নিত্য ভোগ নিবেদন: বিধি ও মন্ত্র (Daily Bhog Offering Rules & Mantras)

কোথাও কোন স্থানে যদি গীতা সংঘ বাড়িতে কিংবা অন্যান্য কোন গৃহে ভোগ দিতে কেহ মনস্থ করেন; তবে নিম্নোক্ত বিধানে তাহা করিবেন। যে কোন পূজার শেষে ভোগ দিতে হয়। 

নিত্য ভোগ নিবেদনের গুরুত্ব

নিত্য ভোগ নিবেদনের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির নিত্যনৈমিত্তিক প্রকাশ। এই নিবেদনের মাধ্যমে ভক্তের মধ্যে নিয়ম ও শৃঙ্খলার চর্চা হয়। এটি প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করে ভক্তরা ঈশ্বরের কৃপালাভ করেন। সর্বোপরি, এটি আধ্যাত্মিক সম্পর্ককে করে তোলে গভীর ও মধুর।

নিত্য ভোগ নিবেদন নিয়ম ও মন্ত্রের ধাপসমূহ, হিন্দু পূজা নির্দেশিকা
নিত্য ভোগ নিবেদন করার সঠিক নিয়ম ও মন্ত্র 


নিত্য ভোগ নিবেদন বিধি ও মন্ত্র

পূজকের স্ববামে পবিত্র জায়গায় আচমনীয় জল দ্বারা একটি চতুস্কোন মণ্ডল করিয়া; তদুপরি অন্নব্যাঞ্জন ও অন্যান্য মিষ্টান্ন দ্রব্যাদি পাত্র স্থাপন করিবেন। তৎপর অন্নাদি ভোগ পাত্রের উপরে আচমনীয় জল পুষ্প দ্বারা ছিটাইয়া দিতে দিতে বলিবেন। যথাঃ," বং এতস্মৈ সোপ করনামায় নম:" বলিয়া তুলসী পত্র সহ গন্ধ পুষ্প প্রদান করিবেন। পরবর্তীতে কুশীতে একটু জল লইয়া, 'ওঁ অমৃত পস্তরণ মসি স্বাহা' বলিয়া ভোগের দ্রব্য সামগ্রীতে কিঞ্চিৎ জল দিবেন। তারপর ধেনু মুদ্রয়ায় অমৃত করণ করিবেন। ধেনু মুদ্রা যথা, উভয় হস্তের অঙ্গুলি গুলিকে পরষ্পরের সন্ধি মধ্যগত করিয়া কনিষ্ঠার সহিত অনামিকা যোগ করিয়া, পরে তর্জনীর অগ্রভাগের সহিত মধ্যমার অগ্রভাগ যুক্ত করিলে, তাহাকে ধেনু মুদ্রা বলে। উক্ত মুদ্রা প্রদর্শন করত: পরে মৎস্যমুদ্রা দ্বারা আচ্ছাদন পূর্ব্বক ভোগাদির উপর দশবার বীজ মন্ত্র জপ করিবেন। মৎস্য মুদ্রা যথা, ডাইন হাত মাটিমুখে করিয়া তাহার পৃষ্ঠে বাম হস্ত স্থাপন করত: উভয় অঙ্গুষ্ঠ পরিচালিত করাকে মৎস্য মুদ্রা বলে। এই মুদ্রা কৃত ভোগ পাত্রের উপরে "ও ক্লীং কৃষ্ণায় স্বাহা" বলিয়া দশবার জপ করিবেন। তৎপর বামহস্ত চিত করিয়া অঙ্গুলি সকল প্রসারিত করত:, কিঞ্চিৎ বক্র করিলে গ্রাস মুদ্রা হইবে। উক্ত মুদ্রা দেখাইয়া পরে ঘন্টাধ্বনী করত: গন্ধপুষ্প হাতে লইযা অন্নব্যাঞ্জনাদি নিবেদন করিবেন।

অন্নব্যঞ্জনাদি

ও অন্নব্যাঞ্জনং চতুবিধং। রসোয়ৈ ষড়ভি সমন্বিতম উত্তম প্রাণদঞ্চৈব

গৃহান প্রভু জনার্দ্দন: ॥

ইদমন্নব্যাঞ্জনং ও ক্লীং কৃষ্ণায় নমঃ।

ভোগ পাত্রের উপরে তুলসীপত্র সহ গন্ধপুষ্প দিবেন। খিচুরী নিবেদন করিতে হইলে তাহার বাক্য পাঠ পৃথক হইবে।

খিচুরী নিবেদন

ওঁ গব্য সর্পি: কপূরাদি নানা মধুর সংযুতম্। ময়া নিবেদিম্ ভক্ত্যা কৃষারান্নাং গৃহ্যতাং প্রভু পরমেশ্বর। ইদং কৃষারান্নং ওঁ ক্লীং কৃষ্ণায় নমঃ।

মিষ্টান্ন নিবেদন

ওঁ গব্য সর্পি: পয়োযুক্তং কপূরাদি সংযুতম্ ময়ানিবেদিতং ভক্ত্যাপরমান্নং প্রতি গৃহ্যতাম্।

ইদং পরমান্নং ও ক্লীং কৃষ্ণায় নমঃ

। গন্ধপুষ্প তুলসীপত্র দিয়া নিবেদন করিবেন। তৎপর পঞ্চ প্রাণাহুতি মুদ্রাক্রমে একটু করিয়া জল দিবেন। মুদ্রাক্রম যথা, পঞ্চ প্রাণাহুতি মুদ্রা। দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুষ্ঠ, কনিষ্ঠা ও অনামিকা যোগে, “ওঁ প্রাণায় স্বাহা", তৎপর অঙ্গুষ্ঠ, তর্জনী ও মধ্যমা যোগে, "ওঁ অপনীয় স্বাহা," তারপর অঙ্গুষ্ঠ, মধ্যমা ও অনামিকা যোগে, ওঁ সমানায় স্বাহা," পর কনিষ্ঠা বাদে চতুরাঙ্গুলি যোগে, "ওঁ উদানায় স্বাহা," পঞ্চাঙ্গুলি যোগে, ও ব্যানায় স্বাহা। এই রূপে পঞ্চপ্রাণাহুতি মুদ্রায় একটু করিয়া জলদানের পর পুনঃকুশীতে জল লইয়া, "ওঁ অমৃতপিধানমসিস্বাহা," বলিয়া উক্ত জল ভোগ পাত্রে প্রদান পূর্ব্বক পানার্থ জল দিবেন। যথা, ইদং পানার্থ জলং ওঁ * ক্লীং কৃষ্ণায় নম:, ইদং পুনরাচ মনীয়ম্ জলং ওঁ কৃষ্ণায় নমঃ, এতৎত্তাম্বুলং ওঁ ক্লীং কৃষ্ণায় নম:। এষ সচন্দন গন্ধ পুষ্পাঞ্জলি ওঁ ক্লীং কৃষ্ণায় নম:।


স্তব পাঠ

ওঁ অয়িনন্দ তনুজ কিঙ্করং পতিতং মাংঘোর বিষমে। তবাম্বুদৌ কৃপয়া তৎপদং পঙ্কজং স্থিতম্ ॥

ধুলি সদৃশং বিচিন্তয়েৎ হরিগুরু।

সোলার সতী শ্রীমতি রাধা রাণীর ভোগ নিবেদন

একই অনুকরণে ভোগ নিবেদন করিবেন। শুধুমাত্র বীজ মন্ত্রাদি পৃথক বলিয়া জানিবেন। নিম্নে তাহা বর্ণিত হইল। যথা,

অন্ননিবেদন

ওঁ অন্নব্যঞ্জনং চতুবিধং রসৌয়ে ষড়ভি সমন্বিতাম্। উত্তম প্রাণদঞ্চৈব গৃহান দেবী পরমেশ্বরী। ইদমন্নব্যঞ্জনং ওঁহী শ্রীং রাধিকায়ৈ নম:।

খিচুরী নিবেদন

ওঁ গব্যসপি: কপূরাদি নানা মধুর সংযুতম্।

ময়া নিবেদিতম্ ভক্ত্যা কৃষারান্নং গৃহ্যতাং দেবী রাসেশ্বরী। ইদং কৃষারান্নং ওঁ হ্রীং শ্রীং রাধিকায়ৈ নম:।

মিষ্টান্ন নিবেদন

ও গব্যসর্পি: পয়োযুক্তং কপুরাদি সুবাসিতম্।

ময়া নিবেদিতম্ ভক্ত্যা পরমান্নং প্রতিগৃহ্যতাম্। ইদং পরমান্নং ওঁ হ্রীং শ্রীং রাধিকায়ৈ নম:। এইভাবে সকল দ্রব্য নিবেদন করত: এবং তাহাতে গন্ধ পুষ্প দিয়া মৎস্য মুদ্রায় আচ্ছাদন পূর্ব্বক "ওঁ হ্রীং শ্রীং রাধিকায়ৈ নম: এই বীজমন্ত্র: দশবার জপ করত:, পরে উক্ত মন্ত্রে পানার্থ ও পুন: রাচমনীয় দিবেন। তৎপর "ইদং তাম্বুলং ওঁ হ্রীং শ্রীং রাধিকায়ৈ নম:" গন্ধপুষ্প দিবেন। এষ সচন্দন গন্ধ পুষ্পাঞ্জলি ওঁ হ্রীং শ্রীং রাধিকায়ৈ নম:। ইহা তিনবার দিবেন। তৎপর প্রণাম বাক্য পাঠ করিবেন। ইহার পর যথা শক্তি জপ করিয়া, জপ বিসর্জন করত পূজা সমাপ্ত করিবেন। যেখানে ভোগের কার্যাদি করিতে হইবে সেই স্থানে ভোগাদি কার্য্য সমাধানের পর আরতি করিবেন। নতুবা ইতিপূর্ব্বে যাহা নিরুপিত হইয়াছে তাহাই সঠিক থাকিবে। অতএব এই স্থানে আর নতুন করিয়া আরতি বিধিমালা লিখিত হইল না।


ভোগ নিবেদন শেষে করণীয়

ভোগ নিবেদন শেষে প্রথমে ভগবানের চরণে নীরব প্রণাম জানাতে হয় এবং কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে নামস্মরণ বা ধ্যান করা উত্তম। এরপর ভগবানের অনুমতি প্রার্থনা করে নিবেদিত ভোগকে প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। প্রসাদ গ্রহণের সময় শুচিতা, কৃতজ্ঞতা ও ভক্তিভাব বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোগ গ্রহণের পর পূজাস্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, ধূপ–দীপ নিবেদন করা এবং সংক্ষিপ্ত কীর্তন বা মঙ্গলাচরণ পাঠ করলে পূজার ফল আরও শুভ হয়।

ভোগ প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা

ভোগকে প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র একটি আচার। ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা ভোগ যখন গ্রহণযোগ্য হয়, তখন তা প্রসাদরূপে ভক্তদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়। এই প্রসাদ শুধু খাদ্য নয়—এটি ভগবানের করুণা, কৃপা ও আশীর্বাদের প্রতীক। তাই ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণের সময় শুচিতা, ভক্তিভাব ও বিনয় বজায় রাখা জরুরি। প্রসাদ সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে বিতরণ করা উচিত, কারণ এটি সমতার ও ঈশ্বরীয় প্রেমের বহিঃপ্রকাশ।

ভগবানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

ভগবানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ভক্তির এক অনন্য ও গভীর প্রকাশ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যে সুরক্ষা, আশীর্বাদ ও পথনির্দেশনা আমরা পাই, তা স্মরণ করে আন্তরিক হৃদয়ে তাঁর প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা উচিত। নামজপ, প্রার্থনা, ধ্যান বা সেবামূলক কাজের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়। কৃতজ্ঞ মন মানুষকে আরও বিনয়ী, শান্ত ও ঈশ্বরমুখী করে তোলে। তাই প্রতিদিন কিছুক্ষণ ভগবানের কৃপা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানালে আধ্যাত্মিক জীবন আরও পবিত্র ও সার্থক হয়।

স্থান পরিষ্কার রাখা

স্থান পরিষ্কার রাখা ভক্তি ও শুচিতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পূজা বা ভোগ নিবেদনের পর স্থানটি পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা ভগবানের উদ্দেশে সম্মান প্রদর্শনেরই সমান। পরিষ্কার স্থান মনে শান্তি আনে এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশকে আরও পবিত্র করে তোলে। ধূপ–দীপের ছাই, ফুলের পাপড়ি, থালা-বাসন বা ব্যবহৃত দ্রব্য ঠিকভাবে সরিয়ে রেখে স্থান শুকনো ও সুশৃঙ্খল রাখলে পরবর্তী পূজাও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। তাই পূজাস্থানের পরিচ্ছন্নতা শুধু বাহ্যিক নয়—এটি ভক্তিরই একটি সুন্দর প্রকাশ।

FAQ

Q1: ভোগ নিবেদনের আগে কি স্বাদ চেখে দেখা দেখা যায়?
ANSWER: না, ভোগ দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়, তাই রান্নার সময় স্বাদ চেখে দেখা নিষেধ।

Q2: ভোগ নিবেদনের পরে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়?
ANSWER: ১–৫ মিনিট ভক্তিভরে অপেক্ষা করাই যথেষ্ট।

Q3: ভোগ নিবেদন কি প্রতিদিন করতে হয়?
ANSWER: হ্যাঁ, নিত্য পূজায় ভোগ নিবেদন বাধ্যতামূলক।


মন্তব্য-“নিত্য ভোগ নিবেদন বিধি ও মন্ত্র” বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দৈনন্দিন পূজার শুচিতা, ভক্তি ও শাস্ত্রসম্মত ধারাকে আরও সুশৃঙ্খল করে। নিয়মমাফিক ভোগ নিবেদন করলে ভক্তির গভীরতা বৃদ্ধি পায় এবং ভগবানের সঙ্গে মানসিক সংযোগ আরও দৃঢ় হয়। সঠিক বিধি অনুসারে, শুদ্ধ মন ও পরিষ্কার পরিবেশে মন্ত্রোচ্চারণসহ ভোগ নিবেদন করলে পূজার ফল আরও মঙ্গলময় হয়। এ বিষয়টি সাধারণ ভক্তদের দৈনন্দিন পূজা-অর্চনাকে সহজ, শাস্ত্রসম্মত ও অর্থবহ করে তুলতে সহায়তা করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url