হিন্দুরা কেন দেবদেবী ও মানুষের নামের আগে ‘শ্রী’ ব্যবহার করে?

“শ্রী” একটি বিশেষ শব্দ, যার উৎস সংস্কৃত ভাষা থেকে। এটি কেবল একটি অক্ষর নয়, বরং একটি পূর্ণ শব্দ, যাতে তিনটি অক্ষর একত্রে গঠিত হয়েছে। “শ্রী” শব্দটির অর্থ—ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য, সৌন্দর্য, লাবণ্য, শোভা ইত্যাদি। নামের আগে “শ্রী” বসানো হয় এই বার্তাটি দেওয়ার জন্য যে, যাঁর নাম বলা হচ্ছে, তিনি এসব গুণে ভূষিত বা এমন গুণ লাভ করুন—এই কামনা ও আশীর্বাদ রূপে।

এছাড়াও, শ্রদ্ধা ও ভক্তির প্রকাশ স্বরূপ কোনো গম্ভীর বা পূজনীয় ব্যক্তির নামের আগে অতিরিক্ত “শ্রী” বসিয়ে সম্মান দেখানো হয়। যেমন গ্রন্থের নাম বা দেব-দেবীর নামের ক্ষেত্রেও আমরা “শ্রী” ব্যবহার করি।
নামের আগে ‘শ্রী’ ব্যবহার
নামের আগে ‘শ্রী’ ব্যবহার


শ্রী নামের প্রথমে লেখা হয় কেন?

“শ্রী” শব্দটি সনাতন ধর্মীয় সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সম্মানসূচক এক অভিব্যক্তি। এটি তিনটি অক্ষরে গঠিত একটি পূর্ণ শব্দ, এবং সংস্কৃত ভাষার অন্যতম সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর অর্থবাহী শ্লোক। হিন্দু ধর্মে “শ্রী” শব্দটি দেবী লক্ষ্মী এবং দেবী সরস্বতীর সম্ভাষণে ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি ঐশ্বর্য, জ্ঞান, সৌভাগ্য, সৌন্দর্য ও লাবণ্যের প্রতীক। বাংলা ভাষাতেও “শ্রী” শব্দটি ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য ও শোভার অর্থে ব্যবহার করা হয়। ফলে কারও নামের আগে “শ্রী” যোগ করলে বোঝানো হয় যে, তিনি এসব গুণে গুণান্বিত অথবা তিনি যেন এই গুণগুলি অর্জন করেন—এটি একপ্রকার শুভেচ্ছা ও সম্মানসূচক আশীর্বাদ। শ্রদ্ধা ও ভক্তির প্রকাশ হিসেবে নামের পূর্বে “শ্রী” যোগ করা একটি প্রচলিত রীতি। সনাতন ধর্মে আমরা বিশ্বাস করি—সকলেই যেন সৌভাগ্যবান, সুদর্শন, সম্পদশালী ও সুখী হন। এই আশীর্বাদ ও শুভকামনার ভাবনা থেকেই সম্মানসূচক সম্বোধনে “শ্রী” শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এটি শুধু একটি শব্দ নয়, একজন ব্যক্তিকে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা জানিয়ে সম্মান প্রদর্শনের একটি সুন্দর রীতি।

“শ্রী” শব্দের ব্যবহার: শাস্ত্রীয় বিধান নয়, সম্মানসূচক এক অভিব্যক্তি

নামের আগে “শ্রী” লেখা কোনো শাস্ত্রীয় নিয়ম নয়, এটি ধর্মীয় পরিচয়েরও প্রতীক নয়। বরং এটি সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত একটি শব্দ, যা একসময় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার নামের আগে ব্যবহার করা হতো।সময়ের সাথে ভাষার ধারা বদলায়। ফলে বাংলাদেশে এখন “শ্রী” ব্যবহারের রীতি অনেকটাই বিলুপ্তপ্রায়। তবে পশ্চিমবঙ্গে এটি এখনও প্রচলিত এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। বিভিন্ন অভিধানে দেখা যায়, নামের আগে ব্যবহৃত “শ্রী” আসলে “শ্রীযুক্ত”, “শ্রীযুত”, “শ্রীল” ইত্যাদির সংক্ষিপ্ত রূপ।

ebangladictionary অনুযায়ী:

শ্রীযুক্ত / শ্রীযুত মানে: সৌভাগ্যযুক্ত, মান্য ব্যক্তি।

শ্রীল মানে: সৌভাগ্যবান বা লক্ষ্মীমন্ত।

শ্রীমান মানে: সুন্দর, কান্তিময়, সৌভাগ্যশালী।

সনাতন ধর্মের মূল দর্শনে আমরা সর্বজনের মঙ্গল কামনা করি। আমরা কামনা করি—সকলেই সৌভাগ্যবান হোন, শোভাময় ও সম্পদশালী হোন। এইজন্যই আমাদের প্রার্থনামন্ত্রে বলা হয়েছে:

"সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ, সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।
সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ্ দুঃখভাগ্ ভবেত্।।"

অর্থাৎ—
সকলেই সুখী হোন, সকলেই রোগমুক্ত থাকুন।
সকলেই শুভ দর্শন করুন, কেউ যেন দুঃখ না ভোগ করেন।

এটি আমাদের সার্বজনীন মঙ্গলচিন্তার প্রতিফলন।

‘শ্রী’ লেখার প্রচলন ও তাৎপর্য

সনাতন ধর্মে ও হিন্দু সমাজে ‘শ্রী’ এবং এর বিভিন্ন রূপ সম্মানসূচক উপাধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এগুলির প্রয়োগ নির্ভর করে বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার ওপর। অনেকেই নিজের নাম স্বাক্ষরের আগে 'শ্রী' শব্দটি ব্যবহার করেন। যদিও এটি কোনো শাস্ত্রীয় বিধান নয়, হিন্দু সমাজে এটি একটি সামাজিক ও সৌজন্যমূলক রীতি হিসেবে প্রচলিত হয়েছে। ‘শ্রী’ শব্দটি সাধারণত জীবিত ব্যক্তির নামের পূর্বে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অতএব, যখন কেউ নিজের স্বাক্ষর করেন, তখন নামের পূর্বে ‘শ্রী’ বসানো যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক। এটি ইঙ্গিত করে যে স্বাক্ষরকারী জীবিত অবস্থায় স্বহস্তে এই স্বাক্ষর করেছেন।

অতএব, নারী বা পুরুষ, যে ধর্মেরই হোন না কেন, কারো নামের আগে “শ্রী” ব্যবহার করা মানে তাঁকে সৌভাগ্য, সম্মান ও শুভকামনার সঙ্গে সম্বোধন করা—এ এক চিরায়ত ভদ্রতা ও সংস্কৃতির প্রকাশ।

শ্রীমান ও শ্রী শ্রী-এর মধ্যে পার্থক্য কী?

‘শ্রী’ শব্দের অর্থ—লক্ষ্মী, সৌন্দর্য, শোভা, সমৃদ্ধি প্রভৃতি। হিন্দু ধর্মে আত্মাগতভাবে সমস্ত জীবের মধ্যে (স্থাবর ও জঙ্গম) একতা ও ঐক্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যদিও বাহ্যিক রূপে কিছু ভেদ-বিভেদ দেখা যায়। এই মূল ভাবনাকে সম্মান জানিয়ে, প্রত্যেক মানুষকে সৌন্দর্য ও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। এই কারণেই অনেক সময় সকলের নামের পূর্বে ‘শ্রী’ যোগ করা হয়—এটি সৌজন্য, সম্মান এবং শুভাশীর্বাদের একটি চিহ্ন। তবে বাস্তব প্রয়োগে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে এর ব্যবহারে কিছু পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়, যেমন—জীবিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োগে বা শাস্ত্রীয় প্রসঙ্গে। যেমন-

১) শ্রী শ্রী – দেবতা, ঈশ্বর ও দেবতাতুল্য মহাপুরুষদের নামের পূর্বে ব্যবহার করা হয়। এটি দ্বিগুণ সম্মানসূচক।

২) শ্রী – সাধারণভাবে যেকোনো বয়সের পুরুষদের ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য। এটি সর্বজনীন ও সম্মানসূচক।

৩) শ্রীমান – বালক ও যুবকদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি মার্জিত সম্মানবোধক উপাধি।

৪) শ্রীমতী – সাধারণত বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তবে আধুনিক কালে এটি অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হচ্ছে (যেমন: শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়)। বর্তমানে ‘কুমারী’ শব্দের ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে।

৫) সুশ্রী – অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে ভারতজুড়ে (বিশেষত বাংলার বাইরে) ব্যবহৃত একটি সম্মানসূচক উপাধি। উদাহরণ: সুশ্রী উমা ভারতী, সুশ্রী জয়ললিতা

৬) শ্রীযুক্ত – এটি প্রায়শই বয়স্ক বা বিশেষভাবে সম্মানীয় ব্যক্তিদের নামের পূর্বে ব্যবহৃত হয়।

৭) শ্রীমত্যা – এই উপাধিটি সাধারণত বিধবা নারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো, বিশেষত নিমন্ত্রণপত্র বা আনুষ্ঠানিক প্রসঙ্গে। বর্তমানে এর ব্যবহার খুবই সীমিত।

৮) শ্রীমৎ – এটি সন্ন্যাসী বা বৈদান্তিক সাধকদের নামের পূর্বে ব্যবহৃত হয়। যেমন: শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ

৯) শ্রীপাদ – বৈষ্ণব ও শৈব অবধূত বা ধর্মাচার্যদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এই উপাধি ব্যবহার করা হয়।

১০) শ্রী (আলাদাভাবে সাধুদের জন্য) – বিভিন্ন আখড়া, মঠ বা আশ্রমের অধিষ্ঠাতা, মঠাধ্যক্ষ বা দৈব ক্ষমতাসম্পন্ন সাধকদের নামের পূর্বে ‘শ্রী’ ব্যবহৃত হয়—আধ্যাত্মিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে।


‘শ্রী’ সম্পর্কিত পুরাণ ও শাস্ত্রীয় ভিত্তি সমূহ

 ‘শ্রী’ শব্দটি হিন্দু ধর্মে একটি গভীর অর্থবহ ও পবিত্র উপাধি, যার উল্লেখ বহু পুরাণ ও শাস্ত্রে পাওয়া যায়। এটি শুধু সৌভাগ্য বা সম্পদের প্রতীক নয়, বরং একাধারে দেবী, শক্তি ও ধর্মীয় সৌন্দর্যের প্রতীকও বটে। নিচে ‘শ্রী’ সম্পর্কিত পুরাণ ও শাস্ত্রীয় ভিত্তিগুলির একটি সারাংশ তুলে ধরা হলো:


1. বিষ্ণু পুরাণ
বলা হয়েছে: "নিত্যা শ্রীর্ বিষ্ণুবক্তা চ"


অর্থাৎ, শ্রী দেবী চিরস্থায়ী এবং সর্বদা ভগবান বিষ্ণুর সেবায় নিয়োজিত। তিনি বিষ্ণুর সহধর্মিণী ও তাঁর অলঙ্কারস্বরূপ।


2. লক্ষ্মী তন্ত্র ও শ্রীসুক্তম্ (ঋগ্বেদ)
‘শ্রী’ দেবীকে কেন্দ্র করে সমগ্র ‘শ্রীসুক্তম’ রচিত হয়েছে, যা ঋগ্বেদের অন্যতম প্রসিদ্ধ স্তোত্র। এতে বলা হয়েছে: "পদ্মিনী পাদ্মমালিনী" শ্রী 

অর্থাৎ লক্ষ্মী দেবী পদ্মে আসীন, পদ্মমালাধারিণী, কল্যাণকারিণী।
শ্রীসুক্তমে ‘শ্রী’ কে "চন্দ্রর্ণম্ লক্ষ্মীং" অর্থাৎ চন্দ্রবর্ণা ও ঐশ্বর্যময়ী বলা হয়েছে।


3. দেবী পুরাণ
এখানে ‘শ্রী’ কে শক্তির এক রূপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। শ্রী অর্থে শুধু লক্ষ্মী নয়, নারায়ণ-শক্তির সর্বময় প্রকাশ।


4. ধর্মশাস্ত্র ও আচারশাস্ত্রে 'শ্রী' এর ব্যবহার
‘শ্রী’ শব্দটি শাস্ত্রীয় রীতি অনুযায়ী সাধারণত জীবিত ব্যক্তির নামের পূর্বে ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি সৌভাগ্য, জীবনীশক্তি ও সম্মানের প্রতীক।

5. মনুস্মৃতি (২/১২৩) অনুসারে—
"শ্রীমান্নারায়ণো দেবঃ..." — এখানে ‘শ্রীমান’ শব্দে ‘শ্রী’ দেবতাকেও ভূষিত করে।
আচারশাস্ত্রে, ‘শ্রী’ শব্দটি শুধুমাত্র সৌভাগ্যের প্রতীক নয়, বরং শুভপ্রবণতাকে জাগ্রত করার একটি মন্ত্রতুল্য উপাদান বলে গণ্য হয়।


6. তন্ত্রশাস্ত্রে 'শ্রী' ও 'শ্রীচক্র'
‘শ্রী’ শব্দটি তন্ত্রশাস্ত্রে বিশাল গুরুত্ব বহন করে, বিশেষত শ্রীচক্র বা শ্রী-যন্ত্র-এ। এটি দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর প্রতীক এবং মহাশক্তির আধার। এখানে ‘শ্রী’ মানে দেবী নিজেই।


উপসংহার
‘শ্রী’ কেবল একটি সম্মানসূচক শব্দ নয়; এটি শাস্ত্রে দেবী লক্ষ্মীর প্রতিরূপ, সৌভাগ্য ও ঐশ্বর্যের রূপক এবং ভগবৎ শক্তির প্রকাশ। পুরাণ ও শাস্ত্রে এর ব্যবহার ও ব্যাখ্যা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ‘শ্রী’ নামের পূর্বে যুক্ত হলে তা শুধু সামাজিক সৌজন্য নয়, বরং এক শুভাশীষের প্রকাশও বটে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url