মেয়ে শিশুর জন্মে উলুধ্বনি কম দেওয়ার রীতি: পিছনে ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ

হিন্দু ধর্মে সন্তান হওয়ার পর উলুধ্বনির ধারণা অনেক বইতে উল্লেখ আছে, যেমন মনুসংহিতা এবং উপনিষদ। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে আজও দেখা যায়, ছেলে হলে উলুধ্বনি দেওয়া হয়, আর মেয়ে হলে তা করা হয় না। মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে দাম্পত্যে সমস্যা হলো। তাহলে কি হিন্দু ধর্ম মেয়ে সন্তানকে কাম্য মনে করে না?

আসলে, সমাজকে গড়ার জন্য স্ত্রী ও পুরুষ দুজনেরই দরকার। হিন্দু ধর্মে নারীর বিশাল গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। আমাদের নামকরণের ধরনও দেখেন, যেমন জেঠি মা, পিশি মা, সবাইকে মা বলা হয়।

মেয়ে শিশুর জন্মে উলুধ্বনি কম দেওয়ার রীতি
মেয়ে শিশুর জন্মে উলুধ্বনি কম দেওয়ার রীতি


বৈদিক যুগে পিতামাতা শুধুমাত্র বিদ্বান পুত্রের কামনা করতেন না, তাঁরা বিদুষী কন্যাও চাইতেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে কন্যা সন্তানের জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথাও বলা হয়েছে।

‘যদি কেউ চান যে আমার বিদুষী কন্যা জন্ম নিক এবং সে দীর্ঘায়ু হোক, তবে স্বামী-স্ত্রী দুজনে একসঙ্গে তিল মিশ্রিত অন্ন বানিয়ে তাতে ঘি মিশিয়ে খাবে’। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৬/৪/১৭)

আমাদের অনেক দেবতা নারীরূপে পূজিত হন, যা নারীর গুরুত্ব বোঝাতে সাহায্য করে।

দশজন উপাধি অপেক্ষা একজন আচার্যের গৌরব বেশি; একশত আচার্যের গৌরব অপেক্ষা পিতার গৌরব বেশি, আর সর্বোপরি সহস্র পিতার তুলনায় মাতা বেশি সম্মানীয়। (মনুসংহিতা, ২/১৪৫)

সুতরাং, যারা কেবল পুত্র সন্তানেই খুশি, তারা ভুল পথে রয়েছেন। এসব সামাজিক কুসংস্কার থেকে বের হওয়া উচিত। হিন্দু ধর্ম নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়। একটি শিশু পৃথিবীর মুখ দেখা মানেই উলুধ্বনি পাওয়ার যোগ্য, সে ছেলে হোক বা মেয়ে।

ছেলে সন্তান জন্মালে উলুধ্বনি দেওয়া হয়, কিন্তু মেয়ে সন্তান হলে সাধারণত তা হয় না—এই নিয়মের পিছনে একটি গভীর সামাজিক এবং ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে, যা মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতিফলন।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজ:
প্রাচীন ভারতে সমাজ ছিল মূলত পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারের নাম, সম্পত্তি, আর গৌত্র পুরুষ সন্তানের মাধ্যমেই বংশ পরম্পরা ধরে রাখা হতো। তাই ছেলে সন্তানকে পরিবারের উত্তরাধিকার হিসাবে গর্বের বিষয় মনে করা হতো।

ধর্মাচরণ:
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বিশেষ করে মনুসংহিতায় ছেলে সন্তানকে ধর্মীয় কাজের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হয়েছে। তাই ছেলে জন্মকে ধর্মীয়ভাবে 'শুভ' মনে করা হত।

সমাজিক সম্মান:
প্রাচীন সময়ে ছেলে জন্মে উৎসব, দান, আর বাজনার মাধ্যমে উদযাপিত হতো। এভাবে সমাজে গর্বের ঘোষণা দেওয়া হত।

মেয়ে সন্তানকে বোঝা মনে করা:
মেয়েদের বিবাহের সময় পণ ও নির্ভরশীল জীবনের কারণে অনেক সময়ে মেয়েকে বোঝা হিসেবে দেখা হত। ফলে তাদের জন্মের সময় বিশেষ উদযাপন এড়িয়ে যাওয়া হত।

উলুধ্বনি উৎসবের অংশ:
উলুধ্বনি একটি ঐতিহ্যবাহী শব্দ, যা উৎসব বা শুভ সংবাদ প্রচারের সময় মেয়েরা দেন। ছেলে জন্মকে তখন শুভ সংবাদ ভাবে ধরা হতো বলে এই ধ্বনি বাজানো হত।

বর্তমান সময়:
এখন সমাজে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। অনেক পরিবারে মেয়ে সন্তানের জন্মেও উলুধ্বনি, মিষ্টি বিতরণ, এবং উৎসব পালন করা হয়। শিক্ষিত পরিবারের সদস্যরা পুরনো ধারণা ভেঙে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মেয়েদের সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন।

অবশেষে, আমরা সনাতনীরা ছেলে বা মেয়ে যেটিই হোক না কেন, তা সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করবো। কারণ নারী এবং পুরুষ সৃষ্টিকর্তার একই বৃন্তে দুইটি ফুল। যেমন দেবাদিদেব মহাদেবের শরীরে এক অংশ পুরুষ (শিব) এবং অপর অংশ স্ত্রী (পার্বতী)।

উলুর আওয়াজ নিয়ে বেশ কিছু গল্প আর বিশ্বাস আছে। অনেকেই এই আওয়াজকে আধ্যাত্মিক বা শুভ-অশুভ সংকেত মনে করেন।

প্রথমত, পুরাণে উলুর ডাককে দেবতাদের বার্তা হিসেবে দেখা হয়। ভারতের কিছু সংস্কৃতিতে, এই আওয়াজকে ভবিষ্যত ভবিষ্যদ্বাণী হিসাবে ধরা হয়। সাধারণত, ওটা প্রাণীদের সতর্ক করতে বা কোনও খারাপ ঘটনার পূর্বাভাস হিসেবে ধরা হয়।

আরেকটা কারণ হলো, উলু একটা নিশাচর পাখি হওয়ায়, তার আওয়াজ আসলে শিকার বা তার এলাকা নিয়ে তথ্য দেয়। মানুষের কাছে এটা অদ্ভুত লাগলেও, প্রকৃতির অংশ। 

শেষে, বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসে, উলুর আওয়াজে ভয় দেখা যায়। অনেকেই মনে করেন, এটা মৃতদের আত্মার বার্তা হতে পারে, তাই এ কারণে উলুর আওয়াজ শুনে মানুষ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে।

সবার জানা, উলুর ওই আওয়াজের পেছনে নানা কারণ আছে, যা মানুষের বিশ্বাস আর কল্পনার সঙ্গে জড়িত।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উলুধ্বনি (যা জয়ধ্বনি বা শঙ্খধ্বনি বলেও পরিচিত) বিভিন্ন উপলক্ষে উল্লেখ রয়েছে, বিশেষ করে পূজা, যুদ্ধ অথবা আনন্দের সময়। এখানে কিছু ধরণের উল্লেখ দেয়া হলো:

 

. বৈদিক যুগে শঙ্খ উলুধ্বনি

ঋগ্বেদে শঙ্খকে দেবতাদের শক্তি জয়ের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে।

 

যজুর্বেদে যজ্ঞ শুরু করার সময় শঙ্খধ্বনি বাজানো হত।

 

. পুরাণ ইতিহাসে উলুধ্বনি

মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে শঙ্খধ্বনির উল্লেখ আছে (যেমন: কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খ, অর্জুনের দেবদত্ত শঙ্খ, ভীমের পৌণ্ড্র শঙ্খ)

 

ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে শঙ্খধ্বনির কথা বলা হয়েছে।

 

রামায়ণে রাবণ বধের পর অযোধ্যার বিজয় উৎসবে শঙ্খ উলুধ্বনির উল্লেখ রয়েছে।

 

. পুরাণে উৎসব শুভ অনুষ্ঠানে উলুধ্বনি

স্কন্দ পুরাণ এবং ভবিষ্য পুরাণে দেবী পূজা বা শুভ কাজের সময় শঙ্খধ্বনি বাজানো, ঢাক-ঢোল বাজানো এবং মহিলাদের উলুধ্বনি দেওয়ার প্রথার কথা উল্লেখ আছে।

 

দেবীভাগবত পুরাণে দুর্গাপূজার সময় শঙ্খ উলুধ্বনিকে অশুভ শক্তির বিরোধিতা এবং শুভ শক্তির জয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

 

. ধর্মীয় আচারে উলুধ্বনি

বিবাহ, জন্ম উৎসব বা অন্যান্য শুভ কাজে হরিহর বা জয় দেবী বলে উলুধ্বনি দেওয়ার চল আছে।

 

দক্ষিণ ভারতের আগম শাস্ত্র অনুযায়ী দেবালয়ে শঙ্খ বাজানোর নিয়মও উল্লেখ আছে।

 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url