উলুধ্বনি কেন দেওয়া হয়? জানুন এর ইতিহাস ও কারণ

আমাদের হিন্দু সমাজে বাঙালীদের বারো মাসে তেরো টি পূজা পার্বন হয়ে থাকে। উৎসব-অনুষ্ঠান বাঙালীর সভ্যতা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সন্ধ্যাপূজা থেকে আরম্ভ করে যেকোনো পূজা পার্বণ তথা বিয়েবাড়ি সহ যেকোনো মাঙ্গলিক কর্মকান্ডে শঙ্খ, কাসর, ঘন্টা, ঢাক ইত্যাদির সাথে যেটা আমাদের কর্ণগোচর হয় তা হলো মহিলাদের সমবেত উলু ধ্বনি। এমনকি নজরুলের কবিতাতেও আমরা শুনি –“উলু দেয় পুরনারী”।

 তবে এককালে বাঙালী হিন্দুদের অন্যতম সনাতন উপাচার এখনকার আধুনিক সমাজের কাছে অনেকটাই উপেক্ষিত। অনেক মেয়েরাই ঠিক মতো উলু দিতে পারেন না, বিব্রত বোধ করেন। বাঙালী সংস্কৃতির সাথে শিকড়ের যোগের কথা ভুলে গিয়েছি আমরা নিজেদের অজান্তেই। তাই চলুন আজকে আমরা উল্লেখ করবো মেয়েরা ঠিক কোন কারণে উলুধ্বনি দেয় এবং এর নানা উপকারিতার কথা।


 📖এক নজরে দেখে নিন এই  ব্লগ পোস্টে কি প্রশ্নের উত্তর পাবেন
  • কিভাবে মর্তলোকে উলুধ্বনির প্রচলন শুরু হলো
  • উলুধ্বনির ইতিহাস ও কারণ
  • কখন কিভাবে কতবার উলুধ্বনি দেয়া হয় 
  • উলুধ্বনি কেন দেওয়া হয়
  • উলুধ্বনির অর্থ কী?

উলুধ্বনি কেন দেওয়া হয়? জানুন এর ইতিহাস ও কারণ
উলুধ্বনি কেন দেওয়া হয়? জানুন এর ইতিহাস ও কারণ

আসুন জেনে নিই উলুধ্বনির মানে কী। উলুধ্বনি হলো একটি বিশেষ ধ্বনি, যা ওঁ কারের আওয়াজ। হিন্দু ধর্মে, ওঁ শব্দটিকে পরমব্রহ্মের চিহ্ন মনে করা হয়। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের মতে, এখানে 'উ' মানে রাধা এবং 'ল' মানে কৃষ্ণ, তাই এই ধ্বনি দিয়ে আমরা দুজনকেই স্মরণ করি।

উলুধ্বনি আসলে 'অ', 'উ', এবং 'ম' এই তিনটি আকার থেকে গঠিত। এগুলো একসাথে নিয়ে আসার মাধ্যমে একটি সুর তৈরি হয়, যা মহাশূন্যে ব্রহ্মনাদের প্রভাব ফেলে। এটা মহাচৈতন্য জাগানোর একটি উপায় বলা যায়। 

ওঁ শব্দটি সংস্কৃতের 'অব্' ধাতু থেকে এসেছে। এর পেছনে অনেক অর্থ রয়েছে। ওঁ হচ্ছে সৃষ্টির উৎস এবং শক্তির প্রতীক, যা বিশ্বে বিরাজমান। ওঁ ধ্বনির তিনটি অংশ: অ মানে সৃষ্টি, উ মানে উন্নতি, আর ম মানে বিশ্রাম। এই তিনটি শব্দ মিলে হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, এবং মহেশ্বরের প্রতীক হয়ে ওঠে।

উলুধ্বনি কেবল আওয়াজই নয়, বরং এটি একটি শুভ কাজের সূচনা করে। এটা একটি মাঙ্গলিক সুরও। এই ধ্বনি আমাদের আশীর্বাদ দেয় এবং সুখের একটি মূহর্তের সৃষ্টি করে। এতে শুভ কাজের সৌন্দর্য বাড়ে এবং অশুভ শক্তি দূর হয়ে যায়। কুমারিকা তন্ত্রের অষ্টম অধ্যায়েও বলা হয়েছে, উলুধ্বনি মেয়েরা করতে পারেন, ছেলেরা এটি করলে তারা নির্বংশ হয়। আসলে, এটি দেবীর আনন্দের ধ্বনি, তাই মেয়েদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।


কিভাবে মর্তলোকে উলুধ্বনির প্রচলন শুরু হলো

 উলুধ্বনির উৎপত্তি ও তাৎপর্য: একটি উপকথার আলোকে উলুধ্বনি কেন এবং কীভাবে প্রচলিত হলো— এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় একটি প্রাচীন বৈষ্ণব উপকথা থেকে। উপকথাটি এমন এক ব্রাহ্মণ কন্যার জীবনকে কেন্দ্র করে, যার নিষ্ঠা ও ভক্তি নারায়ণ দেবের আশীর্বাদ লাভের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। একসময়ে এক নির্জন বনে বাস করতেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ও তার কন্যা। ব্রাহ্মণ ছিলেন বিষ্ণু দেবের এক একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি প্রতিদিন নিষ্ঠা ও সরলতায় শালগ্রাম শিলার পূজা করতেন। তার এই সাধনাকে ছোট থেকেই দেখেছে তার কন্যা। প্রতিদিনের পূজার পর কিছু সামান্য দান-দক্ষিণার মাধ্যমেই তাদের দিন চলে যেত। কালের পরিক্রমায় সেই কন্যা কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে। একদিন সেই বনের মধ্য দিয়ে যাত্রা করছিল এক রাক্ষসরাজ। কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে সে তাকে অপহরণ করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যায় এবং জোরপূর্বক বিবাহ করে। তবে একটি কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়— রানী হিসেবে সে আর কোনো দেবতার পূজা বা উপাসনা করতে পারবে না। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থেকেও কন্যা প্রতিদিন নারায়ণ শিলার সামনে চোখের জলে তাঁর সান্নিধ্য কামনা করত।

একদিন রাজা জানায় যে সে কিছুদিনের জন্য রাজ্য ত্যাগ করবে, এবং স্পষ্টভাবে বলে যায় যেন তার অনুপস্থিতিতে কোনো উপাসনা না করা হয়। এই সুযোগে কন্যা আনন্দিত হয়ে নারায়ণ শিলাকে বাইরে এনে চন্দন-পুষ্প দিয়ে সাজিয়ে পূজায় মগ্ন হয়। নারায়ণ মন্ত্রে মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক। কিছুদিন পর রাজা ফিরে এসে এই দৃশ্য দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে আদেশ দেয়— শিলাটিকে গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হবে। কন্যা বাধ্য হয়ে শিলাকে মাথায় নিয়ে গঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, শিলাকে বিসর্জন দেওয়ার পর নিজেকেও গঙ্গায় সমর্পণ করবে এবং গঙ্গা দেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। নদীর তীরে পৌঁছে ধীরে ধীরে হাঁটু, কোমর ও বুকজলে দাঁড়ালে হঠাৎ একটি দৈববাণী শোনা যায়—“কন্যা, তুমি শিলাটি নিয়ে ফিরে যাও। আমি তোমার পূজা গ্রহণ করব। যদি তুমি একান্ত আমাকে নিবেদন করতে চাও, তবে আর কোনো মন্ত্র প্রয়োজন নেই, কেবল কয়েকবার উলুধ্বনি করলেই যথেষ্ট।” নারায়ণ আরও বলেন— “নারীজাতির জন্য উলুধ্বনিই হবে পুজার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।” এই অলৌকিক ঘোষণা শুনে কন্যা ফিরে যায় এবং আজীবন উলুধ্বনির মাধ্যমে নারায়ণ পূজা করে যায়। মৃত্যুর পর সে ঠাঁই পায় নারায়ণের চরণে। সেই থেকেই পৃথিবীতে উলুধ্বনির প্রথা শুরু হয়। এরপর থেকে নারীদের জন্য মন্ত্রপাঠের বাধ্যবাধকতা আর রইল না। উলুধ্বনিই হয়ে উঠল দেবতা সন্তুষ্ট করার এক শক্তিশালী উপায়। পুরুষেরা যেখানে দেবতাকে আহ্বান করে মন্ত্রের মাধ্যমে, নারীরা শুধুমাত্র উলুধ্বনির মাধ্যমে সকল দেবতার কৃপা লাভ করতে সক্ষম।

উলুধ্বনির ইতিহাস ও কারণ

উলুধ্বনির ইতিহাস
প্রাচীন ভারতের উৎসব ও ধর্মীয় আচার থেকে:
উলুধ্বনির প্রচলন প্রাচীন ভারতের আর্য-অনুষ্ঠান বা বৈদিক সময় থেকেই শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সেই সময় যজ্ঞ বা পূজার সময় নারীরা এই ধ্বনি দিতেন, যা শুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতো।

পুরাণ ও ধর্মীয় শাস্ত্রে উল্লেখ:
বিভিন্ন হিন্দু পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে উলুধ্বনির উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে দেবী দূর্গার পূজা বা যুদ্ধ জয় উপলক্ষে দেবতারা ও নারীরা উলুধ্বনি করেছেন—এমন বর্ণনা আছে।

মঙ্গলাচরণ হিসেবে ব্যবহৃত:
সমাজে এই ধ্বনিকে শুভ, পবিত্র ও মঙ্গলসূচক ধ্বনি হিসেবে ধরা হয়। তাই যেকোনো শুভ কাজের শুরুতে বা পূর্ণতার সময় এই ধ্বনি দেওয়া হয়।

উলুধ্বনির কারণ ও তাৎপর্য

শুভ সূচনা ও শক্তির প্রকাশ:
উলুধ্বনি শুভ শক্তি আহ্বানের প্রতীক। এটি দেবীর শক্তি ও নারীর শক্তির প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

দুষ্ট শক্তি দূরীকরণ:
বিশ্বাস করা হয়, এই ধ্বনির মাধ্যমে চারপাশের নেগেটিভ শক্তি বা অশুভ প্রভাব দূর হয়।

আনন্দ প্রকাশ ও উৎসবের অনুভূতি:
এটি এক ধরণের আবেগ প্রকাশের মাধ্যম। বিশেষ করে বিয়ে, পূজা বা বিজয়ের মুহূর্তে নারীরা এই ধ্বনির মাধ্যমে তাঁদের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

সামাজিক ঐক্য ও সংস্কৃতির প্রতীক:
উলুধ্বনি শুধু ধ্বনি নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক চিহ্ন। এটি নারীর অংশগ্রহণ, সামাজিক ঐক্য এবং উৎসবের সম্মিলিত চেতনার প্রতীক।

কিভাবে উলুধ্বনি করা হয়?

উলুধ্বনি করতে হলে জিভকে কম্পিত করে (জিভ কাঁপিয়ে) দ্রুতগতিতে মুখের মধ্যে ধ্বনি তৈরি করতে হয়। এর সঙ্গে অনেক সময় "জয় মা", "জয় দুর্গা", ইত্যাদি ধ্বনি যুক্ত হয়।
কখন কিভাবে কতবার উলুধ্বনি দেয়া হয়
গৃহপ্রবেশে ৫ ঝড় উলুধ্বনি দেওয়া হয়। পূজায় ৩ ঝড় উলুধ্বনি দেয়া হয়। ছেলে শিশুর জন্মের সময় ৯ ঝড়। মেয়ে শিশুর জন্মের সময় ৭ ঝড়। বিয়ের সময় ১৪ ঝড়। ভূমিকম্পের সময় ঘনঘন উলুধ্বনির চল রয়েছে।

উলুধ্বনি (বা উলু ধ্বনি) একটি ঐতিহ্যবাহী শব্দপ্রকাশ, এটি একটি বিশেষ ধরণের জিভ কাঁপিয়ে ধ্বনি উৎপন্ন করার পদ্ধতি, যা সাধারণত আনন্দ, বিজয়, পূজা-পার্বণ, বিয়ে বা শুভ অনুষ্ঠান উপলক্ষে করা হয়।তবে আজকের আধুনিক বা তথাকথিত ‘ডিজিটাল’ নারীদের অনেকেই এই ঐতিহ্যবাহী ধ্বনি দিতে সংকোচ বোধ করেন, যা এক অর্থে আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে সরে আসারই ইঙ্গিত দেয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url