গীতা ও পুরাণ অনুসারে কর্মের প্রকারভেদ - জানুন প্রতিটি কর্মের রহস্য
শাস্ত্র অনুযায়ী কর্ম মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রতিদিনের ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে নিত্যকর্ম পালন করা উচিত, যা আত্মশুদ্ধি ও জীবনের ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ। নৈমিত্তিক কর্ম বিশেষ উপলক্ষ্যে পালনীয়, যা জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সাথে সম্পর্কিত। আর কাম্যকর্ম বিশেষ ফল লাভের জন্য করা হয়, যেমন সন্তান প্রাপ্তির জন্য যজ্ঞ বা সম্পদ বৃদ্ধির জন্য পূজা। শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে এই সব কর্ম সম্পন্ন করলে জীবনের পরিপূর্ণতা লাভ হয় এবং ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ—এই চতুর্বিধ পুরুষার্থের সঠিক সাধন সম্ভব হয়। তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শাস্ত্রনির্দিষ্ট কর্ম পালন করা উচিত।
![]() |
কর্মের প্রকারভেদ |
গীতা ও পুরান অনুসারে কর্মের প্রকারভেদের পাশাপাশি অন্যান্য প্রকারভেদ সম্পর্কে আমাদের সামান্য জ্ঞান থাকা অতীব প্রয়োজন। তাই ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি কর্মের শ্রেণীবিভাগ আমরা ক্রমান্বয়ে জানতে চেষ্টা করব।
শাস্ত্র অনুযায়ী কর্মের কয়েক প্রকারের প্রকারভেদ রয়েছে। নিম্নে তা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলোঃ
1. শাস্ত্র মতে প্রধান ৩ প্রকার কর্ম
A. সঞ্চিত কর্ম (জন্মান্তরে সঞ্চিত কর্মভাণ্ডার): সঞ্চিত কর্ম হল মানুষের জন্মান্তরে করা সমস্ত কর্মের ফসল, যা আত্মার সাথে সাথে বহন হয়। শাস্ত্র মতে, প্রতিটি জীব তার কর্মফলের অধীন এবং প্রতিটি জন্মে যে সমস্ত পুণ্য ও পাপ সঞ্চিত হয়, তা একত্রিত হয়ে সঞ্চিত কর্মভাণ্ডার গড়ে তোলে। এই সঞ্চিত কর্মই ভবিষ্যতের জন্ম ও জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নির্ধারণ করে। জীবনের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি আচরণ একটি অদৃশ্য শক্তিরূপে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চিত হয়। যখন সময় আসে, সেই সঞ্চিত কর্মের ফল ভোগ করতে হয়—যা প্রারব্ধ কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সঞ্চিত কর্মের ভাণ্ডার ধ্বংস করা সম্ভব একমাত্র আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মাধ্যমে, ঈশ্বরের কৃপায় এবং যথাযথ সাধন-ভজনের দ্বারা। তাই আমাদের উচিত, কর্মফল বুঝে সৎকর্মের পথে চলা এবং পাপ কর্ম থেকে বিরত থাকা, যাতে সঞ্চিত কর্মভাণ্ডার শুদ্ধ হয় এবং মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়া যায়।
B. প্রারব্ধ কর্ম (বর্তমান জীবনে ভোগ্য কর্ম): প্রারব্ধ কর্ম হল সেই সমস্ত কর্মফল, যা পূর্বজন্মে সঞ্চিত হয়েছিল এবং এই জীবনে যার ফল আমাদের ভোগ করতে হয়। এটি আমাদের বর্তমান জীবনের ভাগ্য, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মূল কারণ। শাস্ত্র মতে, প্রতিটি জীবের জীবনযাত্রা, পরিবার, দেহ, স্বাস্থ্য, সামাজিক অবস্থা, এমনকি জীবনের বড় বড় ঘটনা—সবই প্রারব্ধ কর্মের দ্বারা নির্ধারিত। এই কর্মের ফল এড়ানো যায় না; জন্মের সাথে সাথেই তা আত্মার সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকাশিত হয়। প্রারব্ধ কর্মভোগ ছাড়া কারো মুক্তি হয় না, তবে আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে বা ঈশ্বরের কৃপায় এই কর্মফলের ভোগ সহজ হয়ে যায়। তাই জীবনে যা কিছু ঘটে, তা প্রারব্ধ কর্মের ফল হিসাবে মেনে নিয়ে ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার সাথে জীবনযাপন করা উচিত।
C. ক্ৰিয়মাণ কর্ম (বর্তমানে করা কর্ম যা ভবিষ্যৎ গঠন করে): ক্রিয়মাণ কর্ম হল মানুষের বর্তমান জীবনে প্রতিদিনের কাজে, চিন্তায় ও আচরণে সম্পাদিত কর্ম, যা ভবিষ্যতের ভাগ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শাস্ত্র মতে, আমরা যা কিছু এখন করি, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি আচরণ—সবই ভবিষ্যতের জন্য বীজ বপন করছে। এই ক্রিয়মাণ কর্ম থেকেই আগামী জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার বীজ তৈরি হয়। সুতরাং, আমাদের উচিত প্রতিটি কর্ম বিবেচনা করে করা, যাতে ভবিষ্যতের জীবনে ভালো ফল আসে। সৎকর্ম, পরোপকার, ধর্মকর্ম এবং আত্মশুদ্ধির জন্য কর্ম করলে ভবিষ্যত জীবন সুন্দর হয়, আর পাপকর্ম করলে আগামীতে দুঃখভোগ অবধারিত। অতএব, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সদাচরণ ও শুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে ক্রিয়মাণ কর্মকে পুণ্যময় করে তুলতে হবে, যা আত্মার উন্নতি ও মুক্তির পথে সহায়ক হবে।
2. গীতা অনুযায়ী কর্মের শ্রেণীবিভাগ
A.সাত্ত্বিক কর্ম (শুদ্ধ ও নিঃস্বার্থ কাজ): সাত্ত্বিক কর্ম হল সেই সমস্ত কাজ, যা শাস্ত্রসম্মত, শুদ্ধ, শান্ত ও নিঃস্বার্থভাবে সম্পন্ন হয়। এই কর্মের উদ্দেশ্য কখনো ব্যক্তিগত লাভ বা ইন্দ্রিয়সুখ নয়, বরং ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে, আত্মার শুদ্ধি ও সকলের কল্যাণের জন্য। সাত্ত্বিক কর্মে অহংকারের স্থান নেই, এবং এতে কোনও প্রত্যাশা বা ফললিপ্সাও থাকে না। যেমন—দানের সময় গোপন রেখে সাহায্য করা, দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, পবিত্রভাবে জপ-তপ-ধ্যান করা, গরীব-অসহায়ের সেবা করা ইত্যাদি সাত্ত্বিক কর্মের অন্তর্গত। শ্রীমদ্ভগবদগীতা (১৮.২৩) অনুযায়ী, "যে কর্ম শাস্ত্রবিধিমতে এবং কামনা-রহিতভাবে কেবল কর্তব্য জ্ঞান করে করা হয়, তাই সাত্ত্বিক কর্ম।" এই ধরনের কর্ম মানুষের চিত্তকে শুদ্ধ করে, জীবনের প্রকৃত অর্থ শেখায় এবং মুক্তির পথ প্রসারিত করে। সুতরাং, আমাদের উচিত জীবনে যতটা সম্ভব সাত্ত্বিক কর্মের দিকে মনোযোগী হওয়া।
B. রাজসিক কর্ম (কামনা-বাসনাপ্রসূত কর্ম): রাজসিক কর্ম হল সেই সমস্ত কাজ, যা কামনা-বাসনা, লোভ, অহংকার, ফললিপ্সা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য করা হয়। এই কর্মের মূল উদ্দেশ্য থাকে নিজের সুখ, স্বার্থ এবং ইন্দ্রিয়তৃপ্তি। যেমন—অন্যকে হারানোর ইচ্ছা নিয়ে প্রতিযোগিতা করা, নিজের নাম ও খ্যাতি বাড়ানোর জন্য দান করা, লোভের বশবর্তী হয়ে ব্যবসা করা, এমনকি ধর্মীয় কার্যকলাপও যদি কেবল ফলপ্রাপ্তির আশায় করা হয়, তবে তা রাজসিক কর্মের অন্তর্ভুক্ত। শ্রীমদ্ভগবদগীতা (১৮.২৪) অনুযায়ী, "যে কর্ম প্রচুর পরিশ্রমসাধ্য, ইচ্ছা এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য করা হয়, তা রাজসিক কর্ম।" এই ধরনের কর্ম মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, অহংকার, ক্লান্তি এবং অশান্তির সৃষ্টি করে। ফলে রাজসিক কর্মের ফলে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায় এবং মানুষ পুনর্জন্মের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। তাই রাজসিক কর্ম এড়িয়ে চলা উচিত এবং কর্মফলকে ঈশ্বরের ইচ্ছায় সমর্পণ করে সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করা উচিত।
C.তামসিক কর্ম (অজ্ঞানতাপ্রসূত কর্ম): তামসিক কর্ম হল সেই সমস্ত কাজ, যা অজ্ঞানতা, মোহ, অলসতা, হিংসা, ক্রোধ, অহংকার এবং অপরের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে করা হয়। এই ধরনের কর্মে শাস্ত্রবিধির প্রতি অবজ্ঞা থাকে এবং কখনোই কোনো শুভ উদ্দেশ্য থাকে না। যেমন—অন্যের ক্ষতি করার জন্য কাজ করা, বিনা কারণে কাউকে কষ্ট দেওয়া, অহংকার বশত অন্যের মানহানি করা, অশুদ্ধ পথে অর্থ উপার্জন করা, মদ-মাংস সেবন করে অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। শ্রীমদ্ভগবদগীতা (১৮.২৫) অনুযায়ী, "যে কর্ম অজ্ঞানতা ও মোহবশত শুরু হয়, শাস্ত্রবিরুদ্ধ, অহংকারযুক্ত, অন্যের ক্ষতি করার জন্য করা হয়, তাই তামসিক কর্ম।" এই ধরনের কর্মের ফলে জীবনে অশান্তি, অধঃপতন এবং দুঃখ-ভোগ বৃদ্ধি পায়, এবং পুনর্জন্মের বন্ধন আরও গভীর হয়। তাই জীবনে তামসিক কর্ম এড়িয়ে চলা উচিত এবং সদা শাস্ত্রসম্মত, পরোপকারী, নিঃস্বার্থ কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করা উচিত।
3. বেদান্ত অনুসারে কর্মের শ্রেণীবিভাগ
A. নিত্যকর্ম (Nitya Karma): প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পালনীয় কর্ম। যেমন -স্নান, সন্ধ্যাবন্দন, জপ, হোম, দেবপূজা, পিতৃতর্পণ ইত্যাদি।
4. মনুস্মৃতি অনুযায়ী কর্মের শ্রেণীবিভাগ
A.জন্মগত কর্ম: জন্মগত কর্ম বলতে মানুষের জন্ম অনুযায়ী নির্ধারিত দায়িত্ব, কর্তব্য ও আচরণকে বোঝায়। শাস্ত্র মতে, প্রত্যেক জীবের জন্মই একটি নির্দিষ্ট কর্মফল ও উদ্দেশ্য নিয়ে ঘটে এবং সেই অনুযায়ী জীবনের কর্তব্য নির্ধারিত হয়। যেমন—ব্রাহ্মণের জন্য শিক্ষা ও উপদেশদান, ক্ষত্রিয়ের জন্য শাসন ও রক্ষা, বৈশ্যের জন্য ব্যবসা ও কৃষিকর্ম, এবং শূদ্রের জন্য সেবা ও শ্রম। এটি শুধু সামাজিক স্তরের সীমারেখা নয়, বরং প্রত্যেকের স্বভাব ও গুণের উপর নির্ভর করে। জন্মগত কর্ম মানে শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী নিজের কর্তব্য পালন করা, যা ধর্ম, সমাজ ও ব্যক্তির মঙ্গল সাধনে সহায়ক হয়। এই কর্ম মানুষের জীবনে পূর্ণতা আনে এবং চতুর্বর্ণ-আশ্রম ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই শাস্ত্র অনুসারে জন্মগত কর্ম পালন করা একদিকে যেমন ব্যক্তিগত উন্নতির পথে সহায়ক, অন্যদিকে সমাজের স্থিতি ও শৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমও।
B. অর্জিত কর্ম: অর্জিত কর্ম বলতে বোঝায় সেই সমস্ত কর্মফল যা বর্তমান জীবনে নিজের ইচ্ছা, চেষ্টার মাধ্যমে অর্জিত হয়। শাস্ত্রের দৃষ্টিতে, অর্জিত কর্ম হলো ব্যক্তির সদ্বুদ্ধি, পরিশ্রম ও সিদ্ধান্তের ফলাফল, যা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে—যেমন শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সম্পদ অর্জন, সামাজিক সম্মান ইত্যাদি। এটি জন্মগত কর্মের থেকে আলাদা, কারণ অর্জিত কর্ম সম্পূর্ণরূপে নিজের কর্তৃত্বে ও প্রচেষ্টায় অর্জিত হয়। অর্জিত কর্মের মাধ্যমে মানুষ তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে, নিজের ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারে। তবে, অর্জিত কর্মের ফলাফলে অহংকার বা লোভ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়; বরং তা নিয়মিত পরিশ্রম ও সৎপথে চলার মাধ্যমে অর্জন করতে হবে। তাই অর্জিত কর্মের গুরুত্ব অনেক বেশি, কারণ এটি আমাদের জীবনকে গতিশীল করে এবং আত্মোন্নতির পথে নিয়ে যায়।
5. সাধারণভাবে কর্মের শ্রেণীবিভাগ
A. কর্ম: এই কর্মটাকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়।কর্তব্য কর্ম আর পুণ্য কর্ম। সংসারের ভিতরে যে কর্মগুলো করা হয় তাহাকে কর্তব্য কর্ম বা কর্ম বলে। যেমন,পিতা মাতাকে সেবা করা স্ত্রীর সকল দ্বায়িত্ব নেওয়া।স্ত্রী হয়ে সামীকে সেবা করা সন্তানকে শু পরিবেশের সাথে মানুষ করা ছোট ভাই বোনদের দেখাশুনা করা। আপনি বাজার থেকে সংসারের জন্য যে বাজার করবেন বা পিতা মাতা স্ত্রী সন্তান ভাই বোন বা সংসারের যে কোন সদস্যর জন্য কোন পসাক জামা কাপড়,যা কিছু কিনবে বা পরিবারের সদস্যদের শারীরিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসা যাই করবেন সবই কর্ম।অতএব আপনি পরিশ্রম করে রোজগার করে সংসারে সকল সদস্যদের জন্য যেইটাই করবেন সেইটাই কর্তব্য কর্ম বা কর্ম।
B.বিকর্ম: যে কর্মের ভিতরদিয়ে পাপ জড়িয়ে আসে তাহাকে বলে বিকর্ম। যেমন মদ, গাজা, নেশা করা, পতিতালয়ে প্রবেশ, চুরি, ডাকাতি, মানুষ খুন, স্ত্রী হত্যা, নারী হত্যা,পশু হত্যা, গোপনে লোকের খতি করা, পর নিন্দা,মিথ্যে ভাষন, লোক ঠোকানো ইত্যাদি। এই পাপ কর্মকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয় (কাইক পাপ, বাচোশিক পাপ, আর মানষিক পাপ, দেহের দারায়, মুখ দারায়, মোনের দারায়)।
C. অকর্ম: ভগবানের প্রীতি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে যে কর্ম করা হয় তাহাকে অকর্ম বলে বা সুক্কৃতি। গুরু সেবা,গুরুর উছ্যিষ্ট প্রসাধ পাওয়া,বৈষ্ণব সেবা,বৈষ্ণবের উছ্যিষ্ট প্রসাধ,সাধু সঙ্গ,গোবিন্দের চরণামৃত পান করা,গোবিন্দের প্রসাধ পাওয়া, গীতা,ভাগবত পাঠ, শ্রবণ,যজ্ঞ কির্তন অনুষ্ঠানে কির্তন শ্রবণ,সেখানে কিছু দান করা,সেখানের প্রসাধ পাওয়া হরিনাম করা,মালা জপ করা,ইত্যাদি ইত্যাদি। যেমন ধরুন আপনার বাড়িতে একদিন পুজা অনুষ্ঠানের আয়জন কররেলন। আপনি বাজার থেকে পুজার জন্য ফল, মিষ্টি, ভগবানের জন্য কাপড়,আর সেই সাথে বাড়ির সদ্যদের জন্য কিছু কাপড় কিনলেন। ঐ খানে বাড়ির সদস্যদের জন্য যে কাপড়গুলো কিনলেন ঐটাই কর্ম।আর ভগবানের জন্য যে কাপড় ফল মিষ্টি যা কিছু কিনলেন ঐটাই অকর্ম। আপনি বাড়িতে আসার পর আপনার কোন একটা বাচ্ছা কান্না করছে তখন আপনি ঐ ফল থেকে কোন একটা ফল ভগবানকে নিবেদন করার আগেই যদি আপনার বাচ্ছাকে খাইতে দেন তবে ঐটাই আবার কর্ম হয়ে যাবে। আপনার বাড়ির সদ্যসদের নিয়ে একদিন আপনি কথাও পুজা দেখতে গেছেন।সেখানে গিয়ে কিছু ফল মিষ্টি কিনে মুন্দিরে দিলেন। এর পর ঐ খানে কিছু খাবার কিনে আপনার সন্তান স্ত্রী বা বাড়ির সদস্যদের দিলেন
এ বিষয়ে বহু পণ্ডিতেরা দীর্ঘকাল ধরে চিন্তা করে বিভ্রান্ত হয়েছেন। তাই আজ আমি সংক্ষেপে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করছি। শ্রীকৃষ্ণ গীতা (৩/৮)-তে স্পষ্টভাবে বলেছেন:
"নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং" — অর্থাৎ, "অর্জুন, তুমি নিয়মিত (নির্ধারিত) কর্ম সম্পাদন করো।"
এখানে "নিয়ত কর্ম" বলতে বোঝানো হয়েছে শাস্ত্রসম্মত ও কর্তব্যরূপ কর্ম। সুতরাং বুঝতে হবে, কর্মের প্রকার অনেক হলেও, প্রকৃত কর্ম একটাই—যা শাস্ত্রসম্মত। তাহলে অন্য সব কর্ম কি কর্ম নয়? না, অন্য কর্মগুলো প্রকৃত অর্থে কর্ম নয়, তারা শুধুমাত্র বন্ধনের কারণ।
শ্রীকৃষ্ণ গীতা (৩/৯)-তে বলেছেন:
"যজ্ঞার্থাৎ কর্ম" — অর্থাৎ, যজ্ঞার্থে (ঈশ্বরকে নিবেদিত করে) করা কর্মই প্রকৃত কর্ম।
অন্য কর্মের কথা বললে, গীতায় (৩/৯)-এ উল্লেখ আছে:
"অন্যত্র লোকো'য়ং কর্মবন্ধনঃ" — অর্থাৎ, অন্য সব কর্ম শুধু বন্ধন সৃষ্টি করে।
অতএব কৃষিকাজ, চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি নিজেকে সুখী করার জন্য বা কামনাপূর্তির জন্য করা হলে, তা আসলে বন্ধনের কারণ, প্রকৃত কর্ম নয়। প্রকৃত কর্ম একটিই—যজ্ঞ। এই যজ্ঞের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের বহির্মুখী কামনাগুলি দমন করতে হয়, মনকে সংযত করতে হয় এবং দৈবগুণ (শান্তি, ধৈর্য, ক্ষমা ইত্যাদি) লাভ করতে হয়।
এই যজ্ঞই আসলে সংযমরূপ অগ্নিতে ইন্দ্রিয়কামনাগুলিকে আহুতি দেওয়া। এবং এই যজ্ঞে পরমেশ্বর আমাদের অন্তরে অবস্থান করে সর্বদা নির্দেশ প্রদান করেন। যেমন গীতায় বলা হয়েছে:
"সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্টিতম্" — সর্বব্যাপী ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত।
কর্ম সম্পর্কে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
Q: অকর্ম কি পাপ?
A: না, তবে নিষ্ক্রিয়তা কখনো কখনো অহিতকর। যখন কেউ শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী নির্দিষ্ট কর্তব্যকর্ম, যেমন নিত্যযজ্ঞ, জপ, দান, তপ, ইত্যাদি না করে অলস বা উদাসীন হয়ে থাকে, তখন সেই অকর্ম পাপের কারণ হয়। কারণ, সেই অকর্মের ফলে মানুষের মধ্যে অবজ্ঞা, অহংকার, কামনা, লোভ ও আলস্য বৃদ্ধি পায়।
Q: নিষ্কাম কর্ম কিভাবে করব?
A: ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে কর্তব্য পালন করুন। নিষ্কাম কর্ম মানে ফলপ্রত্যাশা ও অহংকার ত্যাগ করে শুদ্ধ চিত্তে কর্ম করা। এটাই আমাদের মুক্তির পথ।
মন্তব্য: কর্ম জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। শাস্ত্র বলে, “কর্মই ধর্ম”। কারণ, কর্মের মধ্য দিয়েই মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ হয়, সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকে, এবং আত্মার শুদ্ধি ঘটে। তবে সব কর্ম সমান নয়। শাস্ত্রসম্মত, সৎকর্ম এবং পরার্থে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে করা কর্মই প্রকৃত কর্ম। অন্যদিকে, কামনা-বাসনা বা স্বার্থসিদ্ধির জন্য করা কর্ম মানুষকে বন্ধনের দিকে ঠেলে দেয়। তাই কর্ম করতে হবে নিষ্কামভাবে, শাস্ত্রবিধি মেনে, এবং সর্বদা মনে রাখতে হবে, "ফল ঈশ্বরের হাতে, আমি শুধু তাঁর ইচ্ছার বাহন"। এইভাবেই কর্ম মানুষের আত্মোন্নতি ও মুক্তির সোপান হয়ে ওঠে।