হিন্দুধর্ম গ্রহণ করা যায় কি? বিস্তারিত জানুন ধর্মান্তরের নিয়ম

অন্য ধর্মের অনুসারীরা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে পারেন তবে এটি একটি আন্তরিকআন্তদৃষ্টি মূলক প্রক্রিয়া যা  কেবলমাত্র বাহ্যিক কোন আসার অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়সনাতন ধর্ম গ্রহণ করার জন্য কেন্দ্রীয় ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ বা বাধ্যবাধকতা মূলক ধর্মান্তর প্রিয়া নেইকারণ হিসেবে হিন্দু ধর্ম স্বতঃস্ফূর্ত এবং বিশ্বাসভিত্তিক  প্রাচীন একটি ধর্মআপনি যদিধর্ম গ্রহণ করতে চান তাহলে প্রচলিত কিছু ধাপদৃষ্টিভঙ্গি  প্রদান  করা হল তবে এর আগে প্রাথমিক  কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন

হিন্দুধর্ম গ্রহণ করা যায় কি বিস্তারিত জানুন ধর্মান্তরের নিয়ম
হিন্দুধর্ম গ্রহণ করা যায় কি বিস্তারিত জানুন ধর্মান্তরের নিয়ম


হিন্দু ধর্ম গ্রহণ  পদ্ধতি  সম্পর্কে প্রাথমিক  আলোচনা: আমরা সকলেই জানি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম হল সনাতন বা হিন্দু ধর্ম। সকল ধর্ম, মত,পথ এবং উপাসনা পদ্ধতি এসব সবকিছুরই প্রধান মুখ হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। যেহেতু পৃথিবীর একটি সময় থেকে হিন্দু ধর্ম একমাত্র ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম ছিল না তাই সে সময়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কে ধর্মান্তরিত করার তেমন কোন প্রথা ছিল না। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনেআধুনিক সমাজের তাল মাতাল অবস্থার কারণে  শুধু ভিন্ন ধর্মের উদ্ভবই ঘটেনি বরং হিন্দু ধর্মকে সংহার করতে বহু ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে যার ফলে এদের দ্বারা হিন্দুরা বিপথেও চালিত কম হয়নি। মহামানবরা যেমন সমাজ সংস্কারের জন্য কাজ করেছেন তেমনি সময়ের প্রয়োজনে কিছু পদ্ধতি এবং সমাজের জন্য কিছু নির্দেশনা প্রদান  করেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে এক মহান ঋষির আবির্ভাব ঘটে। আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক বিস্তার ১২০০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলেও, এর মৌলিক প্রক্রিয়া অনেক আগেই সূচিত হয়েছিল। এই সময়ে, হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনা এবং অন্যধর্মাবলম্বীদের হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করার পদ্ধতি সুসংহতভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ঋষি দেবল। তার রচিত দেবল স্মৃতি গ্রন্থে হিন্দু ধর্মে গ্রহণ-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ বিধান বিবৃত হয়েছে।

হিন্দু হওয়ার নিয়ম

দেবল স্মৃতি  গ্রন্থ অনুযায়ী হিন্দু  ধর্ম গ্রহণের কিছু পদ্ধতি:
১।  অন্য ধর্ম থেকে আগত ব্যক্তিদের শুদ্ধিকরণপবিত্র করন  প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসতে হবে আর এই পদ্ধতির নাম দিয়েছেন শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া।


২। অন্য ধর্ম থেকে আসার ক্ষেত্রে একজন গুরু অথবা আচার্যের মাধ্যমে দীক্ষা গ্রহণ করে ধর্মীয় শিক্ষার সূচনা করতে হবে এ মাধ্যমকে তিনি দ্বিতীয় গ্রহণ পর্যায় বলে অভিহিত করেছেন।

 
৩। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বর্ণে প্রবেশের জন্য উপনয়ন বা জ্ঞানার্জনের আশার পালন করার মাধ্যমে উপনয়ন সংস্কার করতে হবে


৪। বৈদিক মতে যজ্ঞ  বা হোম করার মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রকাশ করতে হবে এই মাধ্যমকে তিনি যোজ্ঞ ও হোম নামে অভিহিত করেছেন।

এই আচারগুলি ও অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে তিনি মূলত অন্য ধর্মালম্বীদের আত্মশুদ্ধি ধর্মীয় শিক্ষা ও সামাজিক স্বীকৃতির প্রতীক  হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রাথমিক ধাপ গুলি অতিবাহিত হবার পর একজন অন্য ধর্মালম্বী সনাতন ধর্মে প্রবেশের প্রথম ধাপ অতিক্রম করিবেন।

 
হিন্দু ধর্ম গ্রহণের পদ্ধতি সম্পর্কে বেদে কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়েছে তা হলোঃ

এ মনুষ্যগণ তোমরা ঈশ্বরের মহিমাকে বৃদ্ধি করো,  সমগ্র বিশ্বকে আর্যপথে দীক্ষিত করো।
ঋগবেদ  ৯/৬৩/৫
অর্থাৎ শুদ্ধি  যজ্ঞের মাধ্যমে যে কেউ অর্থাৎ বিশ্বের অন্যান্য ধর্মালম্বী যেমন মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে পারবেন।


শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন শুধুমাত্র তাকেই স্মরণ করতে তাহলেই তিনি সকলকেই নরক থেকে উদ্ধার পরমস্থান অর্থাৎ স্বর্গে জায়গা দিবেন। 

এটির অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনি সকল ধর্মালম্বীদের ক্ষেত্রে এই বাক্যটি প্রয়োগ করেছেন। তার মানে যে কেউ হিন্দু ধর্মে চলে আসতে পারবেন। 

 
শুদ্ধি  যজ্ঞের নিয়মঃ শুদ্ধি যজ্ঞ বা শুদ্ধিকরণ যজ্ঞ হল হিন্দু ধর্মে একজন ব্যক্তিকে আধ্যাত্মিক ও সামাজিকভাবে শুদ্ধ করে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার। এটি সাধারণত ধর্মান্তর, গুরুদীক্ষা ও পাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য করতে হয়। ঋষি দেবলের দেবল স্মৃতি গ্রন্থ অনুযায়ী শুদ্ধি যজ্ঞ মন্ত্র উচ্চারণ ও শুদ্ধি যজ্ঞের সম্পূর্ণ কার্যকিয়া সম্পাদন করে এ যোজ্ঞ করতে হয়। শুদ্ধি  যজ্ঞের প্রস্তুতি ;
১। পবিত্র পরিষ্কার ও নির্জন স্থান নির্বাচন করতে হবে।
২। অগ্নিকুণ্ড তৈরি করতে হবে  সকল উপকরণ সহ
৩। যজ্ঞের জন্য বিভিন্ন উপকরণের প্রয়োজন হবে যেমন পবিত্র কাঠ,ধুপ,  নৈবত্ত্য, ফুল, ফল, বসন ইত্যাদি।
৪। একজন দীক্ষিত  গুরুর প্রয়োজন হবে।
৫। আসমন ও সংকল্প করে যজ্ঞ শুরু করতে হবে।
৫। হিন্দু ধর্মীয় মতে নামকরণ করতে হবে
৬। সেই ব্যক্তির মনকে সনাতনী মনি অর্থাৎ হিন্দু ধর্মে জীবন উৎসর্গ করে দিতে হবে। এবং জন্মান্তর বাদে বিশ্বাসি হতে হবে।
এভাবেই একজনহিন্দু ব্যক্তিকে হিন্দু ধর্মে রুপাতর করা যায়


হিন্দু ধর্ম গ্রহণের মন্ত্রঃ

ॐ नमः सर्वेभ्यः वैदिकधर्मनिष्ठेभ्यः।

अहं ह्यस्मिन् सनातने धर्मे प्रविशामि।

ईश्वरं सत्यं वदामि। धर्मं चरिष्यामि। स्वाहा॥

বাংলা অনুবাদ:

"আমি সকল বৈদিক ধর্মানুগত সাধুজনকে প্রণাম জানাই। আমি এই চিরন্তন হিন্দু ধর্মে প্রবেশ করছি। আমি ঈশ্বরকে সত্য বলে মানি এবং ধর্মপথে চলার সংকল্প করছি।"

বর্তমানে ভারতীয় আর্য সমাজ, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, স্বামীনারায়ণ সংস্থা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সময়ে কনভার্ট হয়ে যাওয়া হিন্দুদের নিজ নিজ ধর্মে ফিরিয়ে আনা ও ভিন্নধর্মীদের হিন্দু ধর্মে গ্রহণ করতে সহযোগিতা করে আসছে। এক্ষেত্রে তারা কেবল দেবল স্মৃতির অনুসরণ করে তার পদ্ধতি গুলো অনুসরণ করে এই কাজগুলো সম্পাদন করছেন


এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে কারা বা কোন ব্যক্তি গুলো হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে পারবেন তার উত্তর হল ; পৃথিবীর যেকোনো ধর্মের যে কেউ ইচ্ছা করলেই হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা যায় ধরুন আপনি কারো প্ররোচনায় মাধ্যমে খারাপ ব্যক্তি হয়ে গেলেন কিন্তু পরিশেষে আপনি বুঝতে পারলেন আপনি খারাপ পথে আছেন। তাই আপনি সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন আপনি ভালো পথে আসবেন। ঠিক তেমনি কেউ হিন্দুধর্ম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেন এমন ব্যক্তি  বা অন্য ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসতে পারবেন।

কেন আপনি হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করবেন?


১। দার্শনিক গভীরতা ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কারণ হিন্দুধর্ম কোন একমাত্রিক বিশ্বাসে আবদ্ধ নয় এতে আধ্যাত্মিক মুক্তির বহু পথ আছে যেমন ভক্তি, জ্ঞান  কর্মযোগ ইত্যাদি।

 
২। কর্ম ও পূর্ব জন্মের তথ্য জানতে পারবেন শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মেই আর এই ধারণাটির মাধ্যমে জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধ, ধৈর্য ও ন্যায় বোধ জাগ্রত হয়।


৩। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীরতা অর্জনের জন্য সনাতন ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ কারণ এটি ধর্ম পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে আজ অবধি এ ধর্ম টিকে আছে এবং থাকবে। অর্থাৎ এটি হাজার বছরের প্রাচীন সংস্কৃতিআধ্যাত্মিক  সাধনার ফল রয়েছে যেমন আয়ুর্বেদ, ধ্যান, জ্যোতিষ, পুরান, সংস্কার ইত্যাদি


৪। ব্যক্তিগত উপলব্ধিপবিত্রতার উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে হিন্দু ধর্মে আসতেই হবে কারণ এটি দর্শন ও পথকে হৃদয়ে ধারণ করতে সহায়তা করে।
এছাড়াও হাজারো কারণ আছে যেমনধর্ম আত্মাকে শান্তি দেয় ও  জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে সাহায্য করে।

প্রার্থনা: হে বিশ্বনিয়ন্তা!তোমার কাছে মনের ভাব নিবেদন করে তোমার অমোঘ আশীর্বাদ কামনা করছি। তোমার শক্তিতেই আমি সুখে-দুঃখে একনিষ্ঠ ভক্তির কাজ করে এসেছি। আমাকে ভাব দাও, আর প্রাণের ভাবকে সরল ভাষায় প্রকাশ করার শক্তি দাও—যেন আনন্দমনে তোমার লীলা, শক্তি, বিশ্ব কর্তৃত্ব ও সর্বব্যাপীত্ব বর্ণনা করে ভক্তির মাধ্যমে মানুষ্যের সংশয় দূর করতে পারি।ভক্তির প্রভাবে যেন নর-নারী তোমাকে ডাকতে শেখে, ভালোবাসতে শেখে, আর এই ভবসাগর পার হওয়ার সঠিক পথ দেখে নিতে পারে। হে বিশ্বগুরু! আমাকে অভিমানের ঊর্ধ্বে রাখো, যেন লক্ষ্যচ্যুত না হই। শক্তি দাও, যেন ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে ভ্রান্ত পথে না যাই।তুমি আমাকে জ্ঞান দাও, বিজ্ঞান দাও, বিবেক দাও, ধৈর্য্য দাও, ধারণা দাও। তোমার দেওয়া শক্তিতে যেন সত্যের আলো হৃদয়ে চিরজাগ্রত থাকে। অকপট হৃদয় ও নির্ভরযোগ্য প্রাণে, সরল ভাষায়, যেন আমি পবিত্র আর্যধর্মের তত্ত্ব প্রকাশ করতে পারি।

উপসংহারঃ হিন্দু ধর্ম কাউকে জোর করে ধর্মান্তরিত করেনা এটা পৃথিবীতে প্রমাণিত। যে কেউ এর ধর্মে আসতে চাইলে তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার উপর বিশ্বাস করে আসতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url