কার্তিক মাসের ব্রত: উপকারিতা, নিয়ম ও পালনবিধি

 কার্তিক মাসের ব্রত

কার্তিক মাস সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও মাহাত্ম্যপূর্ণ মাস হিসেবে বিবেচিত। এই মাসকে দামোদর মাস নামেও ডাকা হয়, যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের (বিষ্ণু) শৈশবের লীলা এবং ভক্ত বাৎসল্যের প্রতীক। ধর্মশাস্ত্র অনুসারে, এই মাসে ব্রত পালন করলে বিপুল পুণ্য লাভ হয় এবং মোক্ষ লাভের পথ প্রশস্ত হয়। কার্তিক মাসের ব্রত কীভাবে পালন করতে হয়, তার নিয়ম, উপকারিতা ও ধর্মীয় গুরুত্বসহ বিস্তারিত নির্দেশিকা পড়ুন।


কার্তিক মাসের গল্পে গল্পে মূল কাহিনী 

এক দেশের রাজার পাঁচটি মেয়ে ছিল। একদিন রাজা সব মেয়েদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তারা সকলে কার ভাগ্যে খায়। এ কথার উত্তরে রাজার ছোট মেয়ে ছাড়া আর সকলেই বলল যে, তারা রাজামশায়ের ভাগ্যে খায়। কিন্তু ছোট মেয়ে বলল যে, যে যার নিজের ভাগ্যে খায়, আর মা লক্ষ্মী তার। ব্যবস্থা করে দেন। ছোটমেয়ের কথা শুনে রাজার খুব রাগ হল। তিনি ঠিক করলেন যে, সকালে উঠে। তিনি প্রথমে যার মুখ দেখবেন তারই সঙ্গে ছোটমেয়ের বিয়ে দেবেন। পরের দিন সকালে উঠে রাজা। বাইরে বেরুতেই দেখলেন যে, অপর এক রাজ্যের এক ব্রাহ্মণ আর তার ছেলে রাজবাড়ির সামনে দিয়ে। কোথাও যাচ্ছে। রাজ্য ব্রাহ্মণকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলে তার ছেলের সঙ্গে ছোট মেয়েটির বিয়ে। দিয়ে দিলেন। রাজার মেয়ে তার ছেলের বউ হল দেখে বেচারা গরিব ব্রাহ্মণ খুবই আশ্চর্য হল আর বেশ চিন্তায় পড়ল। রাজকন্যার মনে কিন্তু কোনো কোনো কষ্টই হলনা, সে সে বেশ আনন্দে স্বামী আর শ্বশুরকে নিয়ে ঘর করতে লাগল। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। এরই মধ্যে রাজ কন্যা একটি একদিন স্বামী ও শ্বশুরকে। বলল, "বাড়ির সামনে যা দেখতে পাবেন নিয়ে আসবেন।" একদিন তার স্বামী বাড়ির সামনে একটা। মরা কেউটে সাপকে পড়ে থাকতে দেখল। সে তার স্ত্রীর কথামত সাপটাকে তুলে এনে তার স্ত্রীকে দিয়ে। দিল। রাজকন্যাও সেই মরা সাপটাকে এক জায়গায় তুলে রাখল।

কার্তিক মাসের ব্রত
কার্তিক মাসের ব্রত


সে সময়, সে দেশের রাজার ছেলের খুব অসুখ হয়েছিল। অনেক কবিরাজ বৈদ্য দেখলেন কিন্তু কেউ তার রোগ সারাতে পারলেন না। শেষে এক বুড়ো কবিরাজ বললেন যে, একটা মরা কেউটে সাপের মাথা যদি কোন রকমে যোগাড় করতে পারা যায়- তাহলে তাঁর ছেলেকে বাঁচানো যাবে। এই কথা শুনে চারিদিকে ঢ্যাঁরা পিটিয়ে দিলেন যে, মরা কেউটে সাপের মাথা যে এনে দিতে পারবে, সে যা চাবে রাজা বিনা দ্বিধায় তাকে তাই দেবেন। এই চ্যাঁরা পেটানোর কথা রাজকন্যাও শুনতে পেল। সে তখুনি তার শ্বশুরকে দিয়ে মরা কেউটে সাপটা রাজ টে সাপটা রাজার কাছে পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সে শ্বশুরকে একথাও বলে দিল। যে, রাজা কিছু দিতে চাইলে তা যেন না নেয়া হয়, শুধু রাজাকে কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাতে কোনো গ্রামের কোনো ঘরে কেউ যেন আলো না জ্বালায়। রাজকন্যার। শুধু রাজাকে এটুকু বলতে হবে যে, তাঁর রাজ্যে, শ্বশুর রাজাকে একথা জানিয়ে শুধু হাতেই ফিরে এলেন-আর রাজাও আবার চারিদিকে ট্যাঁরা পিটিয়ে সকলকে জানিয়ে দিলেন যে কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাতে তাঁর রাজ্যে কেউ যেন আলো না জ্বালায়।


তারপর কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাত আসলে রাজকন্যা নিজে খুব জাঁক-জমকের সাথে লক্ষ্মী। পূজা করল এবং বাড়িখানার চারদিকে আলো দিয়ে খুব সাজিয়ে রাখল। মা লক্ষ্মী পুজোর দিন মর্ত্যের গ্রামে এলেন। মা' লক্ষ্মী দেখলেন একমাত্র সেই গরিব ব্রাহ্মণের ব্যড়ি ছাড়া আর কারুর বাড়িতে আলো। জ্বলছে না। মা তখন সেই গরিব ব্রাহ্মণের ঘরেই ঢুকলেন। রাজকন্যাও খুব ভক্তি নিষ্ঠার সঙ্গে মা লক্ষ্মীর পূজো করল। মা লক্ষ্মীও রাজকন্যার পূজোয় খুব সন্তুষ্ট হয়ে, বললেন," তোর ঘরে আমি আমার পায়ের। নুপুর রেখে যাচ্ছি, এখন থেকে আর তোদের কোন কষ্ট থাকবে না।" যাবার সময় মা লক্ষ্মী রাজকন্যাকে। একথাও বলে গেলেন যে, তারা যেন ভাদ্র মাস, কার্তিক মাস, পৌষ মাস আর চৈত্র মাসেও এমনি। ভাবেই লক্ষ্মী পুজো করে।


মা লক্ষ্মীর দয়ায় গরিব ব্রাহ্মণের আর কোনো কষ্টই রলনা,-তারও রাজার মত ঐশ্বর্য্য হল। ভাল হবার পর রাজকন্যা তার শ্বশুরকে একটা পুকুর প্রতিষ্ঠা করতে বলল। রাজকন্যার কথা মত প্রকুর ৫। কাটানো হল। প্রতিষ্ঠার দিন বহু লোক খাওয়ানোর ব্যবস্থা হল। দলে দলে লোক খাওয়া-দাওয়ার জন্যে হল। অবস্থা আসতে লাগল, আর রাজকন্যা সব দেখতে লাগল বাড়ির জানালায় বসে। এমন সময় রাজকন্যা দেখল যে সেই সব লোকজনের মধ্যে তার বাবাও রয়েছেন। সে তখনি তার শ্বশুরকে দিয়ে তার বাবাকে। ভাকিয়ে আনালো- আর নিজের পরিচয় দিল তাঁর কাছে। রাজকন্যার বাবাও তখন মেয়েকে জানালেন। যে, মা লক্ষ্মী তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হওয়ায় তাঁর রাজা ধন-সম্পত্তি সবই নষ্ট হয়ে গেছে। রাজকন্যা সব শুনে তার বাবাকে লক্ষ্মীপূজো করতে বলল। এরপর রাজা দেশে ফিরে গেলেন এবং খুব ভক্তি করে। লক্ষ্মীপুজো করলেন। এর ফলে অল্প দিনেই রাজা তার রাজ্য ও ধন-সম্পত্তি সবই ফিরে পেলেন। রাজা বেশ কিছুদিন তার রাজ্যের ও সংসারের সকলকে নিয়ে বেশ শান্তিতে বসবাস করলেন, শেষে তাঁর ছেলে-মেয়েদের লক্ষ্মীপূজো করার জন্যে উপদেশ দিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। এভাবেই কার্তিক মাসের আমাবস্যার রাতে মা লক্ষ্মী পূজোর প্রচার হল মর্ত্যে।

কার্তিক মাসের ব্রতের মূল তাৎপর্য


​বিষ্ণুর প্রিয় মাস: কার্তিক মাস ভগবান বিষ্ণু (শ্রীহরি) এবং দেবী লক্ষ্মীর অত্যন্ত প্রিয়। পুরাণ মতে, এই মাসে শ্রীহরি নারায়ণ রূপে জলে বাস করেন। তাই এই মাসে তাঁর আরাধনা করলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়।

​সর্বশ্রেষ্ঠ মাস: স্কন্দ পুরাণ, পদ্ম পুরাণ ইত্যাদি গ্রন্থে কার্তিক মাসকে সব মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, পুণ্য কর্মসমূহের মধ্যে পুণ্যতম এবং সর্বাধিক বিশুদ্ধকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

​অক্ষয় পুণ্য লাভ: শাস্ত্র মতে, এই মাসে ভক্তি সহকারে সামান্য সেবা বা ধর্মীয় কাজ করলেও তা সহস্রগুণ অধিক ফল দান করে এবং অক্ষয় পুণ্য লাভ হয়।

​পাপ নাশ ও মোক্ষ: এই মাসকে আত্মশুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয় সংযমের মাস হিসেবে দেখা হয়। নিষ্ঠার সাথে ব্রত পালন করলে পূর্ব জন্মের ও বর্তমান জীবনের সকল পাপ নাশ হয় এবং মুক্তি (মোক্ষ) লাভ সম্ভব হয়।


​কার্তিক ব্রত পালনের গুরুত্বপূর্ণ নিয়মাবলী

​কার্তিক মাসে ব্রত পালনের জন্য বেশ কিছু নিয়ম শাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কিছু নিয়ম ও করণীয় বিষয় নিচে আলোচনা করা হলো:


​১. প্রাতঃস্নান ও সংযম:

​কার্তিক স্নান: কার্তিক কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ তিথি থেকে কার্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে নদী বা পুকুরে স্নান করা অত্যন্ত শুভ। এতে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায় বলে বিশ্বাস করা হয়।

​সংযম: এই মাসে শরীর, মন ও বাক্যকে সংযত রাখা জরুরি। ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করা উচিত।

​ভূমিতে শয়ন: মেঝেতে শয়ন করা এই মাসের একটি বিশেষ ব্রত, যা পুণ্যের ফল বৃদ্ধি করে।

​২. দীপদান (প্রদীপ দান):

​দীপদানের মাহাত্ম্য: ধর্মশাস্ত্রে কার্তিক মাসে দীপদানের গুরুত্ব সর্বাধিক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই মাসে একটিমাত্র প্রদীপ নিবেদনেও প্রসন্ন হন।

​আকাশ প্রদীপ: দেবালয়ে বা তুলসীতলায় ভক্তিভরে দীপদান করা, অখন্ড দীপাবলীর আয়োজন করা এবং আকাশ প্রদীপ দান করা শ্রীহরির প্রীতি লাভের জন্য বিশেষভাবে করণীয়।

​তুলসী ও বিষ্ণু: প্রতিদিন তুলসীতলায় এবং মন্দির, নদী বা তীর্থস্থানে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা উচিত।

​৩. পূজা ও আরাধনা:

​তুলসী পূজা: কার্তিক মাসে তুলসী পুজোর বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। প্রতিদিন তুলসীর পূজা ও পরিক্রমা করা এবং প্রদীপ জ্বালানো উচিত। এই মাসেই তুলসী বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।


​বিষ্ণু পূজা: ভগবান বিষ্ণুর স্বরূপ শালগ্রামের পূজা করলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়।


​শাস্ত্র পাঠ: প্রতিদিন ভগবদ্গীতা বা শ্রীবিষ্ণুর সহস্রনাম পাঠ করা বা পবিত্র শাস্ত্রসমূহ শ্রবণ করা অত্যন্ত শুভ।

​জপ: এই মাসে জপ ও নাম-সংকীর্তন করা পুণ্যের কাজ।

​৪. খাদ্য ও দান:

​হবিষ্যান্ন: কার্তিক মাসে পলাশপত্রের উপর হবিষ্যান্ন (সাধারণত সেদ্ধ চাল, সবজি, ঘি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি নিরামিষ খাদ্য) ভোজন করা কর্তব্য।

​নিষিদ্ধ খাদ্য: এই মাসে মাছ ও অন্যান্য আমিষ খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ। এছাড়াও, বিউলি, মুগ, মুসুর, ছোলা, মটর, গোটা সর্ষে ইত্যাদি ডাল ও শস্য খাওয়া উচিত নয়।

​দান: কার্তিক মাসে অন্ন, উল বা গরম পোশাক, তিল, আমলকি, এবং দীপদান করা অত্যন্ত শুভ। এতে লক্ষ্মীর আশীর্বাদ লাভ করা যায়।


​🌙 কার্তিক মাসের বিশেষ তিথি ও উৎসব


​কার্তিক মাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তিথি ও উৎসব পালিত হয়।

​কার্তিক পূর্ণিমা: এই মাসের পূর্ণিমা তিথিটি অত্যন্ত পবিত্র। একে দেব দীপাবলি বলা হয়। এই দিনেই ভগবান শিব ত্রিপুরাসুর নামক অসুরকে বধ করেছিলেন বলে এই দিনটিকে ত্রিপুরারি পূর্ণিমা নামেও জানা যায়। এই দিন কার্তিক স্নান ও দীপদান বিশেষ ফলদায়ক।

​তুলসী বিবাহ: কার্তিক মাসের একাদশী (প্রবোধিনী একাদশী) থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত তুলসী বিবাহ উৎসব পালিত হয়।

​কার্তিক পূজা: কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিনে দেবসেনাপতি কার্তিকেয়র পূজা হয়। বিশেষ করে সন্তান কামনায় এই পূজা করা হয়।

​কার্তিক ব্রত পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো দৈহিক ও মানসিক পবিত্রতা অর্জন করে ভগবানের কৃপা লাভ করা।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url