শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু নিয়ে দুইটা প্রধান ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। একটায় বলা হয় গান্ধারীর অভিশাপের বিষয় এবং অন্যটায় পূর্বজন্মের কর্মফল বা মহালীলার কথা। এই দুই দিক একে অপরকে পরিপূরক হিসেবে ধরা হয়, কারণ শাস্ত্র অনুযায়ী, ঈশ্বরের লীলা কখনো এক দিকের হয় না। গান্ধারীর অভিশাপ ও শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর রহস্য ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে জানতে হলে আমাদেরকে আগে জানতে হবে শ্রীকৃষ্ণ কে এবং কে এই গান্ধারী আসুন আমরা ধারাবাহিকভাবে তার বিশ্লেষণ করিঃ
 |
গান্ধারীর অভিশাপ ও শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর রহস্য |
শ্রীকৃষ্ণ: শ্রীকৃষ্ণ হলেন প্রধান ঈশ্বর, তাই তিনি পরমেশ্বর নামে পরিচিত।শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণের ছয় ধরনের রূপান্তরের কথা বলা হয়েছে।এগুলি হলো পুরুষ, গুণ, লীলা, শক্তি, যুগ ও মন্বন্তর অবতার।এরা সবাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একেকটি রূপ বা অংশ।নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য তাঁরা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে আসেন। অন্যান্য অবতারেরা যুগে যুগে এলেও, স্বয়ং কৃষ্ণ সবসময় আসেন না। অনেক বছর পর তিনি একবার আসেন।সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চারটি যুগ ১০০০ বার ঘুরলে (মোট ৮৬৪ কোটি বছর) তিনি একবার আসেন।যখন কৃষ্ণ আসেন, তখন তাঁর স্থান ও সঙ্গীরাও তাঁর সাথে পৃথিবীতে আসেন। ব্রহ্মসংহিতায় ব্রহ্মাজি বলেছেন, কৃষ্ণই পরম ঈশ্বর, তাঁর রূপ আনন্দপূর্ণ।তিনি সবার আগে এবং সবকিছুর কারণ। শ্রীমদ্ভগবতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, মানুষ ভক্তি ভরে অন্য দেবতাকে ডাকলে, সেই দেবতার মাধ্যমে আমিই তাদের ইচ্ছা পূরণ করি।এর মানে, দেবতারা যা দেন, তা আসলে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকেই আসে।
গান্ধারী: গান্ধারী মহাভারতের বেশ জরুরি এক নারী, তিনি কৌরবদের মা আর ধৃতরাষ্ট্রের বউ হিসাবে পরিচিত। তিনি গান্ধার দেশের রাজকুমারী ছিলেন, তবে মানুষ তাকে চেনে তার রাজনীতি, ধার্মিকতা আর তপস্যার জন্য। ধৃতরাষ্ট্রের চোখ ছিল না, তাই বউ হয়ে তিনি নিজের ইচ্ছায় সারা জীবন চোখের ওপর কাপড় বেঁধে রেখেছিলেন, এটা ছিল তার ত্যাগ আর স্বামীর জন্য ভালোবাসার প্রমাণ। তিনি চুপচাপ থাকতেন, অনেক সহ্য করতে পারতেন, এমনকি নিজের একশ ছেলের মৃত্যুতেও তিনি ধর্ম ছাড়েননি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবরা হারলে, গান্ধারী কৃষ্ণকে বদদোয়া দেন, কারণ তিনি মনে করতেন কৃষ্ণ চাইলে এই ঝামেলা থামাতে পারতেন। তার এই বদদোয়ার ফলেই নাকি দ্বারকা শহর ডুবে গিয়েছিল। গান্ধারীর জীবন হিন্দু ধর্মে ভালো স্ত্রীর এক দারুণ উদাহরণ।
গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে কেন অভিশাপ দিয়েছিলেন?
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরে গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে একটি কঠিন কথা বলেন, যখন তার একশ ছেলে, যারা কৌরব নামে পরিচিত, সবাই মারা যায়। একজন মা হিসেবে এত বড় কষ্ট সহ্য করা তার জন্য খুব কঠিন ছিল। তিনি মনে করতেন, শ্রীকৃষ্ণ সবকিছু জেনেশুনেও এই ভয়ানক যুদ্ধ বন্ধ করতে পারতেন, কারণ তার অনেক ক্ষমতা ছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ একটু অন্যভাবে যুদ্ধটা হতে দিলেন, তাই গান্ধারী ভাবলেন তিনি চাননি যুদ্ধটা বন্ধ হোক। এই রাগ, দুঃখ আর খারাপ লাগা থেকে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বলেন, যেভাবে কৌরব বংশ শেষ হয়ে গেছে, তেমনই একদিন যাদব বংশও নিজেদের মধ্যে মারামারি করে শেষ হয়ে যাবে। তার এই কথা পরে সত্যি হয়, যখন যাদবরা নিজেরা ঝগড়া করে তাদের বংশের শেষ হয় এবং দ্বারকা শহর নষ্ট হয়ে যায়। গান্ধারীর এই কথা মহাভারতের খুব জরুরি একটা অংশ, যা ভালো-মন্দ, কাজ আর ভাগ্যের কথা বলে।
শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর গান্ধারীর অভিশাপ ব্যতীত অন্যান্য দুটি কারণ:
পূর্বজন্মের কর্মফল ও লীলার ব্যাখ্যা: অনেক পুরাণে, যেমন ভাগবত পুরাণ ও ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে, শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুকে তাঁর পূর্বজন্মের কাজের ফল হিসেবে দেখা হয়। তিনি ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র নামে জন্ম নিয়েছিলেন এবং তখন বালী নামে এক বানররাজকে গুপ্তভাবে মেরেছিলেন। বালীর আত্মা তখন প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল, আর সেই আত্মা দ্বাপরযুগে জারা নামে শিকারির জন্ম নেয়। জারা ভুলবশত শ্রীকৃষ্ণকে তীর মারেন, কিন্তু এই ঘটনাটা আগেই লেখা ছিল এবং এটা রাম-বালীর সেই ঋণের পরিশোধ।
আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ও নিয়তির রহস্য: শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন পরমেশ্বরের অবতার। তিনি মানবদেহে এসে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধর্ম স্থাপন করেন এবং তারপর নিজ লীলায় অন্তর্ধান নেন। তাই তাঁর মৃত্যু ছিল না, ছিল লীলা-সমাপ্তি। জারার তীর ছিল শুধু উপলক্ষ। ঈশ্বর নিজেই তাঁর যাত্রার অবসান ঘটান যুগ পরিবর্তনের প্রয়োজনেই।
সংক্ষেপে: গান্ধারীর শাপে কৃষ্ণের মরণ এক লম্বা আর কঠিন ঘটনার অংশ ছিল, যা মহাভারতের পরের গল্পে বলা হয়েছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরে, গান্ধারী তাঁর একশ ছেলের মৃত্যুতে কৃষ্ণকে দোষ দিয়ে শাপ দেন—যাতে কৃষ্ণের বংশও নিজেদের ঝগড়ায় শেষ হয়ে যায়, যেমনটা হয়েছিল কৌরবদের, আর কৃষ্ণও একা, কষ্টে আর অপমানে মারা যান। এই শাপ আস্তে আস্তে সত্যি হয়। অনেক বছর বাদে দ্বারকা খারাপ হতে থাকে। যাদবদের মনে দেমাক, নেশা আর একে অপরের প্রতি খারাপ লাগা বাড়তে থাকে। একবার মাতাল যাদব ছেলেরা ঋষি-মুনিদের সাথে মজা করতে গিয়ে তাঁদের শাপে পড়েন। এতে যাদব বংশে ধ্বংসের শুরু হয়। একদিন সব যাদব প্রভাস তীর্থে ঘুরতে গেলে সেখানে মদ খেয়ে নিজেদের মধ্যে সাংঘাতিক ঝগড়া করে। বাঁশের গুঁড়ো থেকে তৈরি হওয়া লোহার লাঠি দিয়ে তারা একে অপরকে মারে। কৃষ্ণের বড় ভাই বলরামও তপস্যা করতে করতে মারা যান। যাদব বংশ শেষ হয়ে গেলে, কৃষ্ণ একা আর দুঃখী হয়ে জঙ্গলে যান। তিনি এক গাছের নিচে বসে ধ্যান করছিলেন। তখনই জারা নামের এক শিকারি, দূর থেকে কৃষ্ণের পা দেখে হরিণের মুখ ভেবে ভুল করে, তাঁর গায়ে বিষাক্ত তীর মারে। সেই তীর কৃষ্ণের পায়ের নিচে লাগে। শিকারি কাছে এসে বোঝেন যে তিনি ভুল করেছেন, কিন্তু ততক্ষণে কৃষ্ণের শেষ সময় এগিয়ে আসে। এই ঘটনার পিছনে কৃষ্ণের আগের জন্মের গল্প আছে—তিনি ছিলেন আগের জন্মের রাম, আর জারা হল সেই বালী, যাকে রাম লুকিয়ে মেরেছিলেন। সেই কাজের ফল হিসেবে অনেকে কৃষ্ণের এই মৃত্যুকে দেখেন। মরার আগে কৃষ্ণ জারাকে ক্ষমা করে বলেন, এটা আগে থেকেই লেখা ছিল। এভাবেই গান্ধারীর অভিশাপ, যাদবদের পাগলামি, আর আগের জন্মের কর্মফল মিলে কৃষ্ণ এক দুঃখের, একা আর মানুষের মতো মরণ পান। তাঁর মরণ ছিল ঈশ্বরের অবতার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সময়, যা যুগ বদলের শুরু আর কলিযুগের চিহ্ন হিসেবেও ধরা হয়। এই গল্প দেখায় যে ঈশ্বরও নিজের কাজের ফলের বাইরে নন, আর ধর্ম, কাজ ও সময় সবার জন্য একই রকম।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন রহস্য
আচ্ছা, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি পালন করে বেশ, তবে তাঁর প্রয়াণ দিবস পালন করে না কেন, বলুন তো? ভগবান কি মরেছিলেন নাকি শুধু লীলা সাঙ্গ করেছিলেন? আমরা তো জানি, যার জন্ম আছে তার মৃত্যু অনিবার্য। তবে ভগবানের ব্যাপারটা আলাদা। তিনি তো জন্ম-মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। তবুও তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন জীবের মঙ্গলের জন্য, শিক্ষা দিতে। ভগবান কখনো বলেন না তিনি ঈশ্বর, জ্ঞানীরা ঠিক বুঝে নেয়। যারা তাঁর লীলা বোঝে, তাদেরকেই তিনি নিজের কথা বলেন। অন্যদের জন্য এমন কিছু করেন, যাতে তারা বুঝতে পারে। এই লীলা শুধু তাদের জন্য। কেউ কি বলতে পারে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু কোথায় হয়েছে? কোনো প্রমাণ আছে কি? অনেকে হয়তো বলবেন, জরা নামের এক ব্যাধ তীর মেরেছিল। হ্যাঁ, জরা তীর মেরেছিল, এটা শাস্ত্রে লেখা আছে। কিন্তু এরপর লেখা আছে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর লীলা শেষ করেন জরার তীরে (শ্রীমদ্ভাগবত)। জীবের কল্যাণে যে অভিনয় করতে এসেছিলেন, তার থেকে মুক্তি নেন। কোথাও লেখা নেই তিনি মরে গেছেন। সত্যি বলতে, প্রভাস ক্ষেত্রের জঙ্গলে জরার তীরে বিদ্ধ হওয়ার পর ভগবান কিছু সময় জরার সঙ্গে কথা বলেন। তারপর জঙ্গলের বিষ্ণু মন্দিরে গিয়ে বিগ্রহের সাথে মিশে যান। সেই জায়গাটি এখন প্রভাস তীর্থ নামে খ্যাত। তার মানে, সাধারণ মানুষের মতো ভগবানের মৃত্যু হয়নি। এখানেই আমাদের সঙ্গে তাঁর একটা বড় পার্থক্য।
তাই দুঃখের ব্যাপার হল, যেখানে ঈশ্বরের মরণ হয়নি সেখানে মরণদিবস পালন করার মানে নেই। কিছু লোক আবার বলেন এই গল্প তো মহাভারতে লেখা নেই, মহাভারতে লেখা আছে শ্রীকৃষ্ণ তার পায়ে তীর লাগার পরে জরা নামের শিকারীকে ভরসা দেন ও স্বর্গে যান তারপর, আরও বলা হয়েছে অর্জুন, আগুনে পোড়ান বলরাম ও কৃষ্ণের দেহকে। আবার ভাগবত পুরাণে এই লুকানোর রহস্যটা আছে অন্যরকম, কোনটা সত্যি? মতামত জানান সবাই।
উপসংহার: শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পেছনে শুধুমাত্র গান্ধারীর অভিশাপই নয়, বরং আরও অনেক কারণ আছে। এখানে গান্ধারীর দুঃখের অভিশাপ, শ্রীকৃষ্ণের পূর্বজন্মের কিছু ঘটনা, যাদবদের পতন এবং একটা বড় পরিকল্পনার বিষয়ও আছে। সব মিলিয়ে, এটা কলিযুগের শুরু আর দ্বাপরযুগের শেষের একটি অঙ্গ। তাই শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু কেবলমাত্র প্রতিশোধ বা অভিশাপ নয়, বরং তা এক দীর্ঘ এক ঘটনার স্বাভাবিক পরিণতি।