সকল ধরনের ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক বিবাহের উপকরণাদি একসাথে জেনে নিন

বিয়েতে অনেক জিনিস লাগে। তার মধ্যে কিছু হলো ষষ্ঠী এবং মার্কণ্ডেয়াদি পূজার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন সিন্দুর, তিল, যব, হরীতকী, ধূপ, গুগগুল, এবং একটাসহ নানা সবজির ডাল। এ ছাড়া একটি ঘট, পল্লব, ফল, তৈল, হরিদ্রা, এবং সুপারি ও কদলী লাগে। বিয়েতে ষষ্ঠীর শাড়ি, মার্কণ্ডেয়ের ধুতি, দুটি আসন, আর কিছু কাঁসার খাবারের পাত্রও দরকার। এগুলোর সঙ্গে দধি, মধু, চিনি, পুষ্প, চন্দন, এবং তুলসীরও ব্যবহার হয়। এই সব জিনিস ছাড়াও গৌর্য্যাদিষোড়ক মাতৃকার শাড়ি, কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ নৈবেদ্য, এবং ফলমূল মিষ্টি খাবারও লাগে।


হিন্দু ধর্মের বিয়েতে এগুলো হলো সাধারণ উপকরণ এখন আমরা পূর্ণাঙ্গ উপকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো-

বিয়েতে অনেক ধরনের উপকরণ লাগে তার মধ্যে অগ্রে ষষ্ঠী  মার্কণ্ডেয়াদি পূজা-সি ঠি, সিন্দুর, তিল, যব, শেডসর্ষপ, হরীতকী, ধূপ, ধুনা, গুগগুল ও বটের ডাল ১টা, ঘট ১টা, পল্লব ১ দফা, ফল ১ দফা, তৈল, হরিদ্রা, তাম্বুল, সুপারি, কদলী, ষষ্ঠীর শাড়ী ১, মার্কণ্ডেয় ধুতি। ১ জোড়া, আসনাঙ্গরীয়ক ২ প্রন্থ, মধুপর্কের কাঁসার বাটি বা ২টা, দধি, মধু, গব্যঘৃত, চিনি, পুষ্প, চন্দন, দূর্ব্বা, বিল্বপত্র, তুলসী প্রভৃতি ১ দফা। সগণাধিপ গৌর্য্যাদিষোড়ক মাতৃকার শাড়ী ১৬ খানা ও সোত্তরীয় বস্তু ১ গ্রন্থ, আসনাঙ্গুরীয়ক ১৭প্রস্থ, মধুপর্কের কাঁসার বাটি ১৭টা (অশক্তপক্ষে, বোড়শোপচারে পূজা ১ দফা, তদভাবে দশোপচারে), নৈবেদ্য ১৭ খানা, তাম্বুল ১৭টা, ফলমূলাদি, মিষ্টদ্রব্য, শ্রীশ্রীষষ্ঠীমার্কণ্ডেয় নৈবেদ্য ২ খানা, ঐ কুচা ১ খানা।

হিন্দু বিয়েতে কি ধরনের উপকরণ লাগে
বিয়েতে বিভিন্ন ধরনের উপকরণ

বিয়েতে কিবকি  ধরনের উপকরণ লাগে? 

বসুধারার্থ-গব্যঘৃত অর্দ্ধপোয়া, সিন্দুর, কজ্জ্বল,


তৈল, হরিদ্রা, চন্দনাদি, চেদিরাজবসুর ষোড়শোপচারে পূজার ধুতি ১ জোড়া, আসনাঙ্গুরীয়ক ১ প্রস্থ, মধুপর্কের বাটি ১টা, দধি, মধু, ঘৃতাদি, নৈবেদ্য ১ খানা, অশক্তপক্ষে দশোপচারে পূজা।


অধিবাস দ্রব্য তৈল-হরিদ্রা, মহী (মৃত্তিকা), গন্ধ (চন্দন), শিলা (নুড়ি), ধান্য, দূর্ব্বা, পুষ্প, ফল (১ ছড়া অখণ্ড কাঁঠালি কলা), দধি, গব্যঘৃত, স্বস্তিক (পিটুলি নির্মিত), সিন্দুর, শঙ্খ, কার্পাস সূত্র, কজ্জ্বল, রোচনা (গো-রোচনা), সিদ্ধার্থ (শ্বেতসর্ষপ), কাঞ্চন, রৌপ্য, তাম্র, প্রদীপ, দর্পণ (আড়শি), ব্যজন (চামর)। আচারানুসারে বরণডালা, শ্রী ইত্যাদি মাঙ্গল্য দ্রব্য, প্রশস্থিপাত্র।নান্দিমুখত চ দ্রব্য যজ্ঞেশ্বরের ধুতি ১ জোড়া,

দৈবগক্ষে ধুতি ২ গড়া অভাবে ১ জোড়া, পিতৃপক্ষে ধূতি ২ জোড়া অভাবে ১ ঐ, মাতামহপক্ষে ২ জোড়া অভাবে ১ ঐ, (অতি অশক্তপক্ষে গামছা ৭ খানা)। আতপততুল দশ সের, কুশ, ভোজ্য ৫টা, তাহাতে গামছা ৫ খানা। অন্নপাত্র-দৈবপক্ষে ২ দফা, পিতৃপক্ষে ঐ ২ দফা, মাতাপক্ষে ঐ ২. গব্যঘৃত এক ছটাক, মধু অর্দ্ধপোয়া, দধি, কদলী, ফলমূলাদি, মিষ্টদ্রব্য, কলার খোলা অভাবে ঐ পত্রপিণ্ড ৭টা, পান, সুপারি, ধূপ, দীপ, গঙ্গামৃত্তিকা, যব, শুরু পুষ্পাদি, তুলসী, গুরু চন্দনাদি, পিন্ডার্থ উপকরণ, বিশ্ব, বদর, আর্দ্রকাদি, পিণ্ডার্থ সূত্র ৬ দফা, দৈব পৈত্র ও মাতামহ পক্ষে দক্ষিশা ও দফা, যজ্ঞোপবীতার্থ সূত্র (পৈতা) ১০টা। (আচারডঃ আনন্দলাডু)।

শুভ বিবাহের দ্রব্য-সম্প্রদানের দ্রব্য বরপক্ষের বরের পট্টবস্ত্র ১ জোড়া, টোপর ১টা; ধরাঙ্গুরীয়ক ১ দফা, ফুলের মালা, জাঁতি ১. বিনামা ১ জোড়া, বরাভরণ ১ দফা। কন্যাপক্ষের-পূর্ব্বপূর্ণ জামাতার বরণ বস্ত্রাদি, পুষ্পমাল্যাদি, বরের পট্টবস্ত্র ১ । জোড়া, কন্যাঙ্গুরীয়ক ১ দফা, আলপনা দেওয়া পীড়ে ২ দফা, টোপর ১টা, যথাশক্তিদানীয় দ্রব্য ১ জোড়া বনাছত্র, কন্যার পট্টবস্ত্রশাটী ১. খানা, আচ্ছাদনার্থ বস্ত্র ১ দফা, = কোশাকুশী ১ দফা, কাজললতা ১ খানা, ফুলের মালা বড় ২ ছড়া, দফে ঐ মালা ৪ ছড়া, পাঁচফল-বয়ড়া, হরীতকী, সুপারি, জায়ফল, আমলকী, হরিদ্রাবর্ণের ঐ পঞ্চপলের বন্দনার্থ গামছা ১ খানা, কুশনিচাজ বিসর্বর ২, মধুপর্কের কাঁসার বাটী ১টা, দধি, মধু, গব্যঘৃত, চিনি, পাদ্য-অর্থ্যাদির

পুষ্পাদি ১, পুরোহিত দক্ষিণা। স্ত্রী আচার-সকল বেদীয় বিবাহেই বরের বরণের

পর স্ত্রী আচার করা হইয়া থাকে। তাহার দ্রব্যাদি-মালা ২ ছড়া, ছাউনি নাড়া পুষ্পাদি, হাই আমলা, মোনামুনি, তুরা, করু, বরণডালা, চণ্ডীপুঁথি, আচ্ছাদনার্থ বস্তু, মাকু, কার্পাসসূত্র, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি প্রভৃতি।

কুশণ্ডিকা-বটের শাখা ১, সপল্লব ঘট ১, বর্তী ও

মার্কণ্ডেয় পূজা ষোড়শোপচারে, নৈবেদ্য ২ খানা, ক্ষুদ্র নৈবেদ্য ১, গব্যঘৃত ১ আনা, অগ্নি আনিবার কাংস্যপাত্র অভাবে মৃন্ময়পাত্র অভাবে আজ্যস্থালি তাম্রপাত্র ১. বালি, কাষ্ঠ, গোময়, দ্বাদশাঙ্গুল পরিমিত উড়ম্বর সমিধ ২৮. হস্তপরিমিত ধব কিম্বা ধদির অথবা পলাশ কিম্বা যজ্ঞোডুম্বর বিংশতিকাঠিকা ২০, কুশময় ব্রাহ্মণ ১, দ্বাদশাঙ্গুলকুশ ১. একবিংশাতাঙ্গুলকুশ ১. সপ্তাঙ্গুলকুশ ৩, সাপ্রকুশপত্রদ্বয় ১, বিতস্তিপরিমিত ঐ ৩ দফা, আস্তরণাদির জন্য কৃশ ১ দফা, শিলা ১. নুড়ি ৪ দফা, লাজ (খৈ), শর্মীপত্র (শাঁই পাতা), বীরণপত্র (ষেণাপাতা), সিন্দুর, ঐ প্রদানার্থ বেত্রনির্মিত পাত্র (পালি)।

* বর-কন্যার বস্ত্র-ধূতি উড়ানি ১ দফা, লজ্জাবস্তু ও শাটী ১ খানা, আম্রপল্লব ১ দফা, জলপূর্ণ কৃষ্ণ ১টা, কুলা ১ খানা, ব্রাহ্মণ দক্ষিণা, সুক সুবাদি, পূর্ণ হোমের কদীদ্বয় ও তাম্বুল, পুষ্প দুর্ব্বাদি, দধি, বিচিত্র পীড়ে ২ খানা।

এক নজরে হিন্দু বিবাহের উপকরণসমূহ :

১। পান, সুপারি ও বাদাম। 

২। আম, কলা ও নারকেল। 

৩। মিষ্টিও ফলমূল। 

৪। ধুপ, দ্বীপ ও আগরবাতি। 

৫। ফুল,মালা, আলতা,চিরুনি ইত্যাদি। 

৬। চন্দন, কুমকুম ও হলুদ গুঁড়ো। 

৭। ধান, দুব্বা ঘাস, তুলসী পাতা ও বেল পাতা। 

৮। পবিত্র জল বা গঙ্গাজল। 

৯। কাসর ঘন্টা ও শঙ্খ ঘন্টা 

১০। হলুদ বা লাল সুতো গাটছড়া বাধার জন্য। 

১০। হোম কুন্ড এবং হোম সামগ্রী অর্থাৎ যজ্ঞের জন্য কাট, ঘি, নৈবদ্ধ, কলা,বেল পাতা, দুর্গা ঘাস  ইত্যাদি 

১১। মঙ্গলসূত্র ও সিঁদুর। 

১২। বর কনে ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য নতুন কাপড়-চোপড়। 

১৩। বর-কনে বসার আসন অর্থাৎ পিড়ি বা চৌকি। 

১৪। নতুন বটি বাসন ও বাসনপত্র। 

১৫। আবির ও মেহেদী সাথে আলতা। 

১৬।পান পাতা ও চালের বাটি। 

১৭। বরণ ডালা ছেলে বা মেয়েকে বরণ করার জন্য। 

১৮।কুমড়ো, শঙ্খ, মধু, দই  প্রভৃতি।

হিন্দু ধর্মে বিবাহের শুরু ও বিকাশ একটা বড় ইতিহাস নয়। বিবাহ কিভাবে আসলো, সেটা বুঝতে বৈদিক সময় থেকে ধর্মীয় লেখাগুলি ও সমাজের কাঠামো দেখা দরকার।


বৈদিক যুগে বিবাহ:

হিন্দু বিবাহের মূল ভিত্তি শুরু হয় বৈদিক যুগে। ঋগ্বেদ, অত্রি সংহিতা ও আরো কিছু লেখায় বিবাহের কথা উল্লেখ আছে।

এই সময়ে বিবাহকে ধ্যান, তপস্যা আর গার্হস্থ্যধর্মের অংশ হিসেবে ধরা হতো। গার্হস্থ্য আশ্রম ছিল চারটি আশ্রমের মধ্যে দ্বিতীয়টি। বিবাহকে জীবনের একটি পবিত্র কর্তব্য মনে করা হতো, যেখানে স্বামী-স্ত্রী মিলে ধর্ম, অর্থ আর কাম পূরণ করতেন।

“সপ্তপদী” বা সাত পা হাঁটার রীতিও সেই সময় থেকেই শুরু হয়, যেখানে দম্পতি সাতটি প্রতিজ্ঞা নেন।

ধর্মশাস্ত্র ও বিবাহের নিয়ম:

মনুস্মৃতি, গৌতম ধর্মসূত্র, আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে বিবাহের নিয়ম, পদ্ধতি ও ধরন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

মনুস্মৃতিতে আট ধরনের বিবাহের কথা বলা হয়েছে – যেমন ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস, এবং পাইশাচ। এর মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহ সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়।


সামাজিক দিক:

পুরানো হিন্দু সমাজে বিবাহ ছিল একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যা পরিবার, উত্তরসূরী ও ধর্ম পালন রক্ষা করত। বিবাহের মাধ্যমে দুই পরিবার ও গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হতো।

বিবাহ কেবল শারীরিক বা মানসিক সম্পর্ক নয়, এটা ছিল একটা ধর্মীয় বন্ধন, যা স্বামী-স্ত্রীকে পবিত্র কাজের সঙ্গে যুক্ত করত।


হিন্দু বিবাহের বৈশিষ্ট্য:

ধর্মীয় অনুষ্ঠান — হোমযজ্ঞ, অগ্নি সাক্ষী দিয়ে বিবাহ।  

সপ্তপদী — বিবাহকে শেষ করে।  

কন্যাদান — কন্যাকে স্বামীর হাতে দেওয়া।  

বিভাজ্যতা — বিবাহ বিচ্ছেদ সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, যদিও বৈদিক যুগে মাঝে মাঝে বিচ্ছেদের উদাহরণ আছে।

উপসংহার:

হিন্দু বিবাহ শুধু সামাজিক চুক্তি নয়, এটি একটা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বন্ধন। এটি বৈদিক ঋষিদের সময় থেকে এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে বদলেছে এবং হিন্দু ধর্মের চারটি পুরুষার্থ পূরণের একটি প্রধান মাধ্যম।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url