কেন রবিবারে নিরামিষ খাবেন? জানুন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ

রবিবারে নিরামিষ খাবার খাওয়ার অভ্যাসটা হিন্দু ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা অনেক বছর ধরে চলে আসছে। এই দিনে নিরামিষ খাওয়ার আসল কারণ হলো সূর্যদেবকে সম্মান জানানো এবং তাঁর আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য উপবাস ও ভালোভাবে জীবনযাপন করা। সূর্যদেবকে শক্তি, স্বাস্থ্য আর সৌভাগ্যের দেবতা হিসেবে পূজা করা হয় এবং রবিবার হল তাঁর পুজোর দিন। নিরামিষ খাবার খেলে রাগ, ক্রোধ আর অহংকার নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আর এটা আত্মসংযমের একটা উপায়। এছাড়া, নিরামিষ খাবার দেহের শক্তি বাড়ায় এবং মানসিক শান্তি দেয়। তাই রবিবারে নিরামিষ খাওয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্য রক্ষা করা আর আত্মিক উন্নতির জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রথা।
কেন রবিবারে নিরামিষ খাবেন  hd
কেন রবিবারে নিরামিষ খাবেন 



ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সপ্তাহে একবার নিরামিষ খেয়ে দেখো। রবিবার একদিন আমিষ বাদ দিলে কিছু হবে না। শরীরটা ওই দিন আগের চাইতে ভালো লাগবে কি না, লক্ষ্য করো। পালনের দিন অন্তত দুইবার স্নান করবে; সকালে এবং দুপুরে অথবা দুপুরে ও বিকালে। আর নিরামিষ খেতে গিয়ে অতিরিক্ত নয়, যতবার খুশি বিশুদ্ধ জল খেতে পারো। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনের বেশি কিছু খাবার খাবেনা। ফলে দেখবে পেট পরিষ্কার হচ্ছে, জিহ্বা ভালো হচ্ছে, শরীরে অস্বস্তি নেই, অলসতা নেই, কাজ করতে ভালো লাগবে, শরীর হবে হালকা এবং মনে শান্তি আসবে। আয়ুর্বেদে নিরামিষের উপকারিতা নিয়ে বলা হয়েছে।—
‘অনবস্থিতদোষাগ্নের্লঙ্ঘনং দোষপাচনং।
জ্বরঘ্নং দীপনং কাঙ্ক্ষারুচিলাঘনপ্রাণদম্॥’

অর্থাৎ অগ্নির অনবস্থিততায় যে অজীর্ণ-রসরূপ দোষ এবং তজ্জনিত বায়ু-পিত্ত-কফের বৈষম্য রূপ দোষ জন্মে, উপবাসে সেই রসের বিকৃতিরূপ দোষের পরিপাক বা প্রকৃতিস্থতা হয়।সীমিত নিরামিষ  জরনাশক, জঠরাগ্নির উদ্দীপক, কার্য্যে আগ্রহ ও উৎসাহ-জনক—অর্থাৎ ‘খট্‌খটে—ঝর্‌ঝরে’ হয় এবং উহা ‘প্রাণদ’ অর্থাৎ জীবনীশক্তির বর্দ্ধক।তাহলে বুঝুন নিরামিষের কি গুন। 

সব মানুষের আর্থিক অবস্থা এক রকম নয়। কেউ ভালো থাকে, আবার কেউ বিপদে থাকে। শুধু আয়ের জন্য নয়, ভাগ্যকেও কিছুটা দোষ দেওয়া যায়। কখনও কখনও সৌভাগ্য আমাদের সাথে থাকে না, আর তখন নানা সমস্যা দেখা দেয়। তবে জ্যোতির্বিদ্যার মতে, রবিবার একটা ছোট কাজ করলেই অনেক সমস্যা মিটে যায়। প্রতি রবিবার সূর্য দেবের পুজো করলে সব সমস্যা কেটে যায়। এর ফলে আর্থিক অবস্থাও ভালো হতে পারে এবং ভাগ্যও সাথ দেয়। তাই প্রতি রবিবার স্নান করার পর সূর্য দেবের আরাধনা করা উচিত। উঠানে সূর্য দেবের পুজোর ব্যবস্থা করে সূর্য মন্ত্র পাঠ করতে হবে। ওই দিন বাড়ির গৃহিনী নিরামিষ খাবার খেলে ভালো।  

 রবিবারে নিরামিষ খাবার দশটি প্রধান কারণ

ভগবান সূর্যকে মহাবিশ্বের প্রাণশক্তি হিসেবে ধরা হয়। সূর্যই একমাত্র কারণ, যার জন্য আমাদের পৃথিবীতে জীবন আছে এবং তিনি প্রতিদিন আমাদের সামনে আসেন। সূর্যের পূজা করা আমাদের পুরনো একটা ঐতিহ্য, এবং বিজ্ঞানও তার আলোচনায় এসেছে কারণ সূর্যের রশ্মি আমাদের শরীর ভালো রাখতে সাহায্য করে এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ফলে, রবিবার ভগবান সূর্যের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য সেরা দিন বলে মনে করা হয়।

1. রবিবার সূর্য দেবতার পূজা করলে আপনার অনেক ইচ্ছা পূরণ হতে পারে। এই দিনটা সূর্য দেবতার জন্য বিশেষ। যদি আপনার অনেক ইচ্ছে থাকে, রবিবার আপনি উপবাস রাখতে পারেন। চলুন জানা যাক, সূর্য দেবতার আশীর্বাদ পাওয়ার কতটা সহজ কিছু উপায় এবং এর সুবিধাগুলো। সূর্যোদয়ের আগে উঠে স্নান করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

2. সূর্যের আরাধনা করতে, চেষ্টা করো সূর্য ওঠার আগে উঠতে। তারপর মলত্যাগ সেরে আগে সূর্যদেবকে তিনবার পূজা করো।

3. সূর্যের সাধনার সময় ভক্তির সঙ্গে তার নাম ও স্তোত্র পাঠ করা উচিত, এবং প্রতিদিন মন্ত্র জপ করতে হবে।

4. সূর্যের ভক্তদের জন্য প্রতিদিন আদিত্য হৃদয় স্তোত্র পড়া খুব দরকার। এটা পড়লে খুব দ্রুত সূর্যদেবের আশীর্বাদ মিলবে।

5. সূর্যের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য রবিবারে উপবাস রাখতে হবে এবং তেল, লবণ এসব খাবার এদিন এড়িয়ে চলা উচিত।

6. রবিবার উপবাসের সময় ব্রহ্মচর্য পালন করা জরুরি।

7. প্রতিদিন সূর্য দেবতার পূজায় চন্দন বা রক্তচন্দনের তিলক করুন।

8. যদি আপনার রাশিতে সূর্য অশুভ প্রভাব ফেলে, তাহলে গলায় একটি তামার মুদ্রা পরা সুফল দিতে পারে। একটি লাল সুতোয় তামার মুদ্রা পরুন।

9. জ্যোতিষশাস্ত্রে রবিবারে গম, তামা, ঘি, সোনা ও গুড় দান করার কথা বলা হয়েছে, যা সূর্যের অশুভ প্রভাব দূর করতে সাহায্য করে।

10. চোখ সুস্থ রাখতে বা চোখের রোগ দ্রুত নিরাময়ের জন্য চিকিৎসার সময় সূর্যের সাধনা করা দরকার। প্রতি দিন ভক্তির সঙ্গে নেটোপনিষদ পড়লে চোখের রোগ থেকে বাঁচতে সাহায্য করে। রবিবারে নিরামিষ খাওয়ারও উপকারিতা আছে।

রবিবারে নিরামিষ খাওয়ার ধর্মীয় ব্যাখ্যা

রবিবার নিরামিষ খাবার সম্পর্কিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা সূর্যদেবের উপাসনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। হিন্দু শাস্ত্রের মতে, রবিবার সূর্যদেবের দিন। তাঁকে জীবনশক্তির আধার ও সকলের মঙ্গলদাতা হিসেবে মনে করা হয়। তাই এই দিনে তাঁর পূজা করার জন্য নিরামিষ খাওয়া হয়।

নিরামিষ খাওয়ার কিছু কারণ হলো:

১. অহিংসার পালন: রবিবারে নিরামিষ খেলে অহিংসার নীতি পালন হয়। পশুহত্যার মাধ্যমে পাপ হতে পারে, যা সূর্যদেবের পূজায় বাধা দেয়। তাই এই দিনে নিরামিষ খাওয়া পুণ্যের কাজ।

২. পবিত্রতা ও শুদ্ধতা: সূর্যদেবের পূজার জন্য শরীর ও মন পরিষ্কার রাখা জরুরি। নিরামিষ খাবার গ্রহণ করলে শরীর ও মন তাৎক্ষণিকভাবে পরিষ্কার থাকে।

৩. তেজ বৃদ্ধি: সূর্যদেব তেজের দেবতা। মাংসের খাবার শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, কিন্তু নিরামিষ খেলে শরীরে পবিত্রতা ও শান্তি বজায় থাকে।

৪. শাস্ত্র নির্দেশ: অনেক পুরাণে রবিবারে নিরামিষ খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমন ‘সূর্য পুরাণ’ ও ‘ভবিষ্য পুরাণ’।
 
৫. উপবাস ও ত্যাগ: রবিবার নিরামিষ খেয়ে উপবাস করলে জীবনকে সংযত করা হয়। সংযম ও ত্যাগের মাধ্যমে সুখ-সমৃদ্ধি আসবে বলে মনে করা হয়।

রবিবার ব্রত পালনের নিয়ম:


ব্রতীকে সকালবেলা স্নান করে সূর্যোদয়ের সময় সূর্যদেবকে অর্ঘ্য দিতে হয়। অর্ঘ্য দেওয়ার সময় ‘ওঁ ঘৃণিঃ সূর্যায় নমঃ’ বললে ভালো। 

স্নানের পরে লাল ফুল, লাল চন্দন, লাল কাপড় এবং রক্তচন্দন দিয়ে সূর্যদেবকে পুজো করা হয়। 

এই দিনে লাল বা কমলা রঙের কিছু খাবার যেমন গাজর হালুয়া, মিষ্টি কিংবা লাল ফল দিতে হলে ভালো।

ব্রত পালনকারীকে নিরামিষ খাবার খাওয়া উচিত এবং এক বেলা খেলে ভালো হয়। 

সূর্য স্তোত্র, আদিত্য হৃদয়ম বা সূর্য বন্দনা পাঠ করাটাও খুব পুণ্য।

রবিবার ব্রত পালনের মাধ্যমে মানসিক শান্তি, শরীরের শক্তি, দীর্ঘায়ু ও সাফল্য লাভ করা সম্ভব। পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধি ও সন্তানের মঙ্গল কামনায় এর গুরুত্ব অনেক।

রবিবারে নিরামিষ খাওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

রবিবার নিরামিষ খাওয়ার পেছনে ধর্মীয় কারণই নয়, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণও আছে।

প্রথম কথা, রবিবারকে সূর্যদেবের দিন হিসেবে ধরা হয়, এবং এই দিন সূরের তাপ বাড়তে পারে। আমাদের শরীরের পাচনতন্ত্রও এই তাপের সাথে সম্পর্কিত। রবিবারে শরীরে প্রাকৃতিকভাবে তাপমাত্রা একটু বেশি থাকতে পারে, যা ভারী খাবার খেলে হজমে সমস্যা তৈরি করতে পারে। মাংস বা তেলের মতো খাবার শরীরে অতিরিক্ত তাপ তৈরি করে, যা গ্যাস্ট্রিক কিংবা বদহজমের মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। নিরামিষ খাবার সাধারণত হালকা হয় এবং সহজে হজম হয়, ফলে শরীরের ওপর চাপ কম পড়ে।

দ্বিতীয়ত, নিরামিষ খাবার যেমন আঁশ, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ, তা দেহের হজম শক্তি বাড়ায় এবং টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে। ফল এবং শাকসবজি খেলে লিভার ও কিডনির কাজ বাড়ে, যা স্বাস্থ্যকর।

তৃতীয়ত, নিরামিষ খেলে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের ওপর একটি আরামদায়ক প্রভাব পড়ে। মাংস খেলে শরীরে প্রোটিন এবং ফ্যাটের কারণে মেটাবলিজম বেড়ে যায়, যা রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দন বাড়াতে পারে। কিন্তু নিরামিষ খাবারে শরীরের শক্তি বজায় থাকলেও অতিরিক্ত চাপ পড়ে না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সপ্তাহে একটি দিন নিরামিষ খেলে আমাদের পেটকে বিশ্রাম দেয়। এই অভ্যস্ত হওয়া শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাই রবিবার নিরামিষ খাওয়া শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং শরীর ও মনে সুস্থতা বজায় রাখতে আসলেই গুরুত্বপূর্ণ।

মন্তব্য: হিন্দু ধর্মে রবিবারকে সূর্যদেবের ব্রত পালনের জন্য খুব পবিত্র দিন মনে করা হয়। সূর্যদেবকে শক্তি, স্বাস্থ্য ও সম্মানের দেবতা হিসেবে দেখা হয়। তাই এই দিন সূর্যদেবকে পূজা দেওয়া এবং ব্রত পালন করলে তাঁর আশীর্বাদ পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস। রবিবার ব্রতের মূল উদ্দেশ্য হলো সূর্যদেবের সাহায্যে স্বাস্থ্য, সৌভাগ্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও রোগমুক্তি পাওয়া। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ বা আর্থিক সমস্যায় রয়েছেন, তাদের জন্য রবিবারের ব্রত খুবই ফলপ্রদ বলে মনে করা হয়।  রবিবার নিরামিষ খাওয়া মানে সূর্যদেবের কৃপা পাওয়া, অহিংসা পালন করা এবং আত্মশুদ্ধি অর্জন করা।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url