিনীর সাথে তাঁর জমজমাট বন্ধুত্ব ছিল। রানী প্রায়ই তাকে নানা ফল ও খাবার উপহার দিতেন। মুচিনী গরীব হলেও তার সদ্ব্যবহার ছিল, সে রানীকে কিছু দিতে চেয়েছিল। রানী প্রতিদিন বলতেন, একদিন তিনি তার কাছে কিছু চাইবেন, কিন্তু তা আর হয়নি।
একদিন রানী বললেন, তোমরা তো গোমাংস রান্না কর, একবার একটু নিয়ে এসো দেখব। মুচিনী খুব খুশি হলো। সে যত্ন সহকারে গোমাংস প্রস্তুত করে রাজবাড়িতে আনল। রানী সেটিকে খুব যত্নে রেখেছিলেন, কিন্তু খাবেন না, দেখবেন শুধু। কিন্তু রাজবাড়ির এক চাকর সবকিছু দেখে ফেলেছিল। সে রাজাকে সব জানিয়ে দিল। রাজা এসে রানী চেয়েছিলেন, মুচিনী কি রেখে গেছে। রানী চিন্তায় পড়লেন। তিনি মা দুর্গাকে স্মরণ করলেন। মা দুর্গা তার কাছে এসে বললেন, বিস্ময়কর, সব ফুল হয়ে গেছে। এরপর রানী রাজাকে ফুলগুলো দেখালেন। রাজা চাকরকে তিরস্কার করলেন। দুর্গার আশীর্বাদে রানীর সমস্যার সমাধান হলো। এরপর থেকে এই ব্রতের কথা সবাই প্রচার করতে লাগল।
বিপত্তারিণী ব্রতকথা পালন করার কারণ
বিপত্তারিণী ব্রত হিন্দু নারীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবির মতো পালিত একটি ব্রত, যা মূলত বিপদ থেকে মুক্তি, পরিবারের সাফল্য এবং স্বামীর দীর্ঘ জীবন কামনায় পালন করা হয়। এটি বিশেষ করে বাংলার (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ) নারীদের মধ্যে খুব প্রচলিত।
বিপত্তারিণী ব্রত পালনের উদ্দেশ্য
- বিপদ থেকে রক্ষা পেতে: জীবনের নানা বিপদের হাত থেকে বাঁচার জন্য।
- স্বামী ও পরিবারের মঙ্গল কামনা: স্বামীর দীর্ঘ জীবন ও সুখী জীবনের জন্য।
- সন্তান ও গৃহস্থ জীবনের সুস্থতা: সংসারের অশান্তি, রোগ এবং অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য প্রার্থনা।
ব্রতকথার সারাংশ
বিপত্তারিণী ব্রতের সঙ্গে একটা পরিচিত গল্প আছে। একদিন এক রাজকুমারী বিপদে পড়েন। তিনি একজন চোরের ফাঁদে পড়েন এবং মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হন। তিনি শ্রীশ্রী বিপত্তারিণী দেবীকে ডেকে ডাকেন এবং এই ব্রত পালনের প্রতিজ্ঞা করেন। দেবী তাকে মুক্তি দেন। এই অলৌকিক ঘটনার পরে অনেক নারী এই ব্রত পালন করা শুরু করেন, যাতে তাদের জীবনেও বিপদ না আসে। ব্রতকথায় দেবী নানা নারীর বিপদে আসেন এবং তাদের মুক্ত করে দেন। এজন্যই তাকে বিপত্তারিণী বলা হয়, অর্থাৎ তিনি বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।
ব্রতের দিনে যা করা হয়
এটি সাধারণত আষাঢ় মাসের মঙ্গলবার বা শনিবার পালিত হয়।
- উপবাস রাখা হয় (আংশিক বা সম্পূর্ণ)।
- হাতে লাল সুতোর বাঁধন ও নিমপাতা দিয়ে গাঁথা মালা পরে পুজো হয়।
- দেবীকে সাত প্রকার ফল, পাঁচটি মিষ্টান্ন, দূর্বা দিয়ে পুজো করা হয়।
- রাতে গল্প শুনে ব্রত সম্পন্ন হয়।
বিপত্তারিণী দেবী সম্পর্কে কিছু তথ্য
বিপত্তারিণী দেবী হিন্দু ধর্মের একজন বিশেষ দেবী, যিনি মূলত নারীদের কাছে খুব পছন্দের। দেবী ভক্তদের বিপদ ও দুঃখ থেকে রক্ষা করেন। তিনি মূলত বাংলার (বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ) উপাসনার অংশ। যদিও তাঁর উল্লেখ বড় পুরাণগুলোতে পাই না, তাঁকে অনেক সময় দুর্গা বা কালী দেবীর এক রূপ হিসেবে দেখা হয়।
দেবীর পরিচিতি
- নাম: বিপত্তারিণী (অর্থ: যিনি বিপদের অবসান করেন)
- রূপ: দুর্গার একটি লোকাচার-রূপ
- উপাসক: বেশি করে বিবাহিত হিন্দু নারীরা
- আরাধনা: আষাঢ় মাসের মঙ্গলবার বা শনিবার
- উপবাস: কিছু মানুষ উপবাস বা নিরামিষ খান
- উদ্দেশ্য: স্বামীর সুস্থতা, সংসারে শান্তি, সন্তানদের ভাল থাকা ও বিপদ থেকে মুক্তি
দেবীর প্রতীক ও চেহারা
দেবীর মূর্তি সাধারণত বেশ সহজ থাকে, অনেক সময় শুধু নিমগাছের ডাল বা পাতার দিয়ে দেবীর প্রতীক গঠন করা হয়। দেবীকে লাল শাড়ি, সিঁদুর, চুড়ি, লাল সুতোর বাঁধন দিয়ে পূজা করা হয়। পূজার সময় ফলে, পানে, নারকেল, পায়েস, চিরা-মুড়ি, মিষ্টান্ন ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।
কাহিনিসহ ধর্মীয় ব্যাখ্যা
বিপত্তারিণী দেবীর সঙ্গের সবচাইতে প্রচলিত কাহিনি হলো এক রাজকন্যার অলৌকিক রক্ষা পাওয়ার গল্প। দেবী রাজকন্যার হৃদয় থেকে আহ্বান শুনে তাঁকে রক্ষা করেন। এই ঘটনার পর নারীরা বিশ্বাস করেন যে বিপত্তারিণী ব্রত পালন করলে ভয়াবহ বিপদ এড়ানো যায়।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী:
- দুর্ঘটনা, মৃত্যু, দুর্ভিক্ষ বা রোগ থেকে রক্ষা করেন
- সংসারে সুখ ও শান্তি বজায় রাখেন
- দাম্পত্য জীবনে বোঝাপড়া ও দীর্ঘায়ু আনে
কেন এই দেবী এত জনপ্রিয়?
- গ্রামের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে থাকা — নারীদের মধ্যে গভীর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা
- সহজেই পূজা করা যায় — কোন বিশেষ মন্ত্র না জেনেও কাঠামো অনুযায়ী পূজা করা সম্ভব।
বিশ্বাস ও লোককথা
এই ব্রতটি সাধারণত পুরাণ থেকে নয়, বরং লোকমুখে প্রচলিত একটি গভীর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা ও প্রার্থনার মাধ্যমে নারীরা দেবীর কৃপা লাভে বিশ্বাস করেন।
-অথ বিপত্তারিণী ব্রতকথা সমাপ্ত-