হাতে লাল সুতো বাঁধা হয় কেন?

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হাতে বা কবজিতে লাল সুতো বাঁধার একটি প্রচলিত প্রথা রয়েছে। আপনি রাস্তায় চলাচলের সময় অনেকের হাতেই এই লাল সুতো দেখে থাকবেন। এটি মূলত বিপদতারিণী পূজা বা অন্যান্য ধর্মীয় আচারের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।  হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, এই লাল সুতো অশুভ শক্তি, দুর্ঘটনা ও নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা করে। এটি কেবল একটি প্রথাই নয়, বরং ভক্তের আস্থা ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক। অনেকের মতে, এই সুতো দুষ্ট (বদ নজর) থেকেও সুরক্ষা দেয় এবং শুভ ফল বয়ে আনে।  এই প্রথা শুধু ধর্মীয় তাৎপর্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি হিন্দু সংস্কৃতির একটি সুপ্রাচীন ও গভীর বিশ্বাসের প্রকাশ।

সনাতন ধর্মীরা হাতে লাল সুতো বাঁধার ধর্মীয় কিছু ব্যাখ্যা:পুরাণে লাল সুতো ব্যবহারের আরো কিছু উদাহরণ পাওয়া যায় বিভিন্ন যজ্ঞ ও পূজো ছাড়াও।
প্রথমতঃ ভক্ত প্রহ্লাদের নাতি মহাবলি রাজা ব্রহ্মার আশীর্বাদে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের অধিপতি হয়েছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের সিংহাসন রক্ষার্থে ভগবান বিষ্ণু বামন অবতার রূপে আবির্ভূত হয়ে মহাবলিকে পাতাললোকে প্রেরণ করেন। তবে, মহাবলির ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু তাকে অমরত্ব দান করেন এবং আশীর্বাদস্বরূপ তার হাতে লাল সুতো বেঁধে দেন।  এই পবিত্র লাল সুতো ভগবানের কৃপা ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে হিন্দু ধর্মে প্রচলিত। অনেক ভক্ত বিশ্বাস করেন যে এই সুতো অশুভ শক্তি, দুর্ঘটনা ও নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা করে। তাই, আজও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ভগবানের আশীর্বাদ ও  লাভের উদ্দেশ্যে হাতে লাল সুতো বাঁধেন।
হাতে লাল সুতো বাঁধা হয় কেন? hd
হাতে লাল সুতো বাঁধা হয় কেন?

একসময় দেবতা ও অসুরদের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়,অসুরদের পরাক্রম দেখে দেবরাজ ইন্দ্ৰ খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। স্বামীকে চিন্তিত দেখে স্ত্রী ইন্দ্ৰাণী তার জন্য প্রার্থনা শুরু করেন। দেবী ইন্দ্রাণী লাল সুতো দিয়ে এক বিশেষ মালা প্রস্তুত করেন, যাতে তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি সংহত থাকে। এরপর দেবরাজ ইন্দ্রের মঙ্গল কামনা করে, সেই পবিত্র লাল সুতো দিয়ে মালা তৈরি করে তাঁর গলায় পরিয়ে দেন এক ঋষি—যাতে ইন্দ্র অসুরদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকেন। এরপর শুরু হয় দেবতা ও অসুরদের ভয়ংকর যুদ্ধ, যেখানে ইন্দ্রের নেতৃত্বে দেবতারা বিজয় অর্জন করেন। সেই সময় থেকেই বিশ্বাস জন্মে, মন্ত্রপূত লাল সুতো বাঁধলে বিপদ থেকে রক্ষা মেলে।

লাল সুতো পরার তাৎপর্যঃ যেহেতু লাল রং বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক, তাই হিন্দু ধর্মে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বিবাহ, সন্তানের জন্ম, পূজা-অর্চনা বা উৎসবের মতো শুভ অনুষ্ঠানে লাল রঙের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অনেকের মতে, লাল সুতো পরার পিছনে রয়েছে নানান বিশ্বাস—এটি সুখ, সমৃদ্ধি, দীর্ঘায়ু ও শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসে আস্থা ও আনুগত্যের নিদর্শন হিসাবে হাতে লাল সুতো বাঁধার এই প্রথা শতাব্দীপ্রাচীন।

হিন্দুরা হাতে সুতা পড়ে কেন?
হিন্দু ধর্মে হাতে লাল সুতো বাঁধার প্রথা একটি প্রচলিত সংস্কার, যা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে। এটিকে সাধারণত "কালবা" (Kalava), "মৌলি" (Mouli) বা "রক্ষা সুত্র" (Raksha Sutra) বলা হয়। এর কিছু প্রধান কারণ ও তাৎপর্য নিচে দেওয়া হলো:

১. রক্ষাকবচ হিসেবে
লাল সুতোকে শুভ ও সুরক্ষা প্রদানকারী মনে করা হয়।

এটি অশুভ শক্তি, নজরদোষ (কুদৃষ্টি) ও বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য বাঁধা হয়।

অনেক সময় পূজা-অর্চনার পর পুরোহিত ভক্তদের হাতে এটি বেঁধে দেন, যা দৈব আশীর্বাদস্বরূপ গণ্য হয়।

২. ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ
বিভিন্ন হিন্দু rituals যেমন পূজা, যজ্ঞ, বিবাহ বা উপনয়ন (জন্মোৎসব)-এ এই সুতো বাঁধার রীতি আছে।

রক্ষাবন্ধন উৎসবে বোনেরা ভাইয়ের হাতে লাল সুতো বেঁধে দেয়—এটি ভাই-বোনের অটুট ভালোবাসা, স্নেহ ও রক্ষার বন্ধনের প্রতীক।

৩. আধ্যাত্মিক ও জ্যোতিষীয় গুরুত্ব
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, লাল সুতো শুক্র গ্রহের কুপ্রভাব কাটাতে সাহায্য করে।

এটি বাম হাতে (প্রায়শই ডানহাতি মানুষের ক্ষেত্রে) বাঁধা হয়, কারণ এটি চন্দ্রের শক্তি (স্নায়ু ও মানসিক স্থিতিশীলতা) নিয়ন্ত্রণ করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

৪. শুভ লক্ষণ ও ভাগ্য বৃদ্ধি
লাল রংকে শক্তি, সৌভাগ্য ও ধন-সম্পদের প্রতীক মনে করা হয়।

কিছু লোকাচারে এটি ধন-দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পেতে সহায়ক বলে বিবেচিত হয়।

৫. বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথা
দক্ষিণ ভারতে এটিকে "চরু" (Charu) বলা হয় এবং পূজার সময় ব্যবহার করা হয়। উত্তর ভারতে "মৌলি" নামে পরিচিত এবং প্রায়ই এটি তুলসী গাছ বা দেবমূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়।

কোন হাতে বাঁধে?
সাধারণত বাম হাতের কবজিতে বাঁধা হয়, কারণ এটি গ্রহণের হাত (Receiver's hand) হিসেবে বিবেচিত।

কিছু বিশেষ অনুষ্ঠানে ডান হাতেও বাঁধা হতে পারে (যেমন পুরোহিতের দ্বারা প্রদত্ত সুতো)। এই প্রথা হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, সংস্কার ও সামাজিক রীতির সমন্বয়, যা ব্যক্তিকে সুরক্ষিত ও ধর্মীয়ভাবে অনুপ্রাণিত রাখে। 

হিন্দুরা হাতে বিভিন্ন রঙের সুতা (বা "রক্ষাসূত্র") পরিধান করে, যা ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক বা সামাজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এই রঙগুলোর প্রতিটিরই আলাদা অর্থ ও গুরুত্ব রয়েছে। নিচে কিছু সাধারণ রঙ এবং তাদের তাৎপর্য দেওয়া হলো:

🔴 লাল সুতা:
সবচেয়ে প্রচলিত।

এটি শক্তি, সুরক্ষা এবং শুভতার প্রতীক।

পূজা-পার্বণে বা রক্ষাবন্ধনের সময় পুরোহিতরা এটি বাঁধে।

বিবাহিত নারীরাও লাল সুতা পরে শুভলক্ষণ হিসেবে।

🟡 হলুদ সুতা:
ধর্মীয় পবিত্রতার প্রতীক।

এটি বিষ্ণু বা নারায়ণের প্রতীক হিসেবেও ধরা হয়।

কিছু বিশেষ পূজায় বা ব্রত পালনের সময় ব্যবহৃত হয়।

🟢 সবুজ সুতা:
শান্তি, সমৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক।

সাধারণত মা দুর্গা বা দেবীর পূজায় ব্যবহৃত হয়।

⚫ কালো সুতা:
সাধারণত নজরদোষ বা অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পরা হয়।

এটি আধ্যাত্মিক প্রতিরক্ষার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত।

⚪ সাদা সুতা:
বিশুদ্ধতা ও শান্তির প্রতীক।

সাধারণত সাধুসন্ত, ব্রহ্মচারী বা নির্দিষ্ট ব্রত পালনকারীরা পরে।

🔵 নীল সুতা:
ভগবান শিব বা কৃষ্ণের ভক্তরা এটি পরে থাকেন।

সাহস ও গভীর বিশ্বাসের প্রতীক।

প্রত্যেক রঙই নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রেক্ষাপট ও বিশ্বাস অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়, এবং অনেক সময় এটি ভক্তির অভিব্যক্তিও হতে পারে।
#tag;হাতে লাল সুতো বাঁধা নিয়ম,হিন্দুরা হাতে লাল সুতো বাঁধে কেন,হিন্দুরা হাতে লাল সুতো বাঁধে কেন?,জানেন কি হাতে লাল সুতো বাঁধা হয় কেন?,হিন্দুদের হাতে লাল সুতা বাধার আসল কারন,হিন্দুদের হাতে লাল সুতা,লাল সুতো,লাল সুতা,বিপত্তারিণী পূজায় হাতে তাগা বাঁধা হয় কেন?,আমরা হাতে লাল সুতো কেন বাধি?

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url