কেন উপবাস থাকতে হয়? উপবাসের ধর্মীয় ও স্বাস্থ্য উপকারিতা

ভূমিকা: পৃথিবীর একদম প্রথম দিক থেকে, মানে সেই পুরোনো দিনেও নানা ধর্মেই উপোস করার নিয়ম ছিল। মুসলিম ধর্মে যেমন রমজানে সারাদিন কিছু না খেয়ে সন্ধ্যায় ইফতার করার নিয়ম আছে। আবার হিন্দু ধর্মে যে কোনও পূজায় উপোস করাটা খুব দরকারি। দেবতাকে খাবার উৎসর্গ করা হবে, পূজা শেষ হবে, তারপর সেই খাবার খেয়ে সবাই উপোস ভাঙবে। শুধু এটা নয়, পৃথিবীর অন্য ধর্মগুলোতেও উপোস বা ফাস্টিংয়ের নিয়ম দেখা যায়।

উপবাসের ধর্মীয় ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
উপবাসের ধর্মীয় ও স্বাস্থ্য উপকারিতা

হিন্দু ধর্মে উপবাস হল একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক প্রথাযা আত্মসংযম  শুদ্ধির প্রতীক উপবাসের মানে হল ঈশ্বরের কাছে থাকাএটা মূলত খাবার ত্যাগ করে মানসিক  আধ্যাত্মিকভাবে পবিত্র থাকার প্রচেষ্টা। এটা শুধু আহার ত্যাগ নয়বরং ইন্দ্রিয়ের সুখ থেকে বিরতি দিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ চর্চা। হিন্দু ধর্মে একাদশীসোমবারশনিবার বা বিশেষ পূজা-পার্বণের দিনে উপবাস করা হয়। উপবাস আমাদের শরীরের জন্যও মঙ্গলজনককারণ এটি পাচনতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয় এবং শরীরকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। সাধারণত উপ্বাসের সময় ফলজল বা নিরামিষ খাবার নেওয়া হয়। উপবাসের মাধ্যমে আমরা কৃতজ্ঞতাধৈর্য এবং সহানুভূতির অনুভূতি জাগিয়ে তুলি। ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিআত্মশুদ্ধি এবং সৎ চিন্তার জন্য উপবাসকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটা শরীরমন  আত্মার মধ্যে সামঞ্জস্য আনেতাইহিন্দু ধর্মে উপবাস শুধু ধর্মীয় রীতি নয়এটি একটা জীবনযাত্রার অংশও বটে।

ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে উপবাস শব্দটির সঠিক অর্থ:

‘উপবাস’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘উপবাস’ (उपवास) থেকে। এর মানে হল ‘কাছাকাছি থাকা’। ‘উপ’ মানে ‘নিকটে’ এবং ‘বাস’ মানে ‘থাকা’। ফলে, এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ হয় ঈশ্বরের কাছে থাকা, যা আত্মসংযমের মাধ্যমে খাদ্য ত্যাগ করে মনকে ঈশ্বরের দিকে নিয়োজিত করার বিষয়। ‘উপবাস’ শুধু খাবার না খাওয়ার জন্য নয়, বরং এটি একটি আধ্যাতিক ও শারীরিক শুদ্ধি প্রক্রিয়া হিসেবেও গন্য হয়। অর্থাৎ উপবাসের মানে হল  ঈশ্বরের কাছাকাছি থাকা। শরীর আর মন দিয়ে তাঁর কাছে থাকা আর সময়ের খেয়াল না রাখা। ক্ষিদে ভুলে যাওয়া, কারণ মন তখন ঈশ্বরের আনন্দে ডুবে থাকে। অনেকে হয়তো সবসময় এটা পারে না। তবে লোকজন নানাভাবে উপোস করে। কেউ নরমাল খাবার বাদ দিয়ে অন্য কিছু খায়, কেউ ফল খায়, আবার কেউ শুধু দুধ খায়। কেউ শুধু দিনের বেলা উপোস করে রাতে খায়, আবার কেউ রাতে উপোস করে দিনে খায়। আসল কথা হল শরীর আর মনকে পরিষ্কার রাখা, আর ঈশ্বরকে তাঁর নানা নামে মনে করার চেষ্টা করা।হিন্দু ধর্মে, উপবাস রাখা জরুরি কিছু না, কিন্তু এটা ভালো আর মনের একটা শান্তি, যেখানে শরীর আর মনকে পরিষ্কার করে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়, তবে অন্যভাবে দেখলে উপবাস রাখতেই হয়।

উপোস থাকার যত উপকারিতা

উপোস রাখার কিছু ভালো দিক আছে, যা শারীরিক, মানসিক আর আধ্যাত্মিক। এখানে সেগুলো কিছু ভাগে ভাগ করে বলা হল:

 আত্মনিয়ন্ত্রণ: উপোস থাকলে আমাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছার ওপর নিয়ন্ত্রণ পাওয়া যায়।

 মনোসংযোগ: খাওয়া বন্ধ করলে মন শান্ত থাকে, যা প্রার্থনা, ধ্যান বা অন্য যেকোনো কাজে সাহায্য করে।

 আধ্যাত্মিক উন্নতি: অনেক ধর্মে উপোস করার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়।

 কৃতজ্ঞতা: ক্ষুধা অনুভব করলে আমরা দরিদ্রদের জন্য বেশি সহানুভূতি প্রকাশ করি।

 পাচনতন্ত্রকে বিশ্রাম: নিয়মিত খাদ্যের বিরতির ফলে পাচনতন্ত্র ভালো আক্রমণ করে।

 টক্সিন পরিষ্কার: উপোসের সময় শরীরের জমে থাকা টক্সিন বের হয়।

 ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ: রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে উপোস সহায়তা করে, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।

 ওজন কমাতে সাহায্য: উপোস আর সঠিক খাদ্য গ্রহণ ওজন কমাতে সহায়ক।

 কোষ পুনর্জন্ম: দীর্ঘ সময় উপোস রাখতে হলে কোষগুলি নিজেকে নতুন করে তৈরি করে, যা বার্ধক্য রোধে ভালো কাজ করে।

 হজম ক্ষমতা: উপোসের পর শরীর খাবার হজমে ভালো হয়।

 খাবারের প্রতি নজর: উপোস থাকার ফলে আমরা খাবারের ব্যাপারে আরও সচেতন হয়ে উঠি।

 খরচ কমে: নিয়মিত উপোস অর্থ সাশ্রয়েও সহায়ক হতে পারে।


উপবাসের নিয়ম:উপবাসের অনেক নিয়ম আছে, যেগুলো একটু কঠিন বা সহজ, পালন করাও কঠিন বা সহজ, আর এটা নিজের, পরিবারের আর সমাজের বিশ্বাসের ওপর বদলে যায়। কোনো কোনো সময়, উপবাস মানে হলো দিনের একটা বেলা না খেয়ে থাকা। কিন্তু উপবাসের মানে এটা না যে শরীরকে কষ্ট দেওয়া। মাঝে মাঝে, খাবার কমালেও কিছু খাবার বাদ দিয়ে অন্য কিছু খাওয়া যায়। যারা মাংস খায়, তারা শুধু সবজি খেতে পারে। যারা নিরামিষ খায়, তারা হয়তো ভাত, গম, বার্লি আর ডাল বাদ দিয়ে আলু খেতে পারে। এমনকি সারাদিন মিষ্টিও খাওয়া যায়। এর বাইরে, এই নিয়মগুলো প্রতিদিনের খাবারের বদল আর নতুন কিছু চেষ্টার একটা উপায় হতে পারে। উপবাসের একটা দিন ভালো কিছু করার চেষ্টাও হতে পারে। যেমন মোদক, নারকেল দিয়ে বানানো মিষ্টি আর চালের গুঁড়ো দিয়ে ঢাকা, এটা গণেশের পূজার জন্য বানানো হয়।

হিন্দু ধর্মে উপবাসের সময়  অনেক সময় ধরে উপবাস রাখা হয়। সবচেয়ে বেশি যে উপবাস রাখা হয়, সেটা হলো একাদশী, মাসে প্রায় দুইবার, চাঁদের দিনগুলোতে এটা করা হয়। বছরের শুরুতে শিবের জন্য আরেকটা বড় দিন আসে। জুলাই আর আগস্ট মাসে, অনেক হিন্দু শুধু সবজি খায় আর সোমবার ও শনিবার সন্ধ্যায় উপবাস ভাঙে। অনেক হিন্দু মেয়েরা ভালো স্বামী পাওয়ার জন্য সোমবারে উপবাস রাখে।

উপবাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:

ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও খাবারের দেশে উপবাস বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নানা অঞ্চলে উপবাসের চলন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সবার পেছনে একটা সাধারণ বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনা আছে। হিন্দু ধর্মে প্রকৃতি ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এটা একটা উপায়।

সাধারণত, সপ্তাহে অন্তত একদিন উপবাস করে আমরা প্রকৃতির থেকে কিছু না নিয়ে তার প্রতি সম্মান জানাই। এছাড়া, উপবাস আমাদের পাচনতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয়, লিভার ও অন্ত্রকে পরিষ্কার করে, যা স্বাস্থ্যসম্মত। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে, উপবাস আত্মসংযম, উৎসর্গ এবং আত্মশুদ্ধির চিহ্ন। একদিন খাবার না খাওয়া মানে কিছু প্রাণী বা গাছের জীবন রক্ষা করা, যা আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করতে সাহায্য করে।

উপবাসের সময় সহবাস করা যাবে কি?

সনাতন হিন্দু ধর্মানুসারে, যখন আপনি উপবাস রাখেন, তখন স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকা ঠিক না। উপবাস রাখা মানে শুধু খাবার না খাওয়া নয়, এটা নিজেকে কন্ট্রোল করার একটা নিয়ম। শরীর আর মনকে শান্ত রাখতে হয়। এই সময় মানুষ তার শরীরের চাহিদা, মনের খারাপ চিন্তা আর আরাম আয়েশ থেকে দূরে থাকে। তারা শুধু সৃষ্টিকর্তার কথা ভাবে, প্রার্থনা করে আর শান্তিতে থাকার চেষ্টা করে। একসঙ্গে থাকাটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়, তবে এটা শরীর আর মনকে অন্য দিকে নিয়ে যায়। তাই উপবাসের সময় এটা ঠিক না। হিন্দুশাস্ত্রে তাই বলা হয়েছে, উপবাসের সময় এসব থেকে দূরে থাকতে হয়, যাতে সবাই নিজের আত্মার উন্নতি করতে পারে।

উপবাসের আগে, উপবাসের দিন ও পরে কী করবেন—জেনে নিন:

হিন্দু ধর্মে উপবাস করা কেবল খাবার বাদ দেওয়া নয়, এটা শুদ্ধতা, সংযম এবং আধ্যাত্মিকতার ব্যাপার। একেবারে কিছু না খেয়ে উপোস করা সেরা মনে করা হয়, তবে শরীরের অবস্থা যেটা অনুমতি না দিলে, কিছু খাবার দিয়ে প্রসাদ নিতে পারেন। অনেক লোক নিয়ম সম্পর্কে জানে না, তাই এর বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া ঠিক হবে।

উপবাসের আগের দিন, রান্নাঘর ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং চুলাও পরিষ্কার রাখতে হবে। ওই দিন নিরামিষ খাবার খেতে হবে এবং একবার ভোজন করাটাই ভালো; চাইলে শুধু নিরামিষ খাবারও খেতে পারেন।

উপবাসের দিনে সকালে উঠে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরা উচিত। ওই দিন তেল মাখা, দিনের বেলা ঘুমানো, যৌন সম্পর্ক, জুয়া খেলা, মাদক নেওয়া এবং বিলাসী পোশাক পরা উপোসকারীদের জন্য নিষেধ। যারা পুরোপুরি উপোস করতে পারছেন না, তারা দুধ, ফল, মধু, জল বা ওষুধ নিতে পারেন।

উপবাসের পরের দিন, অর্থাৎ পারণ দিবসে, দিনে দুবার খাবার খেতে হবে, আমিষ, যৌন সম্পর্ক, দিনের বেলা ঘুমানো, দীর্ঘ যাত্রা এবং অন্যদের খাবার—বিশেষ করে যারা উপবাস করছেন না তাদের খাবার নিতে হবে—এই সব করা যাবে না।

শেষে বলতে চাই, আমরা ধর্মালম্বীরা ধর্মীয় বিধান নিয়ম মেনে উপবাস করার চেষ্টা করব। এই সময় খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে সচেষ্ট থাকব এবং উপবাসের সময় সবসময় কৃষ্ণ নাম বা ঈশ্বরের নাম নিয়ে থাকবো।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url