মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র: রোগ মুক্তি ও শান্তির জন্য শক্তিশালী বৈদিক মন্ত্র
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র হল একটি প্রাচীন ও শক্তিশালী বৈদিক মন্ত্র, যা ভগবান মহাদেবকে উদ্দেশ করে উচ্চারণ করা হয়। এই মন্ত্রটি ঋগ্বেদ এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণ—উভয় ধর্মগ্রন্থেই উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায়। এটি বিশেষভাবে পরিচিত রোগ নিরাময়, আয়ু বৃদ্ধি, এবং অপদৃষ্ট থেকে মুক্তির জন্য। বিশ্বাস করা হয়, নিয়মিত মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করলে জীবনের যাবতীয় অশান্তি, দুশ্চিন্তা, রোগ-ব্যাধি এবং মৃত্যুভয় দূর হয়। নিরাকার শিব স্বয়ং মৃত্যুর মুখ থেকে প্রাণকে ফিরিয়ে এনে জীবনে শান্তি, স্থিতি ও সুস্থতা প্রতিষ্ঠা করেন।
এই মন্ত্রের নিয়মিত জপ ও পাঠে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং জীবনে এক নতুন আশার সঞ্চার ঘটে। বিশেষ করে গুরুতর অসুখ বা বিপদের সময়, মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের প্রভাব অত্যন্ত ফলদায়ক বলে মনে করা হয়।
 |
মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র |
এই মন্ত্রের সঙ্গে একটি জনপ্রিয় কাহিনী জড়িয়ে আছে। মহর্ষি মৃকণ্ডু ও তাঁর স্ত্রী মরুদ্বতী দীর্ঘকাল নিঃসন্তান ছিলেন। সন্তানলাভের আশায় তারা কঠোর তপস্যা করে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেন। তাদের তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে শিব তাদের এক পুত্রসন্তান দান করেন, যার নাম রাখা হয় মার্কণ্ডেয়। কিন্তু জন্মলগ্নেই জ্যোতিষশাস্ত্রে জানা যায়—এই শিশুর আয়ু অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, বাল্যকালেই তার মৃত্যু নিশ্চিত। বালক মার্কন্ডেয় শিব লিঙ্গের সামনে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করতে লাগলেন অভিজ্ঞ ঋষিদের কথায়। যথা সময়ে এলেন যম রাজ। মহাদেবের শরণে আসা প্রাণকে কিন্তু কেইবা হরণ করতে পারে ! যমরাজ হার মানলেন এবং ফিরে গেলেন, আর মহাদেবের আশীর্বাদে ঋষি মার্কণ্ডেয় পেলেন চিরকালীন আয়ু। পরবর্তীতে, তিনি রচনা করেন মার্কণ্ডেয় পুরাণ—হিন্দু ধর্মের এক মূল্যবান গ্রন্থ।
মহাদেবকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে, মার্কণ্ডেয় ঋষি রচনা করেন মহামৃত্যুঞ্জয় স্তোত্র, যা আজও ভক্তদের মধ্যে অতীব পবিত্র বলে গণ্য। এই স্তোত্রটি মার্কণ্ডেয় পুরাণেই উল্লেখ করা হয়েছে, যা শিবভক্তদের কাছে এক অলৌকিক আশ্রয় ও শক্তির উৎস।
দেবলোকের অমৃত সন্ধানে মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের ঐশ্বরিক ক্ষমতা। বেদের অন্দরে নজর রাখলে জানতে পারবেন সেখানে এমন সব মন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে, যা প্রতিদিন পাঠ করলে শারীরিক এবং মানসিক শক্তি এতটাই বেড়ে যায় যে রোগ, দুঃখ সহ জীবনের সব খারাপ কিছু নিমেষে ঘুঁচে যায়।
সত্যিই কি মৃত্যু জয়ের মন্ত্রের সন্ধান পাওয়া সম্ভব?
মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র: বেদের বাণী
এই মন্ত্রটি মূলত ভগবান শিবের মন্ত্র। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, নিয়ম মেনে মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করলে এমন এক শক্তির জন্ম হয়, যা মৃত্যুকেও জয় করতে সাহায্য করে। শরীরের ভেতরে দেবত্ব এমনভাবে জেগে ওঠে যে মৃত্যু আর সহজে ধারে কাছে আসে না।
অনেক পুরাতন ধর্মগ্রন্থে এই মন্ত্রকে ‘রুদ্র মন্ত্র’ নামেও ডাকা হয়। ‘রুদ্র’ মানে হল তেজ বা অমিত শক্তি। এই শক্তিই দেহে প্রবাহিত হয়ে এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে রোগ-ব্যাধির বেড়ে ওঠার কোনও সুযোগই থাকে না। বহু মুনি-ঋষি মনে করেন, দেবাদিদেব মহাদেবের তেজ ও শক্তির প্রতিফলন হিসেবেই এই মন্ত্রের এমন নামকরণ।
‘ত্রিয়াম্বকম মন্ত্র’ নামেও চেনেন অনেকেই এই মন্ত্রটি । ‘ত্রিয়াম্বকম’ শব্দের অর্থ হল তিন-চোখওয়ালা, অর্থাৎ ভগবান শিব, যাঁর তৃতীয় চক্ষু জ্ঞানের প্রতীক। তবে এটাই এই মন্ত্রের একমাত্র পরিচয় নয়।অনেকে একে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র-এর পাশাপাশি মৃত্যুঞ্জীবন মন্ত্র বলেও ডাকেন—মানে, এমন এক মন্ত্র যা মৃত্যুকে পর্যন্ত জয় করতে সক্ষম। এই অসাধারণ শক্তির কথাই বেদে বলা হয়েছে।মূলত সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই মন্ত্রটি ঋগ্বেদে স্থান পেয়েছে, যা হাজার হাজার বছর ধরে মুনি-ঋষিদের মাধ্যমে প্রচলিত এবং পরম শক্তির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার পথ দেখায়।
মন্ত্রটি হল-
"ওম। ত্রম্বকাম যজমাহে,
সুগন্ধিম পুষ্টি-বর্ধানাম,
উরুভারুকম্ভিয়া বান্ধানাম,
মৃত্যুয়র মুখশিয়া মামরিতাত।"
প্রসঙ্গত, চার লাইনে ভাঙা এই মন্ত্রটির প্রতিটি লাইনে আটটা চিহ্ন রয়েছে, যা উচ্চারণ করার সময় সারা শরীরজুড়ে একটা কম্পন ছড়িয়ে পরে। এই কম্পনই শরীরে ভেতরে থাকা হাজারো ক্ষতকে নিমেষে সারিয়ে তোলে। শুধু তাই নয়, ব্রেন পাওয়ার বৃদ্ধিতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে এই মন্ত্রটি। আধুনিক কালে এই মন্ত্রটিকে নিয়ে একাধিক গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে মন্ত্রটি পাঠ করার সময় মস্তিষ্কের অন্দরে থাকা নিউরনগুলি এতটাই অ্যাক্টিভ হয়ে যায় যে ধীরে ধীরে মনোযোগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেই সঙ্গে বুদ্ধি এবং স্মৃতিশক্তিরও উন্নতি ঘটে।
শিবের মহামন্ত্র টি পাঠ করলে কি কি উপকার হয়?
মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র,অমৃত মন্ত্র,মৃত্যুজয়ের মন্ত্র,আয়ু বৃদ্ধির মন্ত্র,দীর্ঘায়ু মন্ত্র,শিব প্রদত্ত মহামন্ত্র,শিবের বর মন্ত্র, যে মন্ত্র পাঠ করলে দীর্ঘায়ু লাভ হয়
মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র (যা মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বা ত্র্যম্বকম মন্ত্র নামেও পরিচিত) হল হিন্দুধর্মের একটি পবিত্র ও শক্তিশালী মন্ত্র, যা ঋগ্বেদে উল্লেখিত এবং ভগবান শিবের স্তুতিতে রচিত। এই মন্ত্রটি পাঠের মাধ্যমে ভক্তরা দীর্ঘায়ু, সুস্বাস্থ্য, আধ্যাত্মিক শক্তি ও মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি লাভ করেন।
মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠের উপকারিতা:
১. দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য লাভ: এই মন্ত্রটি রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি দেয় এবং দীর্ঘজীবন দান করে।
২. মৃত্যুভয় দূরীকরণ: মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের শক্তিতে অকালমৃত্যুর ভয় দূর হয়।
৩. শারীরিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি: এটি শরীর ও মনের রোগ দূর করে শক্তি ও প্রাণশক্তি বাড়ায়।
৪. আধ্যাত্মিক উন্নতি: মন্ত্রজপে মন শুদ্ধ হয়, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ হয়।
৫. নেতিবাচক শক্তি থেকে রক্ষা: এটি কালো জাদু, অপশক্তি ও দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করে।
৬. কর্মফলের উন্নতি: এই মন্ত্র পাঠে জীবনের বাধা-বিপত্তি দূর হয়ে সাফল্য আসে।
৭. পিতৃদোষ ও গ্রহদোষ প্রশমন: জ্যোতিষশাস্ত্রে বলা হয়, এই মন্ত্র গ্রহপীড়া ও পিতৃদোষ কমাতে সাহায্য করে।
মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র কীভাবে জপ করবেন?
প্রতিদিন ১০৮ বার জপ করতে পারেন (রুদ্রাক্ষ মালা ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়)।
প্রভাত বা সন্ধ্যায় শিবলিঙ্গের সামনে বা পবিত্র স্থানে বসে জপ করুন।
শুভ সময়: বিশেষত সোমবার, মহাশিবরাত্রি বা প্রদোষ কালে জপ করলে বেশি ফল পাওয়া যায়।
এই মন্ত্রের শক্তি অপরিসীম, নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের সাথে পাঠ করলে জীবনে সুখ, শান্তি ও মোক্ষ লাভ সম্ভব।
মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের ব্যাখ্যা:
মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র সংস্কৃত ভাষায় একটি প্রাচীন ও শক্তিশালী বৈদিক মন্ত্র। একে রুদ্র মন্ত্র বা ত্র্যম্বকম মন্ত্র-ও বলা হয়। এটি ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদে পাওয়া যায় এবং মূলত ভগবান শিব-কে উদ্দেশ করে উচ্চারণ করা হয়।
মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র:
ॐ त्र्यम्बकं यजामहे सुगन्धिं पुष्टिवर्धनम्।
उर्वारुकमिव बन्धनान् मृत्योर्मुक्षीय माऽमृतात्॥
বাংলা উচ্চারণ:
"ওঁ ত্র্যম্বকং ইয়জামহে সুগন্ধিং পুষ্টি বর্ধনম্।
উর্বরুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মোক্ষীয় মাঽমৃতাৎ॥"
শব্দার্থ ও ব্যাখ্যা:
ॐ (ওঁ): পরম ব্রহ্ম, সৃষ্টির মৌল শব্দ।
त्र्यम्बकं (ত্র্যম্বকম্): তিন-চোখবিশিষ্ট, অর্থাৎ ভগবান শিব।
यजामहे (ইয়জামহে): আমরা পূজা করি বা আহ্বান করি।
सुगन्धिं (সুগন্ধিং): পবিত্র সুবাসযুক্ত, যার গুণধর্ম শুভ ও আকর্ষণীয়।
पुष्टिवर्धनम् (পুষ্টি বর্ধনম্): যিনি পুষ্টি ও উন্নতি প্রদান করেন।
उर्वारुकम् (উর্বরুকম্): পাকা ফল বা শশা (যা ডাঁটা থেকে সহজে আলাদা হয়)।
इव (ইব): যেমন বা মতো।
बन्धनान् (বন্ধনান্): বন্ধন বা বন্ধনসমূহ।
मृत्योः (মৃত্যোঃ): মৃত্যুর থেকে।
मुक्षीय (মোক্ষীয়): মুক্ত করো বা মুক্তি দাও।
मा अमृतात् (মা অমৃতাত্): অমৃত থেকে নয় (অর্থাৎ অমরত্ব বা মুক্ত আত্মা থেকে আমাকে আলাদা কোরো না)।
মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বাংলা অনুবাদ ঃ
মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র সারাংশ:
এই মন্ত্রে প্রার্থনা করা হয় যেন ভগবান শিব আমাদের দেহ, মন ও আত্মার রোগ-শোক, কষ্ট ও মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত করেন — যেমন পরিপক্ব ফল গাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝরে পড়ে।
এছাড়াও, তিনি যেন আমাদের অমৃতের পথ থেকে বিচ্যুত না করেন, বরং আধ্যাত্মিক মুক্তি ও শান্তির পথ দেখান।
মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপের উপকারিতা:
রোগ মুক্তি ও দীর্ঘায়ুর জন্য জপ করা হয়।
মানসিক শান্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
মৃত্যুভয় কাটায়।
শারীরিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদান করে।
গুরুতর অসুস্থতা বা সংকটের সময় এই মন্ত্র শক্তিশালী প্রতিরক্ষা রূপে কাজ করে।
পরিশেষে একটি কথাই বলতে চাই আসুন আমরা সকলে প্রত্যেকদিন একবার হলেও এই মহামন্ত্রটি জব করি এবং দেবাদিদের আদি দেব মহাদেবের অনুকূলে নিজের জীবনকে স্বল্পিত করি।