"হরে কৃষ্ণ" নামটি যেন এক জাদু, সংস্কৃতের দুই মিষ্টি শব্দ মিলেমিশে তৈরি। "হরে" শব্দটি "হর" থেকে আসা, মানে "যে নিয়ে যায়", অনেকটা যেন দুঃখগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এটা ঈশ্বরের একটা বিশেষ দিক দেখায়, তিনি আমাদের কষ্ট আর খারাপ অভ্যাস থেকে বাঁচান। "কৃষ্ণ" মানে "সবচেয়ে সুন্দর", যিনি তাঁর সবকিছু দিয়ে পুরো দুনিয়াকে নিজের দিকে টানেন। কৃষ্ণ হলেন সেই, যাঁকে গীতায় সবচেয়ে বড় ঈশ্বর বলা হয়েছে। তাই "হরে কৃষ্ণ" নামটা ঈশ্বরের দয়ার কথা বলে, আর তিনি যে কত সুন্দর, সেটাও জানায়। এই নাম জপ করলে, মানুষ ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়, আর তাঁর দয়ায় মুক্তি পেতে চায়। "হরে কৃষ্ণ" একটা বড় মন্ত্র, যা বলে কলিযুগে ঈশ্বরকে পাওয়ার সবচেয়ে সহজ রাস্তা এটা।
 |
হরে কৃষ্ণ নামের অর্থ ও তাৎপর্য |
হরে কৃষ্ণ নামের অর্থ:
হরে কৃষ্ণ নামের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ আছে: হরে আর কৃষ্ণ। হরে মানে হল যিনি দুঃখ, পাপ আর বিশ্ব থেকে মুক্তি দেন। আর কৃষ্ণ মানে হল খুব সুন্দর, যিনি সবাইকে তাঁর প্রেমে টানেন। তাহলে হরে কৃষ্ণ এর মানে হচ্ছে 'হে সকল শক্তির অধিকারী কৃষ্ণ, আমাদের দুঃখ আর পাপ দূর করুন এবং আমাদের আপনার প্রেমে টানুন'। এই নাম জপ করলে ভক্ত তার মনের সব অপবিত্রতা দূর করার চেষ্টা করে আর ঈশ্বরপ্রেমের জন্য প্রার্থনা করে।
আমরা জানি, শ্রীমৎ মহাপ্রভু কর্তৃক প্রচারিত ও প্রসারিত 'হরিনাম' বা 'হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্র ষোলো নাম এবং বত্রিশ অক্ষরের মন্ত্র হিসেবে পরিচিত। কিন্তু যখন আমরা নামসংকীর্তন বা জপ করি, তখন মূলত তিনটি নামেরই উচ্চারণ করি— যথা:
১) হরে, ২) কৃষ্ণ, এবং ৩) রাম।
পরম করুণাময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি গোলোকপতি, তিনিই সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। অর্থাৎ তিনি সৎ (অস্তিত্ব), চিৎ (জ্ঞাতব্য) এবং আনন্দ (পরমানন্দ) - এই তিন গুণের অধিকারী। এই সচ্চিদানন্দ মূর্তির তিনটি শক্তি যথাক্রমে সন্ধিনী, সংবিদ এবং হ্লাদিনী শক্তি রূপে প্রকাশিত। এই ত্রিগুণ বা শক্তি তিনটি— কর্ম (সন্ধিনী), জ্ঞান (সংবিদ) এবং ভক্তি (হ্লাদিনী)— হরে, কৃষ্ণ ও রাম নামের মধ্যেই অন্তর্নিহিত।
অতএব, আমাদের উচিত "হরে কৃষ্ণ" মহামন্ত্রের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, এবং ষোলো নাম-বত্রিশ অক্ষরের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করে আমাদের পারমার্থিক জীবনকে উন্নতির পথে পরিচালিত করা।
হরিনাম মহামন্ত্রের তাৎপর্যঃ
হরিনাম মহামন্ত্র শুধু একটা প্রার্থনা নয়; এটা আমাদের এবং ভগবানের মধ্যে একটা সংযোগ তৈরি করে। নিয়মিত এবং মনোযোগ দিয়ে এই মন্ত্রের জপ ও কীর্তন করলে আমাদের আত্মা পরিষ্কার হয়, হৃদয় ভক্তিতে ভরে যায়, আর আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য—ভগবানের কাছে প্রেম ও আশ্রয় পাওয়া।
এই মন্ত্র—“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”—এর মধ্যে গভীর মানে রয়েছে। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র নামগুলো রয়েছে। প্রতিটি নামেই একটা শক্তি ও গভীরতা রয়েছে।
মন্ত্রের তিনটি মূল নাম:
1. হরে – শ্রীমতী রাধারাণীর করুণাশক্তি প্রকাশ করে, যা ভক্তের হৃদয়ে ভগবানের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে।
2. কৃষ্ণ – সবচেয়ে সেরা ভগবান, যিনি সকলকে আকর্ষণ করেন এবং প্রেমিকা।
3. রাম – আনন্দের ভগবান, যিনি ভক্তদের সত্যিকারের আনন্দ দেন। রামের মানে হচ্ছে “আনন্দের উৎস”।
এই মহামন্ত্রে ষোলোটি নাম এবং বত্রিশটি অক্ষর একসাথে আসলে কিছু না; প্রতিটি নাম ভগবানের শক্তির প্রকাশ। হরে কৃষ্ণ নাম নিয়ে জপ করে আমরা ভগবানের অসীম শক্তির সঙ্গে সংযুক্ত হই। এই নামগুলো আমাদের অন্তরের অপবিত্রতা দূর করে, মায়ার জালে বাঁধা পড়া থেকে মুক্তি দেয়, আর স্থায়ী আনন্দ ও ভগবদপ্রেম উপহার দেয়।
সুতরাং, হরিনাম মহামন্ত্র আসলে আমাদের এবং ভগবানের মধ্যে এক শক্তিশালী সংযোগ তৈরি করে, যা আমাদের আত্মা, হৃদয় আর জীবনের মূল লক্ষ্য পূর্ণ করতে সাহায্য করে।
ষোল সখা ষোল সখী বত্রিশ অক্ষর।
হরিনাম তত্ত্ব ধর্ম অতি গূঢ়তর ।।
মাধুৰ্য মহিমা তত্ত্ব যে জন জানয়।
রাধাকৃষ্ণ নিত্যধামে গমন করায় ।।
'হরে কৃষ্ণ' 'হরে রাম' এই মন্ত্র ষড়ক্ষর।
সূত্র কৈল হর এই তিন নাম তন্ত্রে ।।
ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর তিন নামে।
বৃত্তি করি কৈলা গৌর জগত গোচর ।।
নাম রূপে প্রেম দিলা আপনি যাচিয়া ।।
নামে মত্ত ভক্ত চিত্ত বেড়ায় নাচিয়া ।।
করুণার কল্পতরু এই হরিনাম ।
কামনায় হবে মুক্তি প্ৰেম ব্রজধাম ৷৷
সংক্ষেপে কহিনু এই হরিনাম তত্ত্ব।
জীবের দুর্লভ এই প্রেমের মহত্ত্ব ।।
অষ্ট ‘হরে’ নামের তাৎপর্য
হরিনাম মহামন্ত্রের মধ্যে ‘হরে’ শব্দটি আটবার উচ্চারিত হয়, যা কেবল একটি ধ্বনি নয়, বরং ভগবানের নানা শক্তি ও লীলার প্রকাশ। প্রতিটি ‘হরে’ নামের আলাদা আলাদা অর্থ এবং গভীর তাৎপর্য রয়েছে। যথা:
1. প্রথম 'হরে' – চন্দ্রাবলী
➔ শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় সখী চন্দ্রাবলী। তাঁর নাম স্মরণের মাধ্যমে ভক্তির এক বিশেষ অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়।
2. দ্বিতীয় 'হরে' – প্রেমময়ী শ্রীরাধা
➔ শ্রীমতী রাধারাণী, যিনি ভক্তির পরম দেবী। ভক্তকে কৃষ্ণপ্রেমের আশীর্বাদ প্রদান করেন।
3. তৃতীয় 'হরে' – সুভাষিণী
➔ ভক্তিস্বরূপিণী, যিনি মধুর বাণী এবং কীর্তনের মাধ্যমে ভক্তকে কৃষ্ণের নামগানে উদ্বুদ্ধ করেন।
4. চতুর্থ 'হরে' – সিংহাসন
➔ শ্রীকৃষ্ণের রাজসিংহাসন, যা তাঁর লীলার কেন্দ্রবিন্দু। ভক্তের হৃদয়কেও ভগবানের সিংহাসন রূপে পরিগণনা করা হয়।
5. পঞ্চম 'হরে' – সুদর্শন
➔ ভগবানের সুদর্শন চক্র (Sudarshana Chakra), যা সকল অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে ভক্তকে রক্ষা করে।
6. ষষ্ঠ 'হরে' – শেষ দেব
➔ অর্থাৎ সমস্ত দেবতাদের মধ্যে চূড়ান্ত, পরম দেবতা স্বয়ং ভগবান।
7. সপ্তম 'হরে' – সাবিত্রী
➔ যিনি জীবের মধ্যে চেতনা সঞ্চার করেন এবং কর্মে প্রেরণা জোগান। তিনি বেদজ্ঞানের মূল আধার।
8. অষ্টম 'হরে' – রেবতী
➔ ভগবানের লীলাসঙ্গিনী, যিনি জীবের পূর্ণতা এবং কল্যাণ সাধনে সহায়তা করেন।
চারি 'কৃষ্ণ' নামের তাৎপর্যঃ
প্রথম, 'কৃষ্ণ'- পরম ব্রহ্ম শ্রীগোবিন্দ।
দ্বিতীয়, ‘কৃষ্ণ’- বাসুদেব তৃতীয়, ‘কৃষ্ণ’- জগন্নাথ।
চতুৰ্থ, 'কৃষ্ণ'- বলভদ্র।
চারি 'রাম' নামের তাৎপর্য।
প্রথম, 'রাম'- শ্রীরাধিকা।
দ্বিতীয়, 'রাম'- লক্ষ্মী।
তৃতীয়, 'রাম'- সরস্বতী।
চতুর্থ, ‘রাম’- সুভদ্রা।
ষোলোটি গুহ্যনামের তালিকা:
এই ষোলোটি নামের মাধ্যমে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রের অন্তর্নিহিত গোপন তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। প্রতিটি নাম ভগবান ও ভগবতী শক্তির এক একটি প্রকাশভেদ নির্দেশ করে। এখানে রাধা-কৃষ্ণের লীলা, কৃষ্ণের বিভিন্ন রূপ, শাক্ত শক্তি, ভক্তিস্বরূপ এবং দেবী-দেবতাদের সংযোগ প্রকাশ পায়। বিশেষ করে 'হরে' নামের মাধ্যমে শ্রীমতী রাধারাণী, চন্দ্রাবলী, সাবিত্রী, রেবতী, সুভদ্রা ইত্যাদি শক্তির প্রকাশ বোঝানো হয়েছে। 'কৃষ্ণ' ও 'রাম' নামের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের নানা রূপ—গোবিন্দ, বাসুদেব, জগন্নাথ, বলরাম ইত্যাদির প্রকাশ।
হরে – চন্দ্রাবলী।
কৃষ্ণ – শ্রীগোবিন্দ।
হরে – প্রেমময়ী শ্রীরাধা।
কৃষ্ণ – বাসুদেব।
কৃষ্ণ – জগন্নাথ।
কৃষ্ণ – বলভদ্র।
হরে – সুভাষিণী।
হরে – সিংহাসন, সুদর্শন।
হরে – (অজ্ঞাত/গুপ্তার্থ)।
রাম – শ্রীরাধিকা।
হরে – শেষদেব।
রাম – লক্ষ্মী, সরস্বতী।
রাম – (অজ্ঞাত/গুপ্তার্থ)।
রাম – সুভদ্রা।
হরে – সাবিত্রী।
হরে – রেবতী।
হরিনাম মহামন্ত্রের বত্রিশ অক্ষরের তাৎপর্যঃ
শ্রীললিতা সখীদের অবস্থান - অক্ষর অনুযায়ী নিচে ধারাবাহিকভাবে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করা হইল;
০১. 'হ' অক্ষরে: শ্রীললিতা সখী মস্তকে অধিষ্ঠান করেন।
০২. 'রে' অক্ষরে: শ্রীবিশাখা সখী দক্ষিণ বাহুতে অবস্থান করেন।
০৩. 'কৃ' অক্ষরে: চম্পকলতা সখী কণ্ঠদেশে বিরাজ করেন।
০৪. 'ষ্ণ' অক্ষরে: চিত্রা সখী বাহুতে শোভা পান।
০৫. 'হ' অক্ষরে: রঙ্গদেবী সখী হাতে অবস্থান করেন।
০৬. 'রে' অক্ষরে: সুদেবী সখী পৃষ্ঠদেশে থাকেন।
০৭. 'কৃ' অক্ষরে: তুঙ্গবিদ্যা সখী মুখমণ্ডলে অধিষ্ঠান করেন।
০৮. 'ষ্ণ' অক্ষরে: ইন্দুরেখা সখী শ্রবণছিদ্রে অবস্থান করেন।
০৯. 'কৃ' অক্ষরে: শশীরেখা সখী ভুরুযুগলে অবস্থান করেন।
১০. 'ষ্ণ' অক্ষরে: বিমলা সখী ভ্রুর ডান দিকে অবস্থান করেন।
১১. 'কৃ' অক্ষরে: পালিকা সখী ভ্রুর বাম দিকে অবস্থান করেন।
১২. 'ষ্ণ' অক্ষরে: লবঙ্গমঞ্জরী সখী হৃদয়মধ্যে থাকেন।
১৩. 'হ' অক্ষরে: শ্যামলা সখী নাভিমূলে অবস্থান করেন।
১৪. 'রে' অক্ষরে: মধুমতী সখী নাভির মধ্যে অবস্থান করেন।
১৫. 'হ' অক্ষরে: ধন্যা সখী করাঙ্গুলিতে অবস্থান করেন।
১৬. 'রে' অক্ষরে: মঙ্গলা সখী করমূলে অধোমুখী থাকেন।
১৭. 'হ' অক্ষরে: শ্রীদাম সখা জঙ্ঘায় অবস্থান করেন।
১৮. 'রে' অক্ষরে: সুদাম সখা জানুতে অবস্থান করেন।
১৯. 'রা' অক্ষরে: বসুদাম সখা ভ্রুর অংশে অবস্থান করেন।
২০. 'ম' অক্ষরে: অর্জুন সখা লিঙ্গদেশে অবস্থান করেন।
২১. 'হ' অক্ষরে: সুবল সখা দক্ষিণ পায়ে অবস্থান করেন।
২২. 'রে' অক্ষরে: কিঙ্কিণী সখা বাম পায়ে অবস্থান করেন।
২৩. 'রা' অক্ষরে: চাতক সখা পূর্বদিকে অবস্থান করেন।
২৪. 'ম' অক্ষরে: মধুমঙ্গল সখা অগ্নিকোণে অবস্থান করেন।
২৫. 'রা' অক্ষরে: শুক সখা দক্ষিণ দিকে অবস্থান করেন।
২৬. 'ম' অক্ষরে: বিশাল সখা নৈঋত কোণে অবস্থান করেন।
২৭. 'রা' অক্ষরে: মহাবল সখা পশ্চিম দিকে অবস্থান করেন।
২৮. 'ম' অক্ষরে: বৃষভ সখা বায়ুকোণে অবস্থান করেন।
২৯. 'হ' অক্ষরে: দেবপ্রস্থ সখা উত্তর দিকে অবস্থান করেন।
৩০. 'রে' অক্ষরে: উদ্ভব সখা ঈশান কোণে অবস্থান করেন।
৩১. 'হ' অক্ষরে: ঊর্ধ্বমুখী থেকে সুখভোগ করেন মহাবাহু সখা।
৩২. 'রে' অক্ষরে: ঈশান সখা অধোমুখী হয়ে অবস্থান করেন।
মন্তব্য: হরে কৃষ্ণ এক বিশাল পবিত্র সুর। এই নামে লুকানো আছে অনেক মানে। "হরে" মানে ঈশ্বর, যিনি দুঃখ আর অন্ধকার সরিয়ে খুশিতে ভরিয়ে দেন। "কৃষ্ণ" হলেন সেরা ভালোবাসার ভগবান, খুব সুন্দর আর সবাই তাঁর দিকে টানে। "হরে কৃষ্ণ" মনে করায়, কৃষ্ণের দয়ায় সব কষ্ট দূর হয়, আর জীবনে কৃষ্ণকে ভালোবাসা যায়। এই নাম জপ করলে মন পরিষ্কার হয়, মনে ভক্তি আসে, আর আত্মা শান্তি পায়। "হরে কৃষ্ণ" শুধু নাম নয়, এটা জীবন পরিবর্তনের সিঁড়ি, মনের শুদ্ধ হওয়ার মন্ত্র, আর মুক্তির পথ।