মালা জপ করার সঠিক পদ্ধতি, মন্ত্র ও নিয়মাবলী

 সনাতন ধর্মে মালা জপের বিশেষ গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য স্বীকৃত। সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা, ব্রত পালন বা উৎসব উপলক্ষে মন্ত্রজপকে অত্যন্ত ফলপ্রদ ও শুভকর বলে বিবেচনা করা হয়। প্রতিটি পূজা-পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট ধরনের জপমালার ব্যবহার প্রথাগতভাবে নির্ধারিত রয়েছে। জপমালা কেবল গণনার সহায়ক নয়, এটি আধ্যাত্মিক শক্তির ধারক ও মন্ত্রশক্তির সঞ্চালক। শাস্ত্রমতে সঠিকভাবে মালা জপ করলে মন্ত্রের পূর্ণ সিদ্ধি লাভ সম্ভব। বিভিন্ন দেবতার জন্য নির্দিষ্ট মালার ব্যবহার শাস্ত্রসম্মত, যেমন - বিষ্ণুর জন্য তুলসী, শিবের জন্য রুদ্রাক্ষ, লক্ষ্মীর জন্য পদ্মবীজ মালা প্রভৃতি।

মালা জপ করার সঠিক নিয়ম
মালা জপ করার সঠিক নিয়ম


মালার ব্যবহার মন্ত্রজপে মনঃসংযোগ বৃদ্ধি করে, জপমালা ১০৮ বা ২৭টি দানা বিশিষ্ট হওয়া আবশ্যক (১০৮-এর সংক্ষিপ্ত রূপ ২৭), জপ সমাপ্তির পর মালা প্রণামপূর্বক পবিত্র স্থানে বা মন্দিরে রক্ষণ করা কর্তব্য
নিশ্ছলভাবে মালা জপ শুরু করার আগে সঠিক নিয়ম জানা জরুরি। প্রথমে মুক্ত হাতে সামান্য জল নিয়ে "ওঁ বিষ্ণবে নমঃ" মন্ত্র পাঠ করে তা পান করুন। এভাবে মোট তিনবার জল গ্রহণ করতে হবে। তারপর করজোড়ে প্রার্থনা করে জপ শুরু করবেন।

মালা জপের মন্ত্র সমূহ :
ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং
সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ
দিবীব চক্ষুরাততম্॥
ওঁ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোঽপি বা।
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।।
‘ওঁ বিষ্ণু’‘ওঁ বিষ্ণু’‘ওঁ বিষ্ণু’
মালা জপ করার সঠিক নিয়ম
মালা জপের নিয়ম
মস্তকে তুলসী রেখে বলবেন :
নমঃ তুলসী দর্শনে পুণ্য
স্পর্শনে পাপ নাশন
স্মরণে তির্থানি
ভক্তিমে মুক্তি লক্ষণ নমঃ
গুরু প্রনামঃ
ঔঁ অখণ্ডমণ্ডালাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্।
তৎপদং দশি‘তং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।।
১.অঞ্জানতিমিরান্ধস্য ঞ্জানাঞ্জন শলাকায়া।
চক্ষু রুল্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।।
২. 'গুরু ব্রক্ষা গুরুবিষ্ণু গুরুদেবো মহেশ্বরঃ। 
গুরুঃ সাক্ষাৎ পরংব্রক্ষ তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।'
শ্রী কৃষ্ণ প্রনামঃ
হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপতে।
গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহঃস্তুতে ।।
শ্রী রাধারানী প্রণামঃ
তপ্ত কাঞ্চন গৌরাঙ্গীং রাধে বৃন্দাবনেশ্বরী।
বৃষভানু সূতে দেবী প্রণমামি হরি-প্রিয়ে।।
মালা জপ আরম্ভের মন্ত্রঃ-
অবিঘ্ন করু মালে, ত্বং হরি নাম-জপেষু চ।
শ্রীরাধা কৃষ্ণয়োর্দাস্যং দেহি মালে, তু প্রার্থয়ে।।
 বাংলা অর্থ হলো -তোমাতে হরি নাম জপ করিতেছি হে মালে  আমার সর্ব্ব বিঘ্ন দূরকর এবং শ্রীরাধা কৃষ্ণের দাস্য দান কর,করিতেছি এই প্রার্থনা ।
….
মন্ত্র জপ ১০৮ বার
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ------ রামরাম হরেহরে ।।

মালা জপান্তে নিন্মরুপ জপ সমর্পণ করিতে হয়ঃ-
গুহাতিগুহ গোপ্তা ত্বং গৃহাণাস্মং কৃতং জপং ।
সিদ্বি ভবতু-মে দেব ত্বৎ প্রসাদাৎ জনার্দ্দন।।

অর্থঃ হে পরমেশ্বর, পরমাত্মা, পরমপ্রিয় শ্রীকৃষ্ণ! আপনি গুহ্যতম ও গোপনীয় সমস্ত বিষয়ের রক্ষাকর্তা। তাই আমার এই নামজপ আপনি কৃপাপূর্বক গ্রহণ করুন। হে দেব! আপনার অপার কৃপায় যেন আমার সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়।
….
গীতায় স্মরণীয় নামগুলি জপ করিবেনঃ
ঔঁ গঙ্গা, গীতা, সাবিত্রী,সীতা, সত্ত্বা, পতিব্রতা,
ব্রহ্মবলি, ব্রহ্মবিদ্যা,ত্রিসন্ধ্যা, মুক্তি-গেহেনী,
অর্ধমাত্রা, চিদানন্দা,ভবঘ্নী, ভ্রান্তী নাশিনী,
বেদত্রয়ী, পরানন্দা,তত্ত্বার্থ, জ্ঞানমঞ্জরী।।
….
সবার শেষে ভুলত্রুটি ক্ষমা মার্জনা এর জন্য মন্ত্র :
পাপহং পাপকর্মাহং পাপাত্মাহ পাপসম্ভবো
ত্রাহিমাং পুন্ডরিকাক্ষং সর্ব পাপ হর হরি।।

বিভিন্ন মালার পরিচিতিও জপের নিয়ম এ উপকারীতাঃ

১)চন্দন মালা—চন্দনের মালা প্রধানত দুই প্রকার - সাদা ও লাল। লাল চন্দনের মালা শক্তি সাধনা ও তান্ত্রিক ক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয়। পক্ষান্তরে, কৃষ্ণমন্ত্র বা বৈষ্ণব মন্ত্রজপে সাদা চন্দনের মালাই প্রশস্ত। এই মালায় নিয়মিত জপ করলে ভক্তের ইচ্ছা অতি শীঘ্রই পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।

২) স্ফটিক মালা— এই মালা ধন-সমৃদ্ধি অর্জন ও মানসিক সংহতি সাধনের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এর পবিত্র শক্তিবলে পরিবেশের সকল নেগেটিভ এনার্জি ও অশুভ প্রভাব দূরীভূত হয়। লক্ষ্মী মন্ত্রের সাধনায় এই মালা ব্যবহার করলে দেবীর বিশেষ কৃপালাভ হয়। স্বাস্থ্যগত দিক থেকে, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই মালা ধারণ করলে চমৎকার উপশম অনুভব করতে পারেন।

৩) রুদ্রাক্ষ মালা— মন্ত্রসাধনায় এই মালার ব্যবহার সর্বাধিক প্রচলিত। রুদ্রাক্ষ মহাদেবের পরম প্রিয় হওয়ায়, মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের জপে এটি ব্যবহারই সর্বোত্তম পন্থা। শাস্ত্রীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, রুদ্রাক্ষ মালায় জপ করলে ভোলানাথ ত্বরিত প্রসন্নতা প্রদান করেন। বিভিন্ন দৈবসত্ত্বার উপাসনাতেও এই পবিত্র মালার প্রয়োগ শুভ ফলদায়ক বলে পরিগণিত হয়।

৪) বৈজয়ন্তী মালা— শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় এই বৈজয়ন্তী মালা। তাঁর কৃপালাভের জন্য বৈষ্ণবরা এই মালা ধারণ করেন। বৈজয়ন্তী মালায় মন্ত্র জপ করলে ভগবান বিষ্ণু দ্রুত প্রসন্ন হন এবং ভক্তদের ইচ্ছা পূর্ণ করেন। এই মালায় জপ করলে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং  সাফল্য লাভ হয় সকল কর্মে।

৫) হলুদের মালা— প্রায় সকল পূজা-অনুষ্ঠানে এই মালার ব্যবহার অত্যন্ত শুভকর বলে গণ্য হয়। গণেশদেব ও দেবগুরু বৃহস্পতিকে প্রসন্ন করতে এই মালায় জপ বিশেষ ফলপ্রসূ। সন্তানপ্রাপ্তি ও জ্ঞানলাভের কামনায় হলুদ রঙের মালায় বিশেষ মন্ত্রজপের বিধান রয়েছে। বগলামুখী সাধনায় এই মালায় জপ করলে দেবীর কৃপা অতি শীঘ্রই লাভ করা যায় বলে পৌরাণিক বিশ্বাস।

৬) তুলসী মালা—হিন্দু ধর্মমতে তুলসী গাছ ও তুলসী মালা পরম পবিত্র হিসেবে শ্রদ্ধেয়। মন্ত্রসাধনায় তুলসী মালার ব্যবহার সর্বাধিক প্রচলিত। শাস্ত্রীয় বিশ্বাস অনুসারে, তুলসী মালা ধারণপূর্বক বিষ্ণুমন্ত্র জপ করলে যশ-প্রতিপত্তি ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি লাভ হয়। এই মালায় জপ করলে একাধিক যজ্ঞফল প্রাপ্তির সমান পুণ্য অর্জিত হয়। তবে উল্লেখ্য, দেবী বা শিবসাধনায় তুলসী মালার ব্যবহার শাস্ত্রসম্মত নয়।

৭) পদ্মবীজের মালা- এই মালা দেবী লক্ষ্মীর বিশেষ প্রিয়। ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য লাভের কামনায় এবং লক্ষ্মী মন্ত্রের সিদ্ধির জন্য পদ্মবীজের মালাই সর্বোত্তম। এই মালায় নিয়মিত জপ করলে দেবী লক্ষ্মী অতি শীঘ্র প্রসন্ন হন এবং সাধককে সুখ-সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যময় জীবন দান করেন। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে সঠিকভাবে এই মালা ধারণ করে লক্ষ্মীসাধনা করাই প্রশস্ত পন্থা।

মালা জপের উপকারিতাঃ 
মন্ত্রজপে ব্যবহৃত মালার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। বিশ্বাস করা হয় যে প্রতিটি দেবদেবীর জন্য নির্দিষ্ট মালায় জপ করার রীতি রয়েছে। প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী, সাধক নিজের ইষ্টদেবতার অনুরূপ মালা নির্বাচন করে জপ করেন। এই দেবমালায় জপ করলে সংশ্লিষ্ট দেবতা ভক্তের বাসনা পূর্ণ করেন।  মন্ত্রের এমন অদ্ভুত শক্তি রয়েছে যে, একনিষ্ঠ মন্ত্রসাধনার মাধ্যমে চিত্তের একাগ্রতা অর্জন করে মোক্ষলাভ পর্যন্ত সম্ভব। মন্ত্র ও তন্ত্র - উভয়ই সর্বব্যাপী। মানুষের জীবনদর্শন থেকে শুরু করে ললিতকলা, সাহিত্যিকের রচনা, শিল্পীর তুলিকা, রেখাচিত্র অথবা কোনো ব্যক্তির চিন্তন-ভাবনার প্রক্রিয়াতেও মন্ত্রশক্তি তার প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সরলভাবে বলতে গেলে, মন্ত্রে এমন শক্তি নিহিত রয়েছে যা দ্বারা অসম্ভবকেও সম্ভবপর করা যায় - কেবল প্রয়োজন এর সঠিক সাধনা ও সাধকের প্রয়োজনীয় সিদ্ধিলাভ।

মালা জপ করার ভুলগুলি এড়ানোর উপায়:
মালা জপ বা জপ সাধনা একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া, তবে কিছু সাধারণ ভুল এড়িয়ে চললে এর সুফল লাভ করা যায়।কিছু সহজ উপায়:

1. মনোযোগ ধরে রাখুন
সমস্যা: জপ করার সময় মন অন্য দিকে চলে যায়।
সমাধান: জপের সময় শুধুমাত্র মন্ত্র বা ঈশ্বরের নামে মনোনিবেশ করুন। মন বিচলিত হলে ধীরে ধীরে আবার ফিরিয়ে আনুন।

2. সঠিক মালা ব্যবহার
সমস্যা: প্লাস্টিক বা অপ্রাকৃতিক মালা ব্যবহার করা।
সমাধান: তুলসী, রুদ্রাক্ষ বা স্ফটিকের মালা ব্যবহার করুন, যা ধর্মীয় ও শক্তিশালী বলে বিবেচিত হয়।

3. শুদ্ধ উচ্চারণ
সমস্যা: মন্ত্র বা নামের ভুল উচ্চারণ।
সমাধান: গুরু বা নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণ শিখুন।

পরিশেষে বলা যায়,মন্ত্র জপ করার সময় ব্যবহারকারি মালার এক আলাদা মহত্ব পূর্ণ স্থান আছে মানা হয় যে প্রত্যেক দেবী দেবতার জন্য আলাদা মালার জাপ করা হয়। পরম্পরা অনুসারে ব্যক্তি নিজের আরাধ্য দেবতার অনুসারে মালার জাপ করে থাকে।তারপরও কৃষ্ণ নাম ও মালা জপে ইহজগতে ও পরজগতে হাজার হাজার রকমের ফল লাভ করা যায়। হরে কৃষ্ণ। 

#ট্যাগঃমালা জপ করার সঠিক নিয়ম,মালা জপ করার নিয়ম,জপ করার নিয়ম,মালা জপ,মালা জপের নিয়ম,জপ মালা জপের নিয়ম,মালা জপ করার মন্ত্র,হরিনাম জপ করার নিয়ম,মালা জপের সঠিক নিয়ম,মালা জপ কিভাবে করতে হয়,মালা জপ করার নিয়ম,জপ করার পদ্ধতি,মালা জপ করার নিয়মাবলী,মহামন্ত্র জপ করার নিয়ম,গুরু মন্ত্র জপ করার নিয়ম,জপ করার সঠিক নিয়ম,জপ করার নিয়ম,মালা জপের মন্ত্র,মালা জপের পদ্ধতি,মালা জপ করার সঠিক নিয়ম মালা জপের মন্ত্র,গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার নিয়ম,কিভাবে মালা জপ করবেন,
Next Post Previous Post
1 Comments
  • সনাতনী আলাপন
    সনাতনী আলাপন May 3, 2025 at 2:38 AM

    Wow

Add Comment
comment url