হিন্দু ধর্মে মোট কতটি দেব-দেবী আছে? জেনে নিন তাদের নাম ও বিবরণ
তিনটি ব্যাখ্যার মাধ্যমে সনাতন/হিন্দু ধর্মের কতগুলো দেবদেবী রয়েছে ও তাদের মধ্যে সবার বড় কে তা পর্যালোচনা করার চেষ্টা করা হলো ঃ
দেব-দেবী ও ঈশ্বরের প্রকৃতি: সগুণ ও নির্গুণ ব্যাখ্যা
সবার আগে মনে রাখা দরকার, দেবতা বা দেবীরা আসলে ঈশ্বর নন। ঈশ্বরকে বলা হয় নির্গুণ, মানে তিনি সব গুণের উৎস, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট গুণে সীমাবদ্ধ নন। আবার তিনি সগুণও, কারণ ঈশ্বর চাইলে যেকোনো গুণ নিতে পারেন এবং সেটাকে আমাদের সামনে দেখাতে পারেন। যে গুণগুলো তিনি প্রকাশ করেন, সেগুলোই দেব-দেবীদের মূর্তির রূপ। অর্থাৎ, প্রতিটি দেবতা ঈশ্বরের কোনো একটা গুণের দৃশ্যমান রূপ।
ঈশ্বর আকারহীন, কিন্তু তিনি চাইলে বিভিন্ন রূপে আমাদের সামনে আসতে পারেন। নির্গুণ মানে গুণবিহীন নয়; বরং ঈশ্বর অসীম গুণের অধিকারী। অপরদিকে, সগুণ মানে গুণের সঙ্গে যা দেখা যায়। তাই, দেবতারা হলেন সেই সগুণ ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণের প্রতিফলন।
শাস্ত্রে বলা আছে ৩৩ কোটি দেবতা আছেন। অনেকে এই সংখ্যাকে সত্যি মনে করেন, কিন্তু বাস্তবে এটা ৩৩ প্রকার গুণ বা শক্তির চিহ্ন। যদি ৩৩ কোটি আলাদা দেবতা থাকত, তাহলে অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শনে তার ৩৩ কোটি মাথা দেখতে হতো। কিন্তু অর্জুন জানিয়েছেন, তিনি এমন একটি রূপ দেখেছেন যার শুরু ও শেষ নেই। অর্থাৎ, প্রতি মস্তক হল এক একটি গুণ বা দেবতা। তাই, ঈশ্বরের গুণের কোনো সীমা নেই—তাঁর প্রকাশও সীমাহীন।
![]() |
দেব-দেবী |
ব্যাখ্যাঃ২-আপনার প্রথমে জানা দরকার……
হিন্দু ধর্ম নয়, সনাতন ধর্ম—আসুন পরিষ্কারভাবে বুঝি
✔ হিন্দু বলতে কোনও ধর্ম নেই
“হিন্দু” শব্দটি কোনো প্রাচীন ধর্মের নাম নয়। এটি মূলত একটি ভৌগোলিক ও পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক পরিচিতি, যা ইন্দাস ভ্যালি (সিন্ধু নদী) অঞ্চলের মানুষের জন্য ব্যবহৃত হতো। ধীরে ধীরে এটি “ধর্ম” হিসেবে পরিচিতি পায়, কিন্তু আসলে এটি সনাতন ধর্ম—অর্থাৎ চিরন্তন ধর্ম।
✔ দেব-দেবী কোনো ধর্মের মালিক নন
প্রত্যেক ধর্মে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা থাকেন, কিন্তু কোনো ধর্মেই অসংখ্য দেবতা থাকে না। অথচ সনাতন ধর্মে দেখা যায় বহু দেব-দেবীর উল্লেখ—এটা আসলে ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির রূপ। প্রত্যেক দেবতা এক একটি শক্তির প্রতীক।
সনাতন ধর্মে দেবতাদের ব্যাখ্যা: বেদ বনাম পুরাণ
✔ বেদ ও উপনিষদে ৩৩ ধরনের দেবতার উল্লেখ
বেদ হলো সনাতন ধর্মের মূল গ্রন্থ। এখানে ৩৩ প্রকার শক্তি বা দেবতার কথা বলা হয়েছে—এরা প্রকৃতিরই শক্তি। যেমন:
সূর্য (প্রকাশ ও শক্তি)
অগ্নি (রূপান্তর ও ত্যাগ)
ইন্দ্র (শক্তি ও নেতৃত্ব)
বায়ু (চেতনা ও প্রাণ)
পৃথিবী, পানি, আলো—প্রত্যেকেই একটি শক্তির প্রতীক
এই দেবতাদের অনেককে আমরা দেখতে পাই, বাকিদের অনুভব করা যায় বা তাদের কার্যকারিতা বোঝা যায়।
✔ দেবতা ও দেবী আলাদা কিছু নয়
এরা একে অপরের বিপরীত নন—বরং একই শক্তির দুটি প্রকাশ। দেবতা মানে শুধুই পুরুষ না, দেবী মানেই শুধুই নারী না—তাঁরা হলেন ঈশ্বরের শক্তির বিভিন্ন রূপ।
পুরাণ ও আধুনিক মিথের পার্থক্য
☞ পুরাণ কী?
পুরাণ মানে "পুরাতন কথা"—কিছু প্রাচীন গল্প ও ব্যাখ্যা, যা অনেক সময় প্রতীকী বা কাল্পনিক। এগুলোতে অনেক দেব-দেবীর কাহিনী রয়েছে—যার অধিকাংশই রূপকভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত। যেমন:
বিষ্ণুর বিশ্বরূপ (মোহ কৃষ্ণ/বিশ্বরূপ)
শিবের তাণ্ডব
দুর্গার অসুরবিনাশ
পুরাণে কত দেবতা থাকবে তা নির্দিষ্ট নয়—দুইজনও হতে পারে, হাজারজনও হতে পারে। কারণ এরা কাহিনীর চরিত্র। যেমন, সুপারম্যানের গল্পে আপনি আয়রনম্যানকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বানাবেন না—এটা একই যুক্তি।
সংক্ষিপ্তভাবে:
✅ "হিন্দু ধর্ম" আসলে সনাতন ধর্ম
✅ দেবতারা ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ বা শক্তির প্রতীক
✅ বেদে ৩৩ প্রকার দেবতার কথা আছে, পুরাণে হাজারো চরিত্র
✅ দেবতা বা দেবী—কারও চেয়ে কেউ বড় নয়, সবাই ঈশ্বরের প্রকাশমাত্
আরো কত হাবি জাবি উদাহরণ আছেইত্যাদি ইত্যাদি
ব্যাখ্যাঃ৩-দেবতা কি জিনিস আগে তা জানা উচিত।দেবতার পরিচয়?,দেবতার স্বরুপ কি?
দেব শব্দের অর্থ কী? নিরুক্তির মাধ্যমে দেবতার প্রকৃত পরিচয়
দেব শব্দের অর্থ কী? নিরুক্তি ও বেদের আলোকে দেবতার প্রকৃত স্বরূপ
দেব' শব্দের ব্যুৎপত্তি, বেদে তার ব্যবহার ও নিরুক্তির মাধ্যমে জানুন দেবতা বলতে কী বোঝায়। আলো ও জ্যোতির প্রতীক দেবতার প্রকৃত স্বরূপ কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
দেব শব্দের অর্থ, দেবতা মানে কী, নিরুক্তি ব্যাখ্যা, বেদে দেবতা, দেবতার স্বরূপ
🔹 নিরুক্তি: শব্দ বিশ্লেষণের বৈদিক পদ্ধতি
বৈদিক সাহিত্যে প্রতিটি শব্দের গভীর তাৎপর্য রয়েছে। সেগুলোর মূল ব্যাখ্যার জন্য নিরুক্তি বা শব্দের উৎস-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অপরিহার্য। ‘দেব’ শব্দটিও ঠিক তেমনই একটি শব্দ, যার ব্যুৎপত্তিগত মূল ‘দিব’।
🔹 ‘দেব’ শব্দের উৎপত্তি: ‘দিব’ থেকে ‘দী’
‘দেব’ শব্দ এসেছে ‘দিব’ থেকে। তবে বেদে ‘দিব’ ধাতু হিসেবে নয়, প্রাতিপাদিক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে—অর্থাৎ এটি একটি নামরূপ (noun)। ধাতু হিসেবে এখানে ব্যবহৃত হয়েছে ‘দী’, যার অর্থ:
দীপ্তি দেওয়া
আলো ছড়ানো
ঝলমলে হওয়া
ই ধাতু থেকেই উঠে এসেছে ‘দেব’, যার মূলে রয়েছে আলোকময়তার ধারণা।
🔹 দিব, দিবা ও দেব — একটি অভিন্ন ভাবনা
‘দিব’, ‘দিবা’, এবং ‘দেব’—এই তিনটি শব্দ একই ধারণাকে প্রকাশ করে:
👉 আকাশে আলো থাকা মানেই 'দিব্য'
👉 দিনকাল মানেই ‘দিবা’
👉 আর সেই আলো ও জ্যোতির প্রতীক যিনি, তিনিই ‘দেব’
অর্থাৎ, যতক্ষণ আকাশে আলো আছে, ততক্ষণ সে 'দিব্য'—তেমনি, যিনি সেই আলোকে ধারন করেন, তিনিই দেব।
🔹 দেবতার প্রকৃত স্বরূপ: আলো ও জ্যোতির প্রতীক
বেদের দৃষ্টিতে, দেবতা মানেই হলেন আলোর প্রতীক।
তাঁরা হলেন সেই চেতনার দীপ্ত রূপ, যাঁরা নিজ গুণে ও আলোয় বিশ্বকে আলোকিত করেন।
এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে বোঝা যায়, দেবতা কোনো ব্যক্তি বা অবতার নন, বরং ঈশ্বরের জ্যোতির্ময় গুণের একটি রূপ।
🧘♂️ পাঠকের জন্য চিন্তার খোরাক:
আপনি যখন দেবতার কাছে প্রার্থনা করেন, আপনি আদতে জ্যোতির কাছে প্রার্থনা করছেন—জীবনের অন্ধকার দূর করে আলোকময় পথের জন্য।
হে দেবতা, অপারিত করো এই অন্ধকার,
ভরে দাও এ চক্ষু আলোকের স্পর্শে,
মুক্ত করো আমাদের—যারা পাশে বদ্ধ হয়ে রয়েছি!
আবার জীবনের প্রাচীমূলে, উষার আলোয়
প্রাতঃসঞ্চিত আভা যখন ফোটে,
ঋষি কুত্সের কণ্ঠে শুনি উদ্বোধিনী বাণীর উল্লাস:
“ওঠো, উত্থিত করো নিজেদের!
যা আমাদের জীবন, যা আমাদের প্রাণ—তা-ই এসেছে।
দূরে স’রে গেল অন্ধকার, এই যে আলো আসে,
খুলে দিল সূর্যের যাত্রাপথ।
সেইখানে পৌঁছলাম আমরা, যেখানে সবার আয়ুর পতরণ।”
দেবতারা ‘সুজ্যোতিঃ’—তমস্ হতে জ্যোতিতে উত্তরণই
জীবনের দিব্য নিয়তি। ঋক্-সংহিতা হতে
এই জ্যোতির্ভাবনার অনুকূল মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে,
দেবতাদের স্বরূপের পরিচয় আমাদের কাছে স্পষ্ট হোক।
অধ্যাত্মসিদ্ধির প্রতিচ্ছবি সূর্যোদয়ে—
অন্ধকার থেকে আলোর উত্সারণে।
দেবতা আকাশে সূর্যকে ফুটিয়ে তোলেন,
“জ্যোতির্দ্ধারা তমসো বিদ্ধং—” (অন্ধকার বিদীর্ণ হোক জ্যোতিতে)।
বহু মন্ত্রে এ কথার খোঁজ মেলে। বাইরের জগৎ যদি হয় শূন্য, ভেতরের জগৎ তবে চৈতন্য; সেখানে সূর্যোদয় যেন প্রার্থনাকারীর শেষ চাওয়া। দেবতা সেই চাওয়ার দাম দেন। নিজের আলো দিয়ে অন্ধকারের গর্ত থেকে আলো বের করে আনেন। যে অন্ধকার বৃত্রের মতো প্রার্থনাকারীর মন ঢেকে রাখে, দেবতা তাকে আলো দিয়ে হারান। আগুনের জন্ম যেন ঝলমলে, আলো দিয়ে অন্ধকার তাড়ান, খুঁজে পান আলো আর সূর্য; অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসেন আলো নিয়ে। ঋষির মতো আলো দিয়ে যেন ঝলসে দেন অজ্ঞানতাকে, সত্যকে যে বাঁকা করে; আকাশ আর পৃথিবীর মাঝে যে অন্ধকার, তাকে তিনি আলো দিয়ে সরিয়ে দেন। ভোরের আলো যেমন রাতের পর্দা টানে, তেমনি দেবতারাও অন্ধকার সরিয়ে দেন দুধের মতো আলো ঝলমলে মহিমা দিয়ে। জগতের নেতা ইন্দ্র আকাশ আর পৃথিবী জুড়ে আছেন আলো দিয়ে, যে অন্ধকার সরানো কঠিন তাকে সেলাই করে ছোট করে আনেন; গুহার ভেতর ছিল যে আলোর ধেনু, তাদের তাড়িয়ে বের করলেন তিনি, একসঙ্গে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারকে আলোর দ্বারা দেখালেন। সুন্দরী নারীর মতো উষা তার শরীর চেনেন, উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যেন আমাদের চোখের সামনে, স্নান করছেন, শত্রুদের অন্ধকারে ডুবিয়ে দিবোদুহিতা এসেছেন আলো নিয়ে; দেবী উষা চলছেন আলো দিয়ে হারিয়ে যাওয়া অন্ধকারকে সরিয়ে; তিনি জেগেছেন নতুন জীবন দিয়ে, অন্ধকারকে আলো দিয়ে ঢেকে এগিয়ে চলেছেন যুবতী হয়ে, সূর্যের যজ্ঞের আগুনে চেতনা আনছেন। যে সূর্য সবকিছু চালায়, তিনি যেন আমাদের দুর্বলতা, অভাব আর খারাপ স্বপ্ন দূর করেন তাঁর আলো দিয়ে, যা অন্ধকারকে হারায়, যে আলোতে জগৎ জেগে ওঠে।
পৃথিবীর বুকে আগুন সেই আলো, মনু যাকে রেখেছেন সবার জন্য; তিনি হলেন জমাট বাঁধা আলো, বড় আলো, বিশাল আলো—দেবতারা তাঁকে জন্ম দিয়েছেন 'চিত্তি' বা বুদ্ধি দিয়ে; আবেগে ভরা কথার মধ্যে যে আলোর আনন্দ, তিনি তার মালিক। আকাশের শেষ প্রান্তে ইন্দ্র সেই সূর্য, যিনি প্রার্থনাকারীকে পার করেন সেই বিশাল আলোকময় স্থানে, যেখানে অন্ধকার আর পৌঁছাতে পারে না। ঘোর অন্ধকারের মাঝে যে আলো তিনি জ্বালান ভক্তের জন্য, তা কেউ কেড়ে নিতে পারে না; এই আলোর ঝলক তিনি নিয়ে আসেন তারই জন্য, যে মন ও প্রাণের সাধনা করে; অন্ধকারের সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি আলো ফোটান, নিয়ে চলেন আরও আলোর দিকে। আকাশে আছে দুই দেবতা অশ্বিনীকুমারের আলো; তাঁরা আলো দেন সবার জন্য, আর্যদের জন্য, জ্ঞানী প্রচারকের জন্য। আছে উষার আলো: সুন্দরী উষা আলো ফোটান; তিনি ঝলমলিয়ে ওঠেন যখন, তখন দেখি জগতের প্রাণ আর জীবন তাঁর ভেতরে; সব আলোর সেরা আলো তিনি; দিবোদুহিতা তিনি আলোর পোশাক পরা; শরীরে নানা রঙের খেলা দেখান নর্তকীর মতো, বুক খুলে দেন, সারা বিশ্বের জন্য আলো জ্বালিয়ে অন্ধকার সরান; এই তো সেই আলো চোখের সামনে অন্ধকার থেকে জেগে উঠছে পথের দিশা নিয়ে, এই তো দিবোদুহিতা উষারা আলো ঝলমল পথ করে দিলেন মানুষের জন্য; এই তো দিবোদুহিতা মানুষের সামনে এসে কল্যাণী নারীর মতো রুপের ধারা ঝরান....আবার আগের মতোই যুবতী হয়ে ফোটান আলো; তাঁর আলোর ধেনুরা অন্ধকারকে ছোট করে আনে, আলোকে খাড়া করে সবিতার দুই হাতের মতো; লাল রঙের উষা দেখা দিলেন, আলো ফোটালেন সত্যের ধারক। আছেন সূর্যের আলো: আকাশ আর পৃথিবী আর মাঝের স্থান ভরে দিয়েছেন সূর্য তাঁর আলো দিয়ে; চিন্ময় হয়ে সূর্য আলোর শরীর, চলছেন সুন্দর অস্ত্র হয়ে; নিজের মহিমায় দেবতাদের পুরোহিত তিনি, তিনি সেই আলো যাকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না; বিশাল আলো নিয়ে আসেন তিনি, সবকিছু দেখেন, ঝলমলে, চোখের আনন্দ; চিরকালের তারা তিনি, সবার আলো; আকাশের নিয়মে ও ধরনে থাকা অসুরঘাতী শত্রুঘাতী আলো তিনি; ইনি আলোর মধ্যে সেরা ও ভালো আলো, ইনিই বিশ্বজয়ী ধনজয়ী, একেই বলে বড়, ইনিই এই বিশ্বকে ধরে আছেন বিশ্বকর্মা হয়ে, বিশ্বদেবতার মহিমায় ইনি বধু আলোর জরায়ুর মতো; ইন্দ্র যখন অহিরূপী বৃত্রকে মারেন তাঁর আনন্দে, তখনই এই সূর্যকে আকাশে তোলেন দেখানোর জন্য; সূর্য আত্মা যা চলছে তার, যা স্থির আছে তারও। আছেন অদিতির ছেলেরা যাঁরা জীবনের জন্য অনেক আলো দেন মর্ত্যের মানুষকে। আছে সোমের আলো, যাকে পাওয়া যাগ্যকারীর সবচেয়ে বড় কাজ: সোম দেন চিরকালের আলো, চিরকালের সূর্যের আলো....আমাদের করেন আরও আলোকময়; তাঁর ধারা আলো নিয়ে আসে আমাদের জন্য; পরিষ্কার হতে হতে জন্ম দেন তিনি আকাশ থেকে সুন্দর বজ্রের মতো আলো; জন্ম দেন তিনি সত্যকে বড়কে আলোকময় মৃত্যুকে কালো অন্ধকারদের মরণ হেনে হেনে; তাঁর রস শক্তি হয়ে ঝলমল করে বিশ্বআলোরুপে সূর্যের দর্শনের জন্য; তাই তো তাঁর সত্য দিনের জন্য
![]() |
জ্যোতিই দেবতার স্বরূপ |
তিনি রচনা করেন জ্যোতি এবং জগতের বিশালতা। তাঁর সৃষ্টি বিপুল জ্যোতির—এই জ্যোতি উদ্দীপ্ত করে তোলে দেবতাদের চেতনাকে। তিনি ইন্দ্রে প্রেরণা দেন অপরাজেয় ওজস্বিতার, আবার সূর্যের মধ্যে সৃষ্টি করেন দীপ্তিময় জ্যোতির, নিজে ইন্দু রূপে আবির্ভূত হয়ে। জ্যোতির সমস্ত প্রকাশই তাঁরই; সূর্যও তাঁরই দীপ্ত প্রতীক।
তিনি আদিম—আদিতম সত্তা—যিনি জ্যোতিদের দীপ্তিতে আমাদের পথ দেখান। তিনি দান করেন শান্তি, প্রসারিত মহাভূমি ও অসংখ্য জ্যোতির ঝলক, যেন আমরা দীর্ঘকাল ধরে সূর্যের আলো দর্শন করতে পারি, তা অনুভব করতে পারি।
অন্যদিকে, যেসব আলোকধেনুরা (আলোকপ্রতীক গাভী) ছিল অনৃত (মিথ্যা বা অন্ধকারের) বন্ধনে গোপন, সেই আলোকের খোঁজে বৃহস্পতি প্রবেশ করেন তমিস্রার (অন্ধকার) গভীরে। তিনি সেই আলোকে খুঁজে বের করেন—নিচের দুটি ও উপরের একটি পথ দিয়ে, প্রতিটি পথ দিয়ে আলোককে করেন উন্মোচিত।
এই আলোচনায় আমরা উপলব্ধি করি—জ্যোতিই দেবতার স্বরূপ। অন্ধকারের ভেতর থেকে জ্যোতিরই উত্থান, আর সেই উত্থানেই দেবতাদের মহিমা প্রকাশ পায়। এই জ্যোতিই আমাদের নিত্যপ্রয়োজন, আমাদের কাম্য। এটি যেমন আছে পরমব্যোমে, তেমনি দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত অগ্নিতেও জ্বলছে সেই একই বিশাল জ্যোতি—ইন্দ্রপ্রদত্ত সৌরআলোকময় অভয় জ্যোতি।
এ সেই প্রথম বীজের ঝলমল জ্যোতি,আধারে যা নিগূঢ় হয়ে রয়েছে-সত্যমন্ত্র পিতারা যাকে পেয়ে উষার জন্ম দিয়েছেন।জ্যোতির অন্তরে এই জ্যোতি তিনটি আবর্তে উঠে গেছে উপরপানে হয়েছে দ্যুলোকে নিত্যজাগ্রত সেই উত্তম জ্যোতি যা তমিস্রার ওপারে উত্তরজ্যোতিকেও ছাপিয়ে গেছে।এই জ্যোতি হতে প্রবাসী হতে আমরা চাই না।ডান বা বাঁ আমরা চিনি না,সমুখ বা পিছনও চিনি না;মূঢ়তাতেই হক আর ধীরতাতেই হক,সেই অভয় জ্যোতির সম্ভোগ আমরা চাই,আলোর দেবফা আদিত্যেরা যা আমাদের কাছে নিয়ে আসবেন।বেঁচে থাকতেই আমরা যেন জ্যোতির আস্বাদ পাই
।এই জ্যোতি সবার জন্য:বৈশ্বানররুপী এই দেবতাকে এই জ্যোতিকে দেবতারা জন্ম দিয়েছেন আর্যের জন্য;ইন্দ্র এই আর্য জ্যোতিকে এই সৌরদীপ্তিকে খুঁজে পেয়েছেন মনুর জন্য;বিশ্বজনীন এই অমৃত জ্যোতি,বিশ্বমানবের দেবতা সবিতা একে আশ্রয় করে উদিত হয়েছেন।এই জ্যোতি সর্বত্র:হংসরুপে এই জ্যোতি নিষণ্ণ আছেন শুচিতে,আলোরুপে অন্তরিক্ষে,হোতৃরুপে বেদিতে,অতিথিরুপে দ্রোণে;নিষণ্ণ রয়েছেন নরের মধ্যে,বরেণ্যের মধ্যে,ঋতের মধ্যে,ব্যোমের মধ্যে;জন্মেছেন তিনি অপ হতে গো হতে ঋত হতে অদ্রি হতে;তিনি ঋত এবং বৃহৎ।অগ্নির মধ্যে এই বিশ্বরুপ বৈশ্বানর জ্যোতিকে প্রত্যক্ষ করে ঋষি ভরদ্বাজ বলছেন: এই যে প্রথম হোতা,একে তোমরা চেয়ে দেখ।মর্ত্যের মধ্যে ইনিই অমৃত জ্যোতি।এই যে তিনি জন্মেছেন,ধ্রুব-রুপে এই যে নিষণ্ণ তিনি অমর্ত্য হয়ে তনুর সঙ্গে বেড়ে চলেছেন।ধ্রুব জ্যোতিরুপে নিহিত তিনি সবস্র মধ্যে-দেখা দেবেন বলে;যারা উড়ে চলে তাদের মধ্যে মন তিনি দ্রততম।বিশ্বদেবতারা এক মন এক চেতন্স নিয়ে এক ক্রতুর পানে চলেছেন সুচ্ছন্দে ল।উড়ে চলুক আমার দুটি কান,উড়ে চলুক চোখ,উড়ে এই জ্যোতি-হৃদয়ে যা আহিত।আমার মন যে বিচরণ করছে সুদুরের ভাবনায়:কীই বা বলন আমি,কীই-বা ভাবব?বিশ্বদেবতারা প্রণাম করলেন ভয়ে-ভয়ে তোমায় হে অগ্নি,তমিস্রার মধ্যে ছিলে যখন।বৈশ্বানর আমাদের আগলে থাকুন কল্যাণের জন্য,অমর্ত্য আমাদের আগলে থাকুন কল্যাণের জন্য।এই জ্যোতির সাধন বাইরে যেমন যাগ,অন্তরে তেমনি যোগ:মনন আর জ্যোতির প্রজ্ঞান হয় হৃদয় দিয়ে...দ্যুলোক আর ভূলোকের সব তখন দেখা যায়
মনকে ধরে রেখেছে যে-সুকর্মারা,তারাই দ্যুলোকক্র রুপ দেয় ত্বষ্টার মত।জ্যোতিকে তারা পায়,ধ্যান দিতে তাকে রুপ দিতে চায় যখন।আমাদের প্রতি তাই এই আর্য অনুশাসন:যজ্ঞের তন্তুকে বিতত করে অনুসরণ কর প্রাণ লোকের ভাতিকে;ধ্যান দিয়ে রচেছ যে জ্যোর্তিময় পথ,আগলে রাখ তাদের।গ্রন্থি না পড়ে এমনি করে বয়ন কর গায়কদের কর্ম।মনু হও,জন্ম দাও দিব্য জনকে।কেননা,আমাদের পিতৃপুরুষরা ধ্যান করে করেই বিপুল জ্যোতিকে পেয়েছিলেন।আর তাই আমরা বলতে পারি:আমরা পান করেছি সোম,আমরা অমৃত হয়েছি;আমরা গিয়েছি জ্যোতিতে,পেয়েছি দেবতাদের।এই ব্রহ্মঘোষেই জ্যোতিরেষণার পরিসমাপ্তি।দেবতার স্বরুপ জ্যোতি।আকাশের সূর্য তার প্রতীক।সূর্যের যেমন আলো আছে,তেমনি আছে তাপও।আলো প্রকাশ করে,তাপ বা তপঃ সৃষ্টি করে।অধ্যাত্ম-দৃষ্টিতে একটি প্রজ্ঞা,আরেকটি শক্তি।একটি থেকে আরেকটিকে পৃথক করা যায় না।আবার সূর্য আদিত্য কিনা অদিতির পুত্র।অদিতি সংজ্ঞার অর্থ অখণ্ডিতা,অবন্ধনা।তিনি অনন্ত্যস্বরুপিণী,আকাশ তার প্রতীক;তাঁর কথা পরে বলছি।আকাশে আদিত্য জ্যোতি এবং তাপ বিকিরণ করছেন-দেবতার এই প্রত্যক্ষদৃষ্ট বৈভব বৈদিক অধ্যাত্মভাবনার উদ্দীপক।আকাশ জ্যোতি এবং তপ এই তিনটি ভাবনাই একান্তভাবে দেবভাবনার সহচরিত।জ্যোতির কথা বলেছি,এখন আকাশের কথা বলছি।ঋকসংহিতায় আকাশের দুটি সংজ্ঞা প্রধান একটি 'দিব্' আরেকটি 'র্যোমন্'।প্রথমটিতে রুপের দ্যোতনা আছে,দ্বিতীয়টিতে নাই-আছে শুধু ব্যপ্তি আর তুঙ্গতার ইশারা।সংহিতায় লোক বা চেতনার ভূমির সাধারণ সংজ্ঞা 'রজঃ'।ব্যোম তারও ওপারে,অর্থ্যাৎ ব্যোম লোকোত্তর।প্রায় সর্বত্র শব্দটির সঙ্গে পরম বিশেষণ দেওয়া আছে।পরম ব্যোম তাহলে সেই লোকোত্তর মহাশূন্যতা যার ওপারে আর কিছুই নাই।তাই এ আবাত প্রথম ব্যোম যা দেবতাদের সদিন;পূর্ব্য ব্যোম,যেখানে তিনবার করে সোমের জন্য সপ্ত ধেনুরা ক্ষরণ করে সত্য আশীঃ।পরম ব্যোমে প্রত্ন পিতার পদ বা ধাম।সেই অক্ষর পরম ব্যোম যেখানে বিশ্বদেবেরা নিষণ্ণ আছেন,ঋকেরা সেইখানেই আছে;সেই পরম ব্যোমেই গৌরী বাক্ সহস্রাক্ষরা।এই পরম ব্যোমে মিত্র-বরুণ রয়েছেন সত্যধর্মা হয়ে,এইখানেই মহাজ্যোতি হতে বৃহস্পতির জন্ম সবার প্রথমে,জন্মেই ইন্দ্রের সোমপান এইখানেই মহাজ্যোতি হতে বৃহস্পতির জন্ম সবার প্রথমে,জন্মেই ইন্দ্রের সোমপান এইখানে,এইখানে বিশ্বভূবনের জনক বৈশ্বানরের জন্ম।এই পরম ব্যোমে ইন্দ্র রোদসীকে ধরে আছেন,ভগ যেমন ধরে আছেন তাঁর দুই পত্নীকে।বিশ্বভূবনের অধ্যক্ষ যিনি,তিনি আছেন পরম ব্যোমে;এইখানেউ বিশ্বদেবেরা স্বরাট ইন্দ্র আর সম্রাট বরুণের মধ্যে ওজ এবং বল আধান করছেন।অপ্সরা তরুণী হেসে হেসে বধুকে নিয়ে যান পরম ব্যোমে।
পরম ব্যোমেই যজ্ঞের শক্তি বা সার্থক পরিণাম,ইষ্টাপূর্তেরও;যে যঘ ভূবনের নাভি,তার অধিষ্ঠাতা ব্রহ্মা যিনি,তিনিই বাকের পরম ব্যোম।এককথায় অসৎ আর সৎ দুইই এই পরম ব্যোম চেতনার তুঙ্গতম ভূমি।ঋকসংহিতায় আরও পরিচয় পাই 'অনিবাধ' 'উরুলোক' এবং 'বৃহতের' ভাবনায়।বিশ্বদেবগণের উদ্দেশে অত্রির আকুতি: হে দেবগণ,আমরা যেন বিপুল অনিবাধে থাকতে পারি।অনিবাধের বিপরীত একটি সংজ্ঞা হল সবাধ,সাধারণভাবে বোঝায় ঋত্বিককে: ব্যুৎপত্তিলভ্য অর্থ হল যার মধ্যে বাধ বা চেতনার সঙ্কোচ আছে।বাধ হতে অনিবাধে বা চেতনার বৈপুল্যে উত্তীর্ণ হওয়াই উপাসকের পরম পুরুষার্থ।ঋতের যোনিতে বা পরম অব্যক্তে(শিশুরুপে) শুয়ে আছেন যে অগ্নি এই ঘরকে ভালবেসে,তিনি মহান হয়ে বিপিল অনিবাধে বেড়ে চলেছেন।পৃথিবীর অগ্নির মতো আকাশের সূর্যও এক অনিরুদ্ধ, অনিবদ্ধ শক্তির প্রতীক। তিনি যেন সীমাহীন, কোনও বন্ধনে আবদ্ধ নন। হঠাৎই, এক রহস্যময় উপায়ে, তিনি হেটমুণ্ডে (উল্টোমুখে) নেমে আসেন না—কে দেখেছে, কোথা থেকে বা কোন স্বপ্রতিষ্ঠা থেকে তিনি চলছেন! তিনি যেন স্বয়ং দ্যুলোকের (স্বর্গলোকের) শক্তিশালী স্তম্ভ হয়ে আত্মপ্রকাশ করছেন, রক্ষা করছেন উত্তর দিকের অজানা লোক বা জগতকে।
তিনটি মন্ত্রের মধ্যেই রয়েছে মহাশূন্যে চেতনার বিস্ফারণ এবং স্বচ্ছন্দ গতির এক গভীর ব্যঞ্জনা। এই মুক্ত, অবারিত চেতনা থেকেই উদ্ভাসিত হয় এক নতুন লোক—আলোকের ভূবন। এই লোক স্বভাবতই পরিব্যাপ্ত এবং বিপুল, কারণ আলোকের স্বভাবই হলো ছড়িয়ে পড়া, চারদিকে বিস্তার লাভ করা।
তাই তার পারিভাষিক সংজ্ঞা উরুলোক।যে কল্যাণকৃৎ,অগ্নি তার জন্য রচেন আনন্দন উরুলোক;বৃহতের ভাবনায় বর্ধিত হয়ে তাঁর সঙ্গে তাকে রচেন সোমও-যজ্ঞের জন্য।যে ইন্দ্র আমাদের সখা,পিতা,পিতৃগণের মধ্যে পিতৃতম,তারুণ্যের বিধাতা যিনি,এই উরুলোক রচেন তিনি উতলা যজমানের জন্য-সুসবনকৃৎ বীরের জন্য তাঁকেই যে চায় তার জন্য,সহজে যে দেয় তাহা তার জন্য,তৃৎসুদের জন্য।বৃত্র বা আঁধারের আবরণ বিদীর্ণ করে তিনি রচেন এই আলোর ভুবন,অমিত্রশীল জনকে অপনোদিত করে রচেন দেবতাদের জন্য।তাঁর সোম্য মত্ততা বীর্যবর্ষী,স্পর্ধার অভিভাবী,এই উরুলোকের রচয়িতা।আবার ইন্দ্র বিষ্ণুকে,সোমমে,বরুণকে নিয়েও এই ভুবন রচনা করেন।দেবতাকে ডাকলে পরে যে বৃহস্পতি আমাদের মত লোকের জন্যও রচেন আলোর ভুবন,তিনি বৃত্রকে হনন করে বিদীর্ণ করেন তার পুরী,জয় করেন শত্রুদের,অমিত্রদের স্পর্ধাকে করেন অভিভূত।পবমান সোম দিনের জন্য ফোটান জ্যোতি আর লোকের বৈপুল্য।এই উরুলোক চাই জীবনে,পাই যেন মরণেও।চেতনার আকাশবৎ অনিবাধ বৈপুল্যের আরেক সংজ্ঞা হল বৃহৎ।শব্দটি ক্লীবলিঙ্গে ব্যবহার করা হয়।ঋতং বৃহৎ ঋকসংহিতায় একটি পারিভাষিক পদগুচ্ছ ,বোঝায় ছন্দ এবং বৈপুল্য একাধারে।এটি পরম তত্ত্বের ব্যঞ্জনবাহী।অগ্নি যে দেবগণের যজন করেন,তা এই ঋতং বৃহৎ এরই যজন,অথবা তিনি নিজেই ঋতং বৃহৎ।সূর্যও তসি।আবার সোমও তাই।এই পবমান সোম যে শত্রুজ্যোতির জন্ম দেন,তা ঋতং বৃহৎ,তা-ই দিয়ে কৃষ্ণ তমিস্রাকে তিনি হনন করেন।সমুদ্র পার হয়ে চলেন তিনি ঢেউএ-ঢেউএ-জ্যোর্তিময় রাজা তিনি ঋতং বৃহৎ;ছুটে চলেন মিত্র আর বরুণের ধর্ম মেনে-যখন প্রচোদিত হন তিনি ঋতং বৃহৎ।সহস্রধার বীর্যবর্ষী তিনি,পয়োবর্ধম,দেবজাতির প্রিয়;ঋত হতে জাত তিনি,ঋতেই বেড়ে চলেছ্রন--জ্যোতির্ময় রাজা যিনি ঋতং বৃহৎ।এক জায়গায় বিশ্ব-দেবগণের পৃথিক উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরই মতন কিরে উল্লিখিত হয়েছে ঋতং মহৎ স্বর বৃহৎ।এই আরেকটি সংজ্ঞা লক্ষণীয়: বৃহদ্দিব (স্ত্রীলিঙ্গে বৃহদ্দিবা),যা সহজেই আলোঝলমল আকাশের বৈপুল্যকে স্মরণে আনে।লোক বা ভুবন বোঝাতে সংজ্ঞাটির কোনও প্রয়োগ পাওয়া যায় না।এছাড়া অগ্নি ইন্দ্র বৃহদ্দিব,সরস্বতী বৃহদ্দিবা,উর্বশীও ফাই।এক অজ্ঞাতনাম্নী দেবী বৃহদ্দিবা;অন্যত্র তিনি শুধু মাতা বলে উল্লিখিত হয়েছেন।সেইসঙ্গে পিতা ত্বষ্টার উল্লেখ থাকায় মনে হয় বৃহদিব্বা আদিজননীরই একটি সংজ্ঞা।আবার বিশ্বদেবগণ বৃহদ্দিব।
সংজ্ঞাটি এমনি অর্থবহ যে শেষপর্যন্ত তা ঋষির নামে পর্যবসিত হয়েভহে।দেবতার সঙ্গে সাযুজ্যবোধই যে সাধনার চরন লক্ষ্য,এটি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।দেবতা বৃহৎ দ্যুলোকে বৃহৎ,মানুষেও বৃহৎ।বৃহতের এই ভাবনার নিঙ্কর্ষণ দেখি উপনিষদের ব্রহ্মবাদে।আকাশে মত অনিবাধ বৈপুল্যে বৃহৎ যিনি,তিনি ব্যাপ্ত হয়ে আছেন সর্বত্র।এইটি বোঝাতে দেবিতার একটি বিশেষ্ণ 'বিশ্বমিনব'।অগ্নি বিশ্বমিন্ব,যাকে তিনি ছেয়ে থাকেন,সে হয় নিখিল(অগ্নি) স্রোতঃসম্পদে আধার।মরুদগণ,ইন্দ্র,উষা,সবিতা,পূষা,জ্যোতির দুরারেরা,দ্যাবাপৃথিবী,বিশ্বদেবগণ সবাই বিশ্বমিন্ব।অন্তর্যামীরুপে সব মানুষের মধ্যেই তিনি,তাই দেবতা বিশ্বানর।যিনি সর্বব্যাপ্ত সর্বগত সর্বনিয়ন্তা,তিনিই সব-কিছু হয়েছেন--তিনি বিশ্বরুপ।ইন্দ্র রুপে-রুপে প্রতিরুপ হয়েছেন,তাঁর সে-রুপ চেয়ে দেখবার মত;বিচিত্র মায়ায় বহুরুপ হয়ে চলছেন তিনি।অধিষ্ঠাতাকে ঘিরে আছে সবাই;বিচিত্র শ্রীর বসন পরে চলছেন তিনু স্বয়ম্প্রভ:বীর্যবর্ষী অসুরের সেই নাম যে মহৎ;বিশ্বরুপ হয়ে তিনি অমৃতসমূহে অধিষ্ঠিত।রুপে রুপে বিচিত্র হয়েভহে মঘবস(ইন্দ্র) মায়া রচে তাঁর আপন তনুকে ঘিরে।তিনি বিশ্বভূ অর্থাৎ তিনিই এই বিশ্ব হয়েছেন।বিশেষ করে ত্বষ্টা বিশ্বরুপ;বার তাঁর পুত্রও (ত্বাষ্ট্র) বিশ্বরুপ।অর্থাৎ বিশ্বকে দেবতার আত্মসম্ভূতি বা বিসৃষ্টি দুভাবেই দেখা যেতে পারে।
বিশ্বের উৎপত্তি অগ্নিস্বরুপ বৃষভ-ধেনুর একটি মিথুন হতে: এই বৃষভ বিশ্বরুপ-তিনটি তাঁ বুক,তিনটি পালান,তিনটি মুখ,শক্তিমান তিনি সবার অধিপতি,সমস্ত ধেনুর রেতোধা তিনি বহুধা প্রজাবান;এই ধেনু 'বিশ্বরুপা'-দক্ষিণা উষার রথের ধুরায় যুক্তা মাতা তিনি,তাঁর ভ্রূণ ছিল আবর্তদের মধ্যে,তিন যোজন দূরে তাঁকে দেখে বাছুরটি কেঁদে উঠল।বৃষরুপে বৃহস্পতিও বিশ্বরুপ;সোমও তাই।এককথায় সেই একই হয়েছেন এই সব-কিছু।
তাঁর এই বিভূতির বর্ণনা আছে পুরুষ সুক্তে:তিনি সহস্রশীর্ষা সহস্রাক্ষ সহস্রপাৎ বিশ্বরুপ পুরুষ-কেননা বিশ্বে যত শীর্ষ যত অক্ষি যত পদ সই তাঁর;তিনিই ভূত-ভব্য এই সব-কিছু হয়েছেন,এই বিশ্বভূত তাঁর একপাদ,তাঁর ত্রিপাদ দ্যুলোকে অমৃত হয়ে আছে।দেবতা যখন আমিই এইসব হয়েছি,তখন তাঁর সঙ্গে এক হয়ে মানুষও বলতে পারে,'আমিই সব হয়েছি';অঙ্গিরারাও তাই বিশ্বরুপ।তাহলে দেখতে পাচ্ছি,জ্যোতির্ময় বৃহত্ত্বই দেবতার স্বরুপ--এই হল বৈদিক দেববাদের মূলকথা।এই দেবতা সর্বত্র আছেন,কেননা তিনিই এই সব-কিছু হয়েভহেন-যেমন বাইরে তেমনি অন্তরে।বাইরে পরাক-দৃষ্টিতে তাঁকে দেখি দেবতারুপে।আর অন্তরে প্রত্যক্-দৃষ্টিতে আত্মরুপে।
ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষে যা অধিভূত,চিন্ময়প্রত্যক্ষে তাই অধিদৈবত এবং অধ্যাত্ম।যেমন,বাইরে সূর্য দেখছি:এ দৃষ্টি ব্যবহারিক।এতে রুপই দেখছি,কিন্তু রুপের মধ্যে কোনও মহিমা আবিষ্কার করছি না,তার পিছনে কোনও ভাব দেখছি না।আবার দেখছু,এই সূর্যে সেই বিশ্বতশ্চক্ষুতই চক্ষু;অথবা এই সূর্য তিনিই,যিনি স্থাবর-জঙ্গমের আত্মা:এই দৃষ্টি পারমার্থিক এবং অধিদৈবত,এ কবির দৃষ্টি।দেখছি,সেই যে প্রথম প্রকাশ,তাই আবিষ্ট হয়েছে আমার দৃষ্টিত,সেই চোখ হতেই আমার চোখ;সেই চোখ দিয়ে অন্তরেও দেখছি সূর্যের জন্ম।এ-দৃষ্টিও পারমার্থিক,এ হল ঋষির অধ্যাত্মদৃষ্টি।এমনি করে বাইরে-ভিতরে এক চিন্ময় মহিমার যে প্রত্যক্ষতা,তাই বৈদিক দেববাদের ভিত্তি।
![]() |
দেবদেবীর |