মোক্ষলাভের তীর্থ ভ্রমণ চারধাম

হিন্দু ধর্মে চার ধাম বা চতুর্ধাম হল একটি পবিত্র তীর্থযাত্রা, যা হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আত্মিক উন্নতির সঙ্গে জড়ানো। এই চার ধাম ভগবান বিষ্ণুর চারটি রূপ ও অবতারের সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং জীবন মোক্ষ লাভের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।

চারধাম:চারধাম সম্পর্কে বিস্তারিত:

১ বদ্রীনাথ ধাম-বদ্রীনাথ ধামে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন কালো পাথরের 'নারায়ণ মূর্তি। হাওড়া বা দিল্লী জংশন থেকে লক্সার হয়ে হরিদ্বার। হরিদ্বার থেকে হহৃষিকেশ ১ ঘণ্টার পথ। শেয়ার ট্যাক্সি ও বাস যাচ্ছে হরিদ্বার থেকে হহৃষিকেশ। 

২। শ্রীদ্বারকা থাম-স্বারকা হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র তীর্থ। সপ্তপুরীর এক পুরী এই দ্বারকা। দ্বারকার মূল আকর্ষণ দ্বারকাধীশ বা রণছোড়জীর মন্দির। সোমনাথ বা পোরবন্দর থেকে বাসে যাওয়া যায়। বম্বে থেকে আসা সৌরাষ্ট্র-মেল ও ভিরামগম-ওখা ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার হাপা ছেড়ে দ্বারকায় যাচ্ছে। স্থানীয়দের কাছে যারকা দোয়ারকা নামে পরিচিত। 

চারটি প্রধান তীর্থস্থান
চারটি প্রধান তীর্থস্থান


৩। শ্রীজগন্নাথ ধাম (পুরী)-এখানে, বিশ্ববিখ্যাত জগন্নাথদেবের মন্দির অবস্থিত। এখানে সর্বতীর্থের সমন্বয় ঘটেছে। স্বর্গদ্বার, যজ্ঞেশ্বর, শ্বেতগঙ্গা, মার্কণ্ডেয়শ্বর মন্দির, গুণ্ডিচাবাড়ি, ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর, সাক্ষীগোপাল ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেন যাচ্ছে পুরী। বাসও নিয়মিত যাতায়াত করে কলকাতা-পুরী। 

৪। শ্রীরামেশ্বর ধাম-দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের শেষ প্রান্তভূমি পক প্রণালীতে একটি দ্বীপের আকারে গড়ে উঠেছে রামেশ্বরম। সীতাদেবীর বালুকা দ্বারা নির্মিত মূর্তি ও রামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ স্থাপিত রয়েছে এই মন্দিরে। মাদুরাই থেকে এক্সপ্রেস ও প্যাসেঞ্জার ট্রেন আসে রামেশ্বরমে।

হিন্দু ধর্মে যে চারটি ধাম আছে সেখানে গেলে কি কি পূর্ণ হয়

হিন্দু ধর্মে চারধাম (চারটি প্রধান তীর্থস্থান) যথাক্রমে বদ্রীনাথ, দ্বারকা, জগন্নাথ পুরী এবং রামেশ্বরম। এই চারধামে তীর্থযাত্রা করাকে অত্যন্ত পবিত্র ও মোক্ষপ্রদায়ক বলে বিবেচনা করা হয়। এই তীর্থযাত্রা সম্পন্ন করলে নিম্নলিখিত ফলাফল বা পূর্ণতা লাভ করা যায় বলে বিশ্বাস করা হয়:


১. পাপমুক্তি (পাপ খণ্ডন)

এই চারধামে গমন ও পূজা-অর্চনা করলে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায় বলে বিশ্বাস করা হয়।


বিশেষ করে রামেশ্বরম-এ স্নান করে শ্রীরামচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গের দর্শন করলে সমস্ত পাপ নষ্ট হয়।


২. মোক্ষ বা মুক্তিলাভ

চারধাম দর্শন করলে মানুষের জন্ম-মরণের চক্র থেকে মুক্তি (মোক্ষ) লাভ হয় বলে হিন্দু শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। বদ্রীনাথ ধামে বিষ্ণুর স্বরূপ নারায়ণের দর্শন ও পূজা মোক্ষের পথ সুগম করে।


৩. জীবনের চারটি পুরুষার্থ পূর্ণতা

হিন্দু দর্শন অনুযায়ী মানুষের জীবনের চারটি প্রধান লক্ষ্য (পুরুষার্থ) হলো:

ধর্ (ধার্মিক জীবন)

অর্থ (সম্পদ ও সমৃদ্ধি)

কাম (ইচ্ছাপূরণ)

মোক্ষ (মুক্তি)

চারধাম যাত্রা করলে এই চারটি পুরুষার্থই পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।

৪. দেবদর্শনের সৌভাগ্য

জগন্নাথ পুরী-তে ভগবান জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার দর্শন ভক্তের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে।

দ্বারকাধীশ মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের দর্শন করলে ভক্তের সমস্ত দুঃখ দূর হয়।

৫. সম্পূর্ণ তীর্থযাত্রার পূর্ণতা

হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, চারধামে গমন করলে সমস্ত তীর্থযাত্রার পুণ্য একসাথে অর্জন করা যায়।

৬. আধ্যাত্মিক শান্তি ও মানসিক শুদ্ধতা

এই পবিত্র স্থানগুলিতে গেলে মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে।

বিশেষ গুরুত্ব: চারধাম যাত্রা সাধারণত উত্তর থেকে দক্ষিণ (বদ্রীনাথ → দ্বারকা → জগন্নাথ পুরী → রামেশ্বরম) বা পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে করা হয়। আদি শঙ্করাচার্য এই চারধাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে করা হয়।

চতুর্ধাম যাত্রার ইতিহাস: এই চার ধামের ধারণা প্রথম ৮ম শতকে শ্রীমদ আদ্য শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভারতজুড়ে হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণের অংশ হিসেবে এই চারটি তীর্থকে পবিত্র তীর্থযাত্রার কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণ করেন।এই তীর্থযাত্রা শুধু ধর্মীয় নয়, একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাও বটে, যা মানুষের জীবনকে গভীরভাবে পরিবর্তন করে দেয়।

চতুর্ধাম যাত্রার নিয়ম ও পদ্ধতি


১. যাত্রার প্রস্তুতি

যাত্রা শুরু করার আগে শরীর এবং মনের জন্য প্রস্তুতি নিন। কিছু ব্রত পালন করুন, উপবাস করুন এবং পবিত্র চিন্তায় থাকুন।


যাত্রার সংকল্প গ্রহণ: অনেক ভক্ত গুরু বা পুরোহিতের কাছে যাত্রার সংকল্প নেন। এই সময় একটি জপ বা mantra পড়া হয়।


শুদ্ধতা এবং ব্রহ্মচর্য: যাত্রার সময় শুদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত, মাংস, মদ, বা অশুদ্ধ খাবার এড়ানো ভাল।


২. যাত্রার ধারা

আদিশঙ্করাচার্য অনুযায়ী যাত্রার সঠিক ধারা:

পুরী (পূর্ব) → রামেশ্বরম (দক্ষিণ) → দ্বারকা (পশ্চিম) → বদ্রীনাথ (উত্তর)


এই পথে চললে জীবনের চারটি প্রধান উদ্দেশ্য (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।


৩. প্রতিটি ধামে দর্শনের নিয়ম

১. জগন্নাথ পুরী (ওড়িশা):

দর্শনের সময়: মঙ্গল আরতি থেকে শুরু করে দিনভর নানা রীতি পালন করা হয়। 

বিশেষ দিন: রথযাত্রা (আষাঢ় মাসে)।

নিয়ম: পরিষ্কার পোশাক পরা, প্রণাম করা এবং মন্দিরের চারপাশে ঘোরানো।


২. রামেশ্বরম (তামিলনাড়ু):

মন্দির: রামনাথস্বামী মন্দির। 

প্রধান আচার: ২২টি কুন্ডে স্নান করা। 

নিয়ম: প্রথমে সমুদ্রস্নান, তারপর কুন্ডস্নান এবং শিবলিঙ্গ দর্শন। 


৩. দ্বারকা (গুজরাট):

মন্দির: দ্বারকাধীশ। 

বিশেষ দিন: জন্মাষ্টমী। 

নিয়ম: কৃষ্ণের প্রতি ভক্তিভরে দর্শন এবং দানপূণ্য করা।


৪. বদ্রীনাথ (উত্তরাখণ্ড):

অবস্থান: হিমালয়ের পাদদেশে। 

মন্দির: বদ্রীনারায়ণ। 

দর্শনের সময়: মে-নভেম্বর। 

নিয়ম: গঙ্গাস্নান করে দর্শন।


৪. যাত্রার পরের বিষয়:

বাড়ি ফিরে পুরোহিত বা গুরু কাছে ধন্যতা যজ্ঞ করতে হয়। অনেকেই ব্রাহ্মণ ভোজন বা দান করেন এবং যাত্রা শেষে মোক্ষের কামনা করেন।


চতুর্ধাম যাত্রা হিন্দু জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা, যা শুধু শরীরের তীর্থযাত্রা নয়, বরং অন্তরের শুদ্ধির যাত্রাও।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url