কোন দেবতাকে কোন ফুল দেবেন? হিন্দু পূজায় ফুলের গুরুত্ব ও বিধান
কোন দেবতার কোন ফুল পছন্দ, আর কোন পুজোতে কোন ফুল কিভাবে ব্যবহার করা হয় তা জানানো খুবই কঠিন তা কিন্তু নয়। হিন্দু ধর্মে পূজা খুবই জরুরি। হিন্দু ধর্মে নানা দেবতা ও দেবীর পুজোর জন্য কিছু বিশেষ ফুল ব্যবহার করা হয়, যেগুলো তাঁদের পছন্দের। যদি আপনি দেবতাকে ফুল দেন এবং বাতি জ্বালান, তাহলে ভগবান আমাদের আশীর্বাদ করবেন। বলা হয়, ফুলের পূজা করলে ভগবান আমাদের প্রতি খুশি হন এবং ভালো ফল আনে। ফুলের সুগন্ধ সবসময় ভালো শক্তি আকর্ষণ করে, তাই পূজায় ফুল ব্যবহার করা উচিত। এই লেখায় আমরা জানাবো কীভাবে ফুল ব্যবহার করতে হয়, কোন দেবতার জন্য কোন ফুল ভালো, আর কেন ঈশ্বরের পূজায় ফুলের গন্ধ নেওয়া উচিত।
![]() |
কোন দেবতাকে কোন ফুল দেবেন |
কেন আমরা ঈশ্বরের পূজায় ফুল ব্যবহার করি?
মানুষের মনে হয় যে ফুলগুলো কিছু বিশেষ শক্তি আকর্ষণ করে। ফুল রাখলে একটা জায়গা আরও সুন্দর হয় এবং গন্ধও ভালো থাকে। তাছাড়া, ফুল মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। পূজা করার সময় মনকে একাগ্র রাখতে হয় এবং শান্ত থাকতে হয়। যদি ফুল ব্যবহার করা হয়, তাহলে তার গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যা সত্যি দারুণ। সব ফুল একরকম ভালো নয়। যেখানে আমরা ফুল দেই, সেটা পরিষ্কার ও ভালো হওয়া উচিত। ফুলে কোনো ক্ষতি বা দুর্গন্ধ থাকা ঠিক নয়। কিছু ফুল দেখতে বা গন্ধে সেভাবে ভালো নয়, তাই সেগুলো আমাদের প্রার্থনায় ব্যবহার করা উচিত নয়।
কোন ফুলে কোন দেবতা তুষ্টঃ
পুজোর জন্য ফুল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠাকুরের আসন সাজাতে সবারই ফুল চাই। অনেকেই বিশেষ দিনে পুরো ঘর ও ঠাকুরঘর ফুল দিয়ে সাজায়। কিন্তু প্রিয় দেব-দেবীর কাছে ফুল নিবেদন করার আগে কিছু বিষয় খেয়াল রাখাটা দরকার। যেমন, কোন দেবতা কোন ফুলে বেশি খুশি হন এবং কোন দেবতার পুজোয় কোন ফুল ব্যবহার করতে হয়। চলুন দেখে নিই কিছু তথ্য—
১. গণেশের পছন্দের ফুল হলো জবা। কিন্তু আপনি গণেশ দেবতার পুজো করতে দূর্বা ঘাস এবং যেকোনো ফুলও ব্যবহার করতে পারেন।
২. কৃষ্ণ পূজায় কুমুদ, করবী, চণক, মালতী, পলাশ ও বনমালা ফুল দিতে পারেন, কারণ এগুলো তার পছন্দের ফুল।
৩. মা দুর্গার পুজোর জন্য পদ্ম, চাঁপা ও পলাশ ফুল দিলে তিনি সন্তুষ্ট হন।
৪. মা কালীর পুজোয় রক্ত জবা ফুল ব্যবহার করতে হয়, কারণ এটা মায়ের পছন্দের ফুল।
৫. মা লক্ষ্মীকে পুকো দিলে পদ্ম, লাল গোলাপ ও হলুদ ফুল খুব ভালো।
৬. বজরঙ্গবলীর পুজোয় লাল জবা বা গাঁদা ফুল ব্যবহার করুন।
৭. ভগবান শ্রী নারায়ণকে তুলসী, পদ্ম, মালসিরি, জুঁই, কদম, মালতী, বাসন্তী ও চম্পা ফুল দিয়ে পুজো করুন।
৮. গোপাল ঠাকুরকে করবী, মালতী, পলাশ, গাঁদা ও তুলসী পাতা দিয়ে পুজো করুন।
৯. সরস্বতী পুজোয় সাদা বা হলুদ ফুল ব্যবহার করুন, বিশেষ করে পলাশফুল থাকা চান।
১০. লক্ষ্মী পুজোয় হলুদ ফুল লাগবে, কারণ মা লক্ষ্মীর পছন্দের রং হলুদ।
- বিষ্ণু/কৃষ্ণ: তুলসীপাতা, অপরাজিতা, পারিজাত - ভক্তি আর প্রেমের প্রতীক
- শিব: ধুতরা, আকন্দ, বেলপাতা ও বেলফুল - তপস্যা ও ত্যাগের প্রতীক
- দুর্গা: রক্তজবা, গাঁদা, অপরাজিতা - শক্তি, সাহস ও সাফল্যের কামনা
- লক্ষ্মী: শ্বেতপদ্ম, শাঁখু, শেফালি - ঐশ্বর্য আর সম্পদের আকর্ষণ
- সরস্বতী: শ্বেত অপরাজিতা, শ্বেত পদ্ম, বেলফুল - বিদ্যা, শুদ্ধতা এবং সৃজনশীলতার আহ্বান
- গণেশ: দুর্বা ঘাস, লাল জবা, গাঁদা - বাধা দূরীকরণ ও শুভ শুরু
- হনুমান: লাল জবা, রক্ত গাঁদা - শক্তি আর নির্ভয়তার প্রতীক
দেবতাদের উদ্দেশ্যে ফুল অর্পণের ঐতিহাসিক কাহিনী
পুরনো সময়ে, ভারতে এক মহান ঋষি থাকতেন, যার নাম ছিল ঋষি বিশ্বামিত্র। তিনি খুব জ্ঞানী আর তপস্বী ছিলেন, কিন্তু একসময় তার মনে অহংকার জন্ম নিল যে তাঁর তপস্যার কারণে তিনি দেবতাদের সমকক্ষ। একদিন দেবরাজ ইন্দ্র তার অহংকার দেখে তাকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বিশ্বামিত্রের আশ্রমের পাসে এক সুন্দর ফুলের বাগান গড়ে তুললেন, যেখানে দেবতাদের প্রিয় ফুলগুলো ফুটতে লাগল—জবা, চম্পা, পদ্ম আর তুলসী। বিশ্বামিত্র ফুলগুলো দেখে মুগ্ধ হলেন এবং সেগুলো নিয়ে নিজের পূজার জন্য গেলেন। কিন্তু তখনই আকাশ থেকে একটি শব্দ হলো: হে ঋষি, এই ফুলগুলো দেবতাদের জন্য। এগুলো মানুষের অহংকার বা ইচ্ছা পূরণের জন্য নয়, বরং ভক্তি ও নম্রতার চিহ্ন। বিশ্বামিত্র তখন তার ভুল ভেঙে বুঝতে পারলেন। তিনি ফুলগুলো দেবতাদের উদ্দেশ্যে অর্পণ করে ক্ষমা চাইলেন। তখন ইন্দ্র হাসি মুখে বললেন: ফুলের সৌন্দর্য আর দুর্গন্ধ ঈশ্বরের দান। এগুলো অর্পণ করলে মানুষ তার কৃতজ্ঞতা আর ভক্তি প্রকাশ করে। সেদিন থেকে মানুষের মধ্যে দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে ও আধ্যাত্মিক শুদ্ধি লাভের জন্য ফুল দেওয়ার প্রথা শুরু হলো। ফুলকে পবিত্রতার চিহ্ন হিসেবে দেখা হতে লাগল, কারণ এটি প্রকৃতিতে দেবতাদের উপস্থিতির বার্তা দেয়। এভাবেই ফুল দেওয়ার প্রথা হিন্দু ধর্ম ও অন্যান্য সংস্কৃতিতে ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
কীভাবে ফুল দিলে দেবতা প্রসন্ন হন?
দেবতা ভিন্ন ফুল পছন্দ করেন, আর ফুল দাওয়ার কিছু নিয়মও রয়েছে। যদি আমরা জানি কোন ফুল তাদের প্রিয় এবং কোনটা এড়িয়ে চলা উচিত, তবে পূজা আরও ফলপ্রসূ হয়।
দেবতাকে ফুল দিলে কেন তিনি খুশি হন? ফুল মানে সৌন্দর্য, বিশুদ্ধতা আর গন্ধ।
প্রতিটি ফুলের একটা বিশেষ শক্তি আছে, যা দেবতার গুণের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ফুলে থাকে প্রাণশক্তি, যা ঠিকভাবে নিবেদন করলে দেবতার আশীর্বাদ পেতে সাহায্য করে।
ফুল দেওয়ার নিয়ম:
ভোরে ফুল তুলে ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়। ফুল দেবতার সামনে সোজা করে রাখতে হবে, উল্টে নয়। শুকনো বা গন্ধহীন ফুল দেবতাকে দেওয়া উচিত নয়। ফুল দেওয়ার সময় মন্ত্র বললে তা আরও বেশি শক্তিশালী হয়।
যে ফুল দেবতাকে দেওয়া উচিত নয়:
- কাটা ফুল
- বিষাক্ত বা দুর্গন্ধযুক্ত ফুল
- অপবিত্র জায়গা থেকে তোলা ফুল
- রজনীগন্ধা (শিবকে দেওয়া নিষেধ)
- তুলসী পাতায় দাঁত লাগানো (বিষ্ণু/কৃষ্ণ নেন না)
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ফুল যত সুন্দরই হোক না কেন, যদি ভক্তি ও শ্রদ্ধা না থাকে, তবে পূজা অসম্পূর্ণ থাকে।
কেন আমাদের গন্ধ পাওয়া উচিত নয়?
ফুলের মধ্যে দেবতা ও দেবত্বকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা আছে। যখন মানুষ ফুলের গন্ধ শোঁকে, তখন সেটা তাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং ফুলের শক্তি কমিয়ে দেয়। ফুলের গন্ধ পেলে স্বাভাবিকভাবে তার মূলত্বও কমতে শুরু করে। আমাদের সংস্কৃতিতে এমন ফুল ভগবানকে দেওয়ার ধারণা নেই। এটার মধ্যে কিছু বিশেষ শক্তি এবং মূর্তির পরিচায়ক লুকিয়ে থাকতে পারে। তাই ভালো ফুল থাকলে সেটাই ভালো, এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে দেয়ার আগে আমাদের তা শোঁকা উচিত নয়।