পঞ্চ দেবতার পূজা পদ্ধতি ও মন্ত্র সমূহ

পঞ্চ দেবতার পূজা বা ৫ দেবতার পূজা এমনি পূজা,আপনি যে পুজোই করেন না কেন তার আগে বাধ্যতামুলক পঞ্চ দেবতার পূজা করতে হয়। “পঞ্চ দেবতা” শব্দটি হিন্দুধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটি পাঁচজন প্রধান দেবতাকে বোঝায় যাঁদের পূজা একসাথে বা পৃথকভাবে করা হয়, বিশেষ করে স্মার্ত ধর্মীয় ধারায়।  অনেকেই জানেন না আদি শঙ্করাচার্য এই পূজা পদ্ধতি প্রনয়ন করেছিলেন।আর সেই সময়টায় হিন্দুধর্ম নানাভাবে পিছিয়ে পড়েছিল। শঙ্করাচার্য সেই পিছিয়ে পড়া সনাতনধর্মকে আবার নতুন করে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।ভারত তথা বিশ্বে বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের প্রভাব কমতে শুরু করে তাঁর প্রচারকার্যের ফলে। মাত্র বত্রিশ বছর জীবনে তিনি ইহলোক ত্যাগ করে কিন্তু আজও লোকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করে তাঁর হিন্দুধর্ম সংস্কারের কথা ।তিনি হারিয়ে যাওয়া বেদান্ত উদ্ধার করেন এবং তিনি সে সকল বেদ-বেদান্তের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ করেন।যার ফলে ভারতে বৌদ্ধ দর্শনের বিলোপ ঘটে এবং আবার জেগে উঠে বৈদিক দর্শন তথা হিন্দু/সনাতনের ।আদি শঙ্করাচার্যের আরেকটি বড় অবাদান ছিলো পঞ্চ দেবতার পূজার বিধান করা।

যার ফলে হিন্দু সমাজে বিভিন্ন মতবাদের ঐক্য সাধন হয়।সম্ভবত কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক পৃথিবীর ইতিহাসে সব থেকে বড় বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠে এই হিন্দু সভ্যতা নতুন আঙ্গিকে গড়ে ওঠে তার হাত ধরে। স্বামী বিবেকানন্দ এরপর ঠিক একইভাবে জাগিয়ে তুলেছিলেন হিন্দু দর্শনকে সারা পৃথিবীতে। তাই আমাদের উচিত প্রতি মুহূর্তে শঙ্করাচারজের এই অবদান কে স্মরন করা। কিন্তু দুঃখের কথা হল হিন্দু জাতি কেন জানি মহৎ মানুষ গুলোকে স্মরণ করতে কার্পণ্য বোধ করে। 

পঞ্চ দেবতার ছবি
পঞ্চ দেবতার পূজা


আসুন জেনে নেই পঞ্চ দেবতার পূজার মন্ত্রঃ  পঞ্চ দেবতার মন্ত্রের আগে জেনে নেই পঞ্চদেবতা কারা? পঞ্চ দেবতা হলেন –
১)গণেশ - 
২)শিব -
৩)কৌষিকী/জয়দুর্গা - 
৪)বিষ্ণু -
৫)সূর্য দেবতা । 

১।গণপতির ধ্যান শ্লোক হলো-
ওঁ খর্বং স্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং সুন্দরং,
প্রস্যন্দন্মদগন্ধলুব্ধমধুপব্যালোলগণ্ডস্থলম্ ।
দন্তাঘাতবিদারিতারিরুধিরৈঃ সিন্দুরশোভাকরং,
বন্দে শৈলসুতাসুতং গণপতিং সিদ্ধিপ্রদং কামদম্ ॥

মন্ত্র:
ওঁ গং গণেশায় নমঃ ॥

গণপতির প্রণাম=
ওঁ দেবেন্দ্র- মৌলি- মন্দার মকরন্দ কণারুণাঃ । 
বিঘ্নং হরন্তু হেরম্বচরণাম্বুজরেণবঃ ।। 
শিবের ধ্যান বলতে কেবলই শিবের ধ্যান প্রযোজ্য এখানে শিবের ধ্যানে মহাকাল, কাল রুদ্র, নীলকণ্ঠ চন্দ্রশেখর বা শব রূপ মহাদেবের ধ্যান বলবেন না।

 শিব ধ্যান মন্ত্র
ওঁ
ধ্যায়েন নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং।
রত্নাকল্লোলভূষং পরশু-মৃগ-বর-অভয়হস্তম্ প্রসন্নম্।
পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতামরগণৈঃ ব্যাঘ্রচর্মান্বিতাঙ্গং।
বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরণং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্॥

জপ মন্ত্র
ওঁ নমঃ শিবায়

শিব প্রণাম মন্ত্র
ওঁ
নমস্তভ্যং বিরূপাক্ষ, নমস্তে দিব্যচক্ষুষে, নমঃ।
পিণাকহস্তায়, বজ্রহস্তায়, বৈ নমঃ॥
নমঃ ত্রিশূলহস্তায়, দণ্ড-পাশাংশি-পাণয়ে।
নমঃ স্ত্রৈলোক্যনাথায়, ভূতানাং পতয়ে নমঃ॥
ওঁ বানেশ্বরায় নরকার্ণবতারণায়,
জ্ঞানপ্রদায়, করুণাসাগরায়।
কর্পূরকুণ্ডবলচন্দ্রজটাধারায়,
দারিদ্র-দুঃখ-দহনায়, নমঃ শিবায়॥
ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায়, কারণত্রয়হেতবে।
নিবেদয়ামি চাত্মানং, ত্বাং গতিপরমেশ্বর॥

বিঃদ্রঃ যদি পুরো শিব প্রণাম মন্ত্র (৮ পঙ্‌ক্তি) পাঠে অসুবিধা হয়, তবে অন্তত শেষ দুটি পঙ্‌ক্তি উচ্চারণ করলেও যথেষ্ট হবে।

২। জয় দুর্গা: শক্তির প্রতীক হিসেবে
শাস্ত্র অনুযায়ী, শক্তিরূপে জয় দুর্গার পূজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। অনেকেই তাঁকে কৌষিকী রূপে অভিহিত করেন, তাই বলা যায়—কৌষিকী ও জয় দুর্গা একই শক্তির ভিন্ন প্রকাশ। যদিও ভক্তরা শক্তিরূপে পার্বতী, উমা, চণ্ডী, কালী বা ষোড়শীকে পূজা করেন, তবুও পঞ্চদেবতার মধ্যে ‘শক্তি’ উপাসনার প্রসঙ্গে শাস্ত্রে জয় দুর্গার নামই বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে।

জয়দুর্গার ধ্যানঃ- 
ধ্যান শ্লোক:
ওঁ কালাভ্রাভাং কটাক্ষৈররিকুলভয়দাং মৌলীবন্ধেন্দুরেখাম্ ।
শঙ্খং চক্রং কৃপাণং ত্রিশিখমপি করৈরুদ্বহন্তীং ত্রিনেত্রাম্ ।
সিংহাস্কন্ধাধিরুঢ়াং ত্রিভুবনমখিলং তেজসা পুরয়ন্তীম্ ।
ধ্যায়েদ্দুর্গাং জয়াখ্যাং ত্রিদশপরিবৃতাং সেবিতাং সিদ্ধিকামৈঃ ॥

মন্ত্র:
ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা ॥

প্রনাম মন্ত্রঃ- 
ওঁ সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বাথসাধিকে । 
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি ! নমোহস্তুতে ।। 

৩।বিষ্ণু ( এখানেও এক নিয়ম । অনেকে বিষ্ণু হিসাবে তাঁর অবতার গণ বা সত্য নারায়ণ বা নারায়নের প্রনাম প্রয়োগ করে থাকেন । কিন্তু এখানে কেবল ভগবান বিষ্ণুর মন্ত্র প্রযোজ্য ) 

ভগবান বিষ্ণুর ধ্যান ও প্রণাম মন্ত্র

বিষ্ণু ধ্যান মন্ত্র
ওঁ
উদ্যৎ কোটি দিবাকরাভম্ অনিশং, শঙ্খং গদাং পঙ্কজং চ।
চক্রং বিভ্রতম্, ইন্দিরা-বাসুমতী-সংশোভিত পার্শ্বদ্বয়ম্॥
কোটী অঙ্গদ-হার-কুন্ডল-ধরং, পীতাম্বরং কৌস্তুভোদ্দীপ্তম্।
বিশ্বধরং স্ববক্ষসি লসৎ শ্রীবৎসচিহ্নং ভজে॥

জপ মন্ত্র
ওঁ নমো বিষ্ণবে

ভগবান বিষ্ণুর প্রণাম মন্ত্র
ওঁ
নমো ব্রাহ্মণ্যদেবায়, গো-ব্রাহ্মণ্যহিতায় চ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায়, গোবিন্দায় নমো নমঃ॥

পাপো’হম্, পাপকর্মা’হম্, পাপাত্মা, পাপসম্ভবঃ।
ত্রাহি মাং পুন্ডরীকাক্ষ, সর্বপাপহর হরি॥

৫। সূর্যদেবের ধ্যান ও প্রণাম মন্ত্র

সূর্য ধ্যান মন্ত্র
ওঁ
রক্তাম্বুজাসনম্, অশেষগুণসিন্ধুং,
ভানুং, সমস্তজগতের অধিপতি রূপে ভজামি।
যিনি পদ্ম-হস্তে অভয় ও বর মুদ্রা ধারণ করেন,
মাণিক্য মুকুটধারী, অরুণবর্ণ দেহধারী, ত্রিনয়ন বিশিষ্ট॥

জপ মন্ত্র
হ্রাং হ্রীং সঃ ওঁ নমো ভগবতে প্রণাম শ্রীসূর্যায়

সূর্য প্রণাম মন্ত্র
ওঁ
জবাকুসুমসঙ্কাশং, কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্।
ধনতারিং, সর্বপাপঘ্নং, প্রণতো’স্মি দিবাকরম্॥

(অর্থ: আমি প্রণাম জানাই সেই দিবাকর সূর্যদেবকে, যিনি জবা ফুলের মতো রক্তবর্ণ, কশ্যপ ঋষির পুত্র, অসীম দীপ্তিসম্পন্ন, আয়ুষ্মান ধনতারী, এবং যিনি সমস্ত পাপ বিনাশ করেন।)

এখানে পঞ্চদেবতার পূজার মন্ত্রগুলি দেওয়া হলো। পূজার ক্ষেত্রে প্রথমে যাঁর পূজা করতে হয়, তিনি হলেন শ্রীগণেশ। এরপর একে একে অন্য দেবতাদের পূজা করা উচিত। অনেকেই গুরুপূজার আগে পঞ্চদেবতার পূজা করেন, আবার কেউ কেউ গুরুপূজার পরে পঞ্চদেবতার পূজা সম্পন্ন করেন।

তবে যেহেতু গুরুদেবকেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর—এই ত্রিদেবের সমন্বিত রূপ হিসেবে ধরা হয়, তাই শাস্ত্রানুসারে গুরুপূজার পরেই পঞ্চদেবতার পূজা করা উত্তম।

এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে—পঞ্চদেবতার পূজা শুরু করার সময় সর্বপ্রথম গণেশের পূজাই করতে হবে, কারণ শ্রীগণেশ সর্বপ্রথম পূজ্য।

পঞ্চদেবতার পূজার পরে, যদি কোনও লোকাচার বা কুলাচার পালনের নিয়ম থাকে—যেমন বসুমতী পূজা ইত্যাদি—তবে সেগুলি পরবর্তীতে সম্পন্ন করা উচিত।

এবার একবার চিন্তা করে দেখুন—গণেশের উপাসককে বলা হয় গাণপত্য, শিবের উপাসক শৈব, শক্তির উপাসক শাক্ত, বিষ্ণুর উপাসক বৈষ্ণব, এবং সূর্যদেবের উপাসক সৌর। এই পাঁচটি প্রধান উপাসনাপদ্ধতির সমন্বয়ে সনাতন ধর্মের এক অসাধারণ ঐক্য ও সহনশীলতার ছবি ফুটে ওঠে, তাই না?

এই প্রশ্নটি আমি আপনাদের প্রতিই ছুঁড়ে দিলাম।
এই ঐক্যের ধারণাটি প্রথম জনপ্রিয় করে তোলেন আদি শঙ্করাচার্য, যিনি চেয়েছিলেন হিন্দু ধর্মের বিচিত্র উপাসনাপদ্ধতির মধ্যে একটি সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে। 

পঞ্চ দেবতা পূজার উদ্দেশ্য
পঞ্চ দেবতা পূজার মূল উদ্দেশ্য হলো—
ধর্মীয় সহনশীলতা ও সমন্বয় বজায় রাখা
একাধিক উপাস্য রূপের মধ্যে ঐক্য অনুভব করা
প্রতিটি দেবতার বিশেষ গুণাবলীর পূজা করা
এই পূজা স্মার্ত ধারার অংশ, যেখানে বলা হয় “সব দেবতা একই ব্রহ্মত্বের বিভিন্ন রূপ”।

পঞ্চ দেবতার পূজার ধরন:
পঞ্চ দেবতা পূজায় প্রতিটি দেবতার জন্য একটি করে মূর্তি বা চিহ্ন (যেমন শিবলিঙ্গ, শালগ্রাম, সূর্য মূর্তি ইত্যাদি) স্থাপন করা হয়। প্রতিটি দেবতাকে যথাযথ মন্ত্র, ফুল, ধূপ ও প্রসাদ দিয়ে পূজা করা হয়।

উপসংহার
পঞ্চ দেবতা ধারণা হিন্দু ধর্মের এক অপূর্ব দৃষ্টিভঙ্গি, যা ধর্মীয় বহুত্ববাদকে আলিঙ্গন করে এবং বিশ্বাসীদের মধ্যে একতা গড়ে তোলে।

এই ওয়েবসাইটটিতে আরো জানতে পারবেন 
খুব সহজে পঞ্চ দেবতার পূজা করুন ঘরে,
পঞ্চ দেবতার পুজো,
পঞ্চ দেবতার আবাহন,
পঞ্চ দেবতার গায়ত্রী,
পঞ্চ দেবতার জপ পদ্ধতি,
পঞ্চ দেবতার প্রনাম মন্ত্র,
গণেশাদি পঞ্চ দেবতার নাম,
পঞ্চ দেবতার গায়ত্রী মন্ত্র,
পঞ্চদেবতা পূজা,
সনাতনধর্মের পঞ্চ দেবতার প্রনাম মন্ত্র,
পঞ্চ দেবতার ধ্যান এবং প্রণাম মন্ত্র,
সংক্ষেপে পঞ্চদেবতার পূজা,
কীভাবে পঞ্চদেবতার পূজা করতে হবে,
কীভাবে সহজে পঞ্চদেবতার পূজা কররে হয়,
ইষ্ট দেবতা,
পঞ্চদেবতার পঞ্চপচারে পূজার নিয়ম

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url