পুত্রদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য - পূজা বিধি, কাহিনী ও ফল | Putrada Ekadashi Vrat Mahatmya
পুত্রদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য
পুত্রদা একাদশী ব্রত হিন্দু ধর্মে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্রতের মূল উদ্দেশ্য হল সন্তানের, বিশেষ করে পুত্রসন্তানের জন্য প্রার্থনা করা। শ্রীবিষ্ণুর ভক্তদের জন্য পুত্রদা একাদশী একটি বিশেষ উৎসব, যা মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে পালন করা হয়।
![]() |
পুত্রদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য |
ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর মতে, যেসব দম্পতি পুত্রসন্তান পেতে চান, তারা এই ব্রত পালন করলে সেই আশীর্বাদ পেতে পারেন। ব্রত পালন করতে ভক্তরা শ্রীবিষ্ণুর পূজা করেন, একাদশী উপবাস রাখেন, এবং নারায়ণের মহিমা গাইতে থাকেন। ব্রতের দিন তারা উপবাস ও হরিনাম সংকীর্তন করেন, এবং আর রাতে ভগবানের চরণে এর উদ্দেশ্যে জাগরণ করেন।
পুত্রদা একাদশীর গুরুত্ব বিষ্ণু পুরাণ ও পদ্ম পুরাণে বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ রয়েছে যে, এই ব্রত পালন করলে পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং পুত্রসন্তানের আশীর্বাদ ও মোক্ষ লাভ সম্ভব। তাই পুত্র কামনার জন্য পুত্রদা একাদশী ব্রতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, যা জীবনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
পুত্রদা একাদশীর ব্রত কাহিনী (Putrada Ekadoshi Brotho Kotha)
যুধিষ্ঠির বললেন, হে কৃষ্ণ! পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী কি নামে পরিচিত, কী অর্থ আছে এর, সেই দিন কোন দেবতার পূজা করা হয়, আর আপনি কি কারণে সেই ব্রতফলের বরদান দিয়েছেন, দয়া করে সব বিস্তারিতভাবে আমাকে জানান। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, এই একাদশী 'পুত্ৰদা' নামে পরিচিত। এটা সকল পাপের বিনাশ করে এবং এর দেবতা সিদ্ধিদাতা নারায়ণ। ত্রিলোকে এর মতো আর কোনো ব্রত নেই। এই ব্রত পালনে নারায়ণ মানুষকে সমৃদ্ধ ও খ্যাতিমান করেন। এখন শুনুন, এই ব্রতের মাহাত্ম্য কি।
একসময় ভদ্রাবতী পুরীতে সুকেতুমান নামে একজন রাজা ছিল। তার রাণীর নাম ছিল শেব্যা। তারা বেশ সুখে দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু বংশবৃদ্ধির জন্য অনেক চেষ্টা করার পরেও যখন তাদের কোনো সন্তান হলো না, তখন রাজা খুব চিন্তায় পড়লেন। সকল অর্থ-সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও পুত্রহীন রাজা মনে করতেন, তার জীবনবৃত্তান্ত অসম্পূর্ণ। তিনি ভাবতেন, একটা সন্তান ছাড়া জীবনের মূল দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। বাবা হওয়ার এই জগতে সুনাম আর ভালো জীবন পাওয়া যায় অর্থাৎ এ জগতে যশলাভ ও উত্তম গতি লাভ হয়। তাদের আয়ু, স্বাস্থ্য, আর সম্পত্তিও থাকে। এক সময় এক রাজা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার কথা ভাবলেন। তবে পরে ভাবলেন, আত্মহত্যা করা তো মহাপাপ। এতে শুধু দেহটা শেষ হবে, কিন্তু আমি তো সন্তানহীন থাকবই। এরপর একদিন রাজা গভীর বনে গেলেন। ভ্রমণ করতে করতে দুপুর হয়ে গেল আর তিনি খুব ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লেন। তারপর জল খুঁজতে লাগলেন এদিক সেদিকে। তিনি একটি সুন্দর সরোবর দেখতে পেলেন, যা বিভিন্ন পাখি এবং মাছ দিয়ে ভরপুর। সরোবরের পাশে মুনিদের একটি আশ্রম ছিল। তিনি সেখানে গেলেন। সরোবরের ধারে মুনিরা বেদের পাঠ করছিলেন। রাজা তাদের শ্রীচরণে প্রণাম করলেন। মুনিরা রাজাকে বলল, মহারাজ, আমরা 'বিশ্বদেব' নামে পরিচিত। এখানে আমরা স্নান করতে এসেছি। যেহেতু আজ থেকে পাঁচদিন পর মাঘ মাস আরম্ভ হবে। আর আজকের দিনটি বিশেষ—আজ পুত্রদা একাদশী। এই তিথিতে পুত্র দান করা হয়, তাই একাদশীর নাম রাখা হয়েছে ‘পুত্রদা’। রাজা এই কথা শুনে বললেন, “মুনিবৃন্দ, আমি তো সন্তানহীন। আমি পুত্রের জন্য খুব উদ্বিগ্ন। আপনাদের দেখে মনে আশার আলো ফুটেছে। দয়াকরে আমার জন্য একটা পুত্র দিন।” মুনিরা বললেন, মহারাজ! আজ পুত্র দানের জন্য একাদশী তিথি। তাই আপনাকে এখনই ব্রত পালন করতে হবে। ভগবান শ্রীকেশবের আশীর্বাদে আপনি পুত্র পাবেন।” রাজা মুনিদের কথা শুনে নিয়মমাফিক ব্রত পালন করলেন, শুধুমাত্র ফলমূল খেয়ে। দ্বাদশী দিনে সঠিক সময়ে শস্যসহ ব্রত সম্পন্ন করলেন। মুনিদের প্রণাম করে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন। শেষ পর্যন্ত রাজা ঠিক সময়ে একজন শক্তিশালী পুত্র লাভ করলেন। হে মাহারাজ! সবাইকে এই ব্রত পালন করা উচিত। আমি আপনার কাছে এই ব্রত সম্পর্কে বলছি মানব কল্যাণের জন্য। যেসব বিশ্বাসী লোক এই পুত্রদা একাদশী ব্রত পালন করবে, তারা 'পুত' নামে পরিচিত নরক থেকে রেহাই পাবে। আর এই ব্রত শোনালেও কীর্তনের ফল কেউ পাবে। ব্রহ্মান্ডপুরাণে এই গুরুত্ব বলা হয়েছে।
পুত্রদা একাদশীর পূজা বিধি (Putrada Ekadoshi Puja Bidhi full)
পুত্রদা একাদশী ব্রতের পূজা বিশেষভাবে পুত্র প্রাপ্তির আশায় করা হয়। এই ব্রতের পালন করার কিছু নিয়ম আছে:
1. **প্রারম্ভিক নিয়মাবলী**:
ব্রতের একদিন আগে অর্থাৎ দশমীর দিনে নিরামিষ খেতে হবে এবং নিজেকে পরিষ্কার রাখতে হবে। ব্রতের দিনে সূর্যোদয়ের আগে উঠতে হবে, স্নান করে একাদশী ব্রতের জন্য সংকল্প নিতে হবে।
2. **ব্রত ও উপবাসের নিয়ম**:
পুত্রদা একাদশীতে উপবাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি সম্পূর্ণভাবে নিরাহারে বা ফল খেয়ে থাকতে পারেন, আপনার শারীরিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। উপবাসী মানুষকে সবসময় ভগবান বিষ্ণুর নাম মনে রাখতে হবে।
3. **পূজা পদ্ধতি**:
শ্রীবিষ্ণুর মূর্তি বা ছবি একটি পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখুন এবং পূজা শুরু করুন। ধূপ, দীপ, ফুল, তিলক, পুষ্পমালা, তুলসী পাতা, ফল, এবং মিষ্টান্ন দিয়ে গুরুজনদের পূজা করতে হবে। নারায়ণের কাছে তুলসী পাতাদান খুব প্রিয়। ভগবানকে পায়েস, ফল এবং নিরামিষ ভোগ দিতে হবে। লক্ষ্মী দেবীরও পূজা করা ভালো। বিষ্ণুসহস্রনাম, গীতা পড়া, বা বিষ্ণু সহস্রনাম স্তোত্র পাঠ করা উচিত।
4. **পুত্রদা একাদশী ব্রতের বিশেষ প্রার্থনা**:
পুত্র পাওয়ার জন্য ভগবান নারায়ণের কাছে প্রার্থনা করতে হবে। নিচের মন্ত্রটি পড়লে ভালো ফল পাওয়া যায়:
"ওঁ নারায়ণায়বিদ্মহে, বাসুদেবায়ধীমহি, তন্নোবিষ্ণুঃ প্রচোদয়াত্ "
5. **রাত জাগরণ ও পরদিনের কাজ**:
একাদশী রাতে জাগরণ এবং হরিনাম সংকীর্তন করা উচিত। পরদিন দ্বাদশীতে ব্রত সমাপন করে ব্রাহ্মণকে দান ও অন্নদান করতে হয়। এরপর নিজে প্রসাদ গ্রহণ করে উপবাস ভঙ্গ করতে হবে।
**বিশেষ উপদেশ**:
পুত্র কামনায় এই ব্রত পালন করলে বৈধভাবে পুত্র লাভ হয়, কিন্তু পূজায় সততা ও ভক্তি থাকা জরুরি। মিথ্যা বলা, পরনিন্দা, বা খারাপ কাজ এদিন করা উচিত নয়। এভাবে শাস্ত্র অনুযায়ী পুত্রদা একাদশী পালন করলে ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় আপনি পুত্রলোভ এবং মুক্তি পাবেন।
পুত্রদা একাদশীর গুরুত্ব (Importance of Putrada Akadoshi)
পুত্রদা একাদশী ব্রতের গুরুত্ব হিন্দু ধর্মে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এই ব্রত মূলত পুত্রসন্তান পেতে করা হয়, তাই এর মাহাত্ম্য অনেক। যারা সন্তানহীন এবং বিশেষত পুত্রসন্তানের জন্য কাতর, তাদের জন্য পুত্রদা একাদশী পালন খুবই দরকারি। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে এটি পালন করা হয় এবং এটি পুণ্যকর, পাপ থেকে দূরে রাখে এবং জীবনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
পুত্রদা একাদশীর মাধ্যমে ভক্তরা শ্রীবিষ্ণুর কৃপা পেয়ে পুত্র পেতে পারে এবং সংসারের সুখ-সমৃদ্ধিও অর্জন করে। এই ব্রতের গুরুত্ব বিষ্ণু পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ, এবং পদ্ম পুরাণে বাড়তি গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে। এই দিনের উপবাস, শ্রীবিষ্ণুর পূজা, এবং ভক্তিভরে গান গাওয়া পাপ মোচন করে এবং জীবনে শুভ ফল আনে। তাই, পুত্রদা একাদশী শুধু পুত্রের জন্য নয়, পরিবার ও সংসারের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
পুত্রদা একাদশীর তারিখ (Putrada Ekadashi Date)
পুত্রদা একাদশী হিন্দু ধর্মে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্রত। এই ব্রত পুত্রসন্তানের আশা নিয়ে করা হয় এবং এটা বছরে দুইবার পালন করা হয়—একবার পৌষ মাসে আরেকবার শ্রাবণ মাসে।
২০২৫ সালে পৌষ পুত্রদা একাদশী হবে ১০ জানুয়ারি, শুক্রবার। এর শুরু হবে ৯ জানুয়ারি দুপুর ১২:২২ মিনিটে এবং শেষ হবে ১০ জানুয়ারি সকাল ১০:১৯ মিনিটে।
শ্রাবণ পুত্রদা একাদশী ২০২৫ সালে পালন হবে ৫ আগস্ট, মঙ্গলবার। এর শুরু হবে ৪ আগস্ট সকাল ১১:৪১ মিনিটে এবং শেষ হবে ৫ আগস্ট দুপুর ১:১২ মিনিটে।
এই দুই একাদশীতে উপবাস, শ্রীবিষ্ণুর পূজা, আর ভক্তির সঙ্গে নামসংকীর্তন করলে পাপ মোচন হয় আর পুত্রসন্তান লাভের আশীর্বাদ মেলে।
একাদশী ব্রত ফল (Ekadashi Vrat Benefits
একাদশী ব্রত হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রত, যা ভগবান শ্রীহরির উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। বলা হয়, একাদশী ব্রত পালন করলে অনেক পুণ্য পাওয়া যায় এবং সব পাপ শেষ হয়। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ যেমন বিষ্ণু পুরাণ ও পদ্ম পুরাণে একাদশীর সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে। যারা একদম নিষ্ঠার সঙ্গে উপবাস ও পূজা করে, তারা শ্রীবিষ্ণুর আশীর্বাদ লাভ করেন এবং জন্মজন্মান্তরের দোষ মুছে ফেলেন।
এছাড়া, একাদশী ব্রত পালন করলে মনের সুস্থতা আসে, শারীরিক ও মানসিক চাপ কমে, সংসার জীবনের দুঃখ চলে যায়, আর আধ্যাত্মিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। শাস্ত্রের মতে, একাদশীর ফল অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান। একাদশী ব্রতের দিনে দান, জপ ও সেবাকাজ করলে তার ফল অনেক গুণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে সন্তান সংগ্ৰহ, সুখ ও সমৃদ্ধি, রোগমুক্তি এবং মুক্তির জন্য একাদশীর ফল সত্যিই মূল্যবান।
তাহলে, একাদশী ব্রত পালন করলে শ্রীবিষ্ণুর আশ্রয় পেয়ে সংসার জীবনের সব কষ্ট দূর করা সম্ভব।
Frequently Asked Questions (FAQs)
Q: পুত্রদা একাদশীতে কি খাওয়া যায়?
A: পুত্রদা একাদশী সহ অন্যান্য একাদশী ব্রতে সাধারণত নিরামিষ ও সহজপাচ্য আহার গ্রহণ করা হয়। যেকোনো মৌসুমি ফল যেমন—আপেল, কলা, পেয়ারা, আঙুর, আম, নারকেল, দুধ, মিষ্টি দই, পনির (ছানা), ক্ষীর, সাধারণত আলু, মিষ্টি আলু, লাউ, কুমড়ো, কাঁচা পেঁপে, শসা, সাবুদানা (সাবুদানার খিচুড়ি বা পায়েস), সামাই (লালসা বা ক্ষীর), কুট্টু বা রাজগিরার আটা দিয়ে তৈরি রুটি বা পকোড়া, গোলমরিচ, আদা, হিমালয়ান লবণ (সেন্ধা লবণ) ইত্যাদি।
Q: পুত্রদা একাদশী কত তারিখে?
A: ২০২৫ সালে পৌষ পুত্রদা একাদশী হবে ১০ জানুয়ারি, শুক্রবার। এর শুরু হবে ৯ জানুয়ারি দুপুর ১২:২২ মিনিটে এবং শেষ হবে ১০ জানুয়ারি সকাল ১০:১৯ মিনিটে।