রাসলীলা কি? রাস উৎসবের ইতিহাস ও তাৎপর্য | Ras Leela & Ras Festival in Bengali

ভগবানের সেরা খেলা হলো এই রাসলীলা। শোনা যায়, রাসলীলার মধ্যে ভক্তরা আর ভগবান মিলেমিশে এক হয়ে যায়, অনেকটা গোপীদের আর তাদের বন্ধু শ্রীকৃষ্ণের মতো। রাসলীলা হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিয়েই। কার্তিক মাসের ভরা চাঁদের রাতে এই উৎসব হয়। তাই কার্তিকের পূর্ণিমাকে সবাই রাস পূর্ণিমাও বলে। শ্রীচৈতন্যদেবের রাস উৎসবের কথা অনেক দিন ধরেই বাংলায় চলে আসছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর গিরিশচন্দ্রের আমলে এই উৎসব খুব জনপ্রিয় হয়।

রাসলীলা কি রাস উৎসবের ইতিহাস ও তাৎপর্য
রাসলীলা কি রাস উৎসবের ইতিহাস ও তাৎপর্য

বৃন্দাবন, মথুরা, ওড়িশা, অসম, মনিপুর আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, কুচবিহারে খুব ধুমধাম করে রাস উৎসব হয়। আসল ব্যাপারটা রাধাকৃষ্ণের পুজো হলেও, একেক জায়গায় একেক রকমভাবে এই উৎসব হয়। যেমন, নদীয়ার শান্তিপুর আর নবদ্বীপে শুধু রাধা-কৃষ্ণ নয়, আরো অনেক দেব দেবীর পুজো হয়। প্রায় তিন-চার দিন ধরে খুব আনন্দের সঙ্গে এই উৎসব চলে। এমনকি উৎসবের শেষে একটা বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়।

'রস' মানে যেন জাদু, এক অচেনা ভালোলাগা, স্বর্গীয় ভালোবাসা। 'লীলা' মানে নাচানাচি। রাসলীলা আসলে পুরনো দিনের কৃষ্ণ আর বৈষ্ণব লেখার খুব মজার চরিত্র রাধার আজগুবি ভালোবাসার গল্প। রাধা আর কৃষ্ণ মিলে বৃন্দাবনের মেয়েদের সাথে এই নাচ করেন। অনেকে অনেক রকমভাবে রাসলীলার মানে বোঝান। বৈষ্ণব কবিরা তাদের লেখায় রাধা আর কৃষ্ণকে নিজেদের মতো দেখিয়েছেন। তারা বলেন, এটা হলো আত্মা আর পরমাত্মার দারুণ একটা মিলন। পরমাত্মা মানে তিনি, যিনি সবথেকে বড়, ঈশ্বর। যিনি পরমাত্মা, তিনিই কৃষ্ণ। গোপীরা আর রাধা খুব ভাগ্য করে কৃষ্ণের কাছাকাছি ছিলেন।

তবে ভাগবৎ পুরাণে রাধার নাম নেই। সেখানে বলে, কৃষ্ণ বৃন্দাবনের রাসমণ্ডলে সেখানকার মেয়েদের সাথে রাসলীলা করেন। তার মানে যাদের সাথে এই লীলা হয়েছিল, তারা অনেকে লোকের চোখে অন্য কারো বউ, মানে এটা একটা লুকানো ব্যাপার। কিন্তু ভাগবৎকার রাসলীলার শুরুতেই বলেন, এটা সাধারণ নয়, মানে অন্যরকম লীলা। ভগবান ঘুমের দেবী যোগমায়াকে ডেকে এই লীলা করেন, যেখানে গোপীরা থাকে আত্মারূপে। হর্ষচরিতের টীকাকার শঙ্কর মনে করেন, রাস হলো গোল করে নাচা, যেখানে আট, ষোলো বা বত্রিশ জন একসাথে নাচে। পদ্মপুরাণে শারদরাস বাসন্তীরাসের কথা আছে। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণে শুধু শারদরাসের কথা আছে, আর বাসন্তীরাসের কথা আছে শ্ৰীমদ্ভাগবত বিষ্ণুপুরাণে। ভাসের বালচরি হরিবংশে লেখা আছে, কৃষ্ণ গোপিনীদের সাথে হল্লীশনৃত্য করেছিলেন। হল্লীশনৃত্য যদি তালে তালে আর নানাভাবে সুন্দর হয়, তবে তাকে "রাস" বলা হয়। বিষ্ণুপুরাণের মতে, কৃষ্ণ গোপরমণীদের সাথে রাস করেছিলেন। শ্ৰীধর স্বামী বলেন, অনেক নর্তকী মিলে যে বিশেষ নাচ করে, তার নাম রাস।

শ্ৰীমদ্ভাগবতের একজন বিশেষ টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, নাচ, গান, চুমু আর আলিঙ্গনের রসের মিশেল হলো রাস, আর সেই খেলার নাম রাসক্রীড়া। শ্ৰীমদ্ভাগবতের মতে, কৃষ্ণ যোগমায়াকে কাছে ডেকেই রাস শুরু করেছিলেন। গোপিনীদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ বস্ত্রহরণের দিনে একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পরের পূর্ণিমায় তিনি তাদের সঙ্গে রাসলীলা করবেনযেই দিন হরি তাদের বস্ত্র হরণ করেছিলেন। গোপিনীদের কাছে তিনি এই অঙ্গীকার করেছিলেন যে, আগামী পূর্ণিমায় তিনি বৃন্দাবনে তাদের সঙ্গে রাসলীলা করবেন। আজ ভারতের উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবন মথুরা, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, ওড়িশা, আসাম, মণিপুর এবং এমনকি বাংলাদেশেও রাসযাত্রা উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। এই উৎসবে গোপিনীরা সম্মিলিতভাবে রাধা-কৃষ্ণের পূজা করেন এবং অঞ্চলভেদে কথ্থক, ভরতনাট্যম, ওড়িশি, মণিপুরি প্রভৃতি নৃত্যের মাধ্যমে রাসনৃত্যের শোভা বৃদ্ধি করেন। নবদ্বীপের সবচেয়ে মহাআড়ম্বরপূর্ণ উৎসব হল এই রাসলীলা।

শরৎকালে দূর্গাপূজার পরেই উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়; কার্তিকীপূর্ণিমায় নবদ্বীপের সেরা লোকায়ত উৎসব "রাস" হয়। এখানকার রাসের আসল জিনিস হলো মূর্তির বিশালতা। নানাভাবে শক্তির পূজা করাই নবদ্বীপের রাসের বিশেষত্ব, যেখানে সুন্দর মাটির মূর্তি তৈরি করা হয়। কত সুন্দর হাতের কাজ, কত নতুন চিন্তা, কত গভীর ধর্মীয় অনুভূতি, কত পণ্ডিতের মনের কথা, কত শিল্পীর নিখুঁত ছবিসবকিছু মিলে অনেক মানুষের মন জয় করে, যা প্রতিটি মূর্তিতে দেখা যায়। নবদ্বীপের রাস শুধু উৎসব নয়, এটা ধর্মের এক দারুণ প্রকাশ। রাস মূলত কৃষ্ণের ব্রজলীলার আদর্শে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় উদযাপিত একটি ধর্মীয় উৎসব; কিন্তু নবদ্বীপের রাস শাক্ত রসে সিক্ত। এখানকার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে দীর্ঘকাল ধরে তান্ত্রিক বীরাচারের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মদ-মাংস (পঞ্চমকারের অপরিহার্য অঙ্গ) এবং আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান ছাড়া বীরাচারের পূজা সম্পূর্ণ হয় না। নবদ্বীপের রাসে তন্ত্রাচারের গভীর ছাপ স্পষ্ট। অন্যদিকে, বৈষ্ণবীয় রাসের পবিত্র ভাবনা এখানে কিছুটা ম্লান। মন্দিরের অভ্যন্তরে রাধাকৃষ্ণের চক্ররাস অনুষ্ঠিত হলেও, শাক্তরাসের তীব্রতা তার আলোকে ঢেকে দেয়।

রাসলীলা কি করে পৃথিবীতে শুরু হলো এখন আমরা তার কাহিনী জানবো:

শোনা যায়, চৈতন্যদেব নবদ্বীপে রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসব শুরু করেছিলেন। যদি এটা সত্যি হয়, তবে মানতে হবে ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতেই রাসের শুরু হয়েছিল। চৈতন্যদেব সন্ন্যাস নেওয়ার পর নবদ্বীপের বৈষ্ণব আন্দোলন ধীরে ধীরে কমে যায়। গৌরাঙ্গ তাঁর অনুসারীরা বাধ্য হয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন। কারণে বৈষ্ণব উৎসবগুলোর ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়ে। পরে নবদ্বীপে যে রাস উৎসবের শুরু হয়, সেটা একদম নতুন এবং বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। এর পেছনে পুরাণের কিছু কাহিনী রয়েছে। রাসের অর্থ বুঝতে চাইলে আমাদের যেতে হবে বাংলার ভাবনা আন্দোলনে, যেখানে কবি জয়দেব পরবর্তী চন্ডীদাসের দ্বাদশ শতকে লেখা বৈষ্ণব পদগুলো গুরুত্বপূর্ণ। বৈষ্ণবরা কৃষ্ণকে স্রষ্টা হিসেবে আর রাধাকে সৃষ্টির প্রতিনিধির মতো দেখেছেন। স্রস্টার সঙ্গে যোগ দেওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো প্রেম। অনেক বছর ধরে সুফি সাধকরা বাংলায়ইশকএর মাধ্যমে প্রেমের ভাবনাটাকে প্রচার করে আসছেন। তাঁরা বলতেন, ‘হক এর সঙ্গে জীবের মেলবন্ধনের একমাত্র পথ হল প্রেম

এই ভাবনার নিবিড় সম্পর্ক আছে শ্রীচৈতন্যের রাধা বিষয়ক আন্দোলনের সঙ্গে চৈতন্যদেব বলেছিলেন রাধার মতন পরমাত্মার সঙ্গে মিশে যেতে তিনি এই তত্ত্ব পান বাংলার সুফিদের থেকে পরমাত্মার সাথে আত্মার মিলন ঘটিয়ে ছিলেন শ্রীচৈতন্য মণিপুরিদের রাসলীলা আসলে এক ধরনের নাটক। বলা যায় এটি ক্ল্যাসিকাল নাটক। সাধারণত মণিপুরের গানের ঐতিহ্য অনেক পুরনো মনে করা হয় তাদের পুরনো লোকনৃত্য কালের ধারায় ক্ল্যাসিকাল হয়েছে। ভারতের অন্য রাস থেকে মণিপুরিদের রাস অন্যরকম মণিপুরিদের পুরনো দিনের গল্প অনুযায়ী মণিপুর হলো সেই জায়গা যেখানে রাধাকৃষ্ণের মতো শিব পার্বতী নেচেছিলেন। গল্পের কথা অনুযায়ী, মণিপুরের কৌব্রু পাহাড়কে রাসলীলার জন্য তৈরি করতে শিব সূর্য, চাঁদ পাঁচটি গ্রহকে ডেকেছিলেন মণিপুরি ভাষায় এদের নাম হল নোঙমাইজিঙ, নিঙ্থোউকাপা, লেইপাক্পোকপা, য়ুমসাঙকেইসা, সাগোলসেন, ইরাই এবং থাঙজা। সাত দিন ধরে শিব-পার্বতী নেচেছিলেন

গন্ধর্বেরা ছিলেন এই শো-এর গানবাজনার বন্ধু, আর দেবতারাও জুড়ি দিয়েছিলেন। রাতের বেলা যখন সব চুপ, নাগরাজ অনন্তদেব তাঁর মাথার মণিটা দিলেন আলো করার জন্য। সেই মণির নাম থেকেই জায়গাটার নাম হল মণিপুর, যেন এক রূপকথা। পুরোনো দিনের গল্পলেখকেরা তাদের মনের মতো করে ইতিহাস সাজিয়েছেন। আসলে এই সব গল্পগুলো লেখা হয়েছে সেই সময়, যখন শিব ঠাকুরের খুব চল ছিল। পামহৈবা যখন মণিপুরের রাজা হলেন, তখন শিবের ভক্তরা একটু কোণঠাসা হয়ে গেল। রাজা পামহৈবা অন্য মতের বইপত্র সব নষ্ট করে দিলেন, তাই মণিপুরের আসল ইতিহাসটা কেমন যেন হারিয়ে গেল। তবে মণিপুরের লোকেরা শিবকে ভালোবাসতো, তাই শিব-পার্বতীর নাচ-গানের গল্পগুলো রয়ে গেল। তারপর একদিন বাঙলার গানের ঢেউ যখন মণিপুরে পৌঁছল, তখন বৈষ্ণব কবিদের গানগুলো খুব জনপ্রিয় হল। সেই গানগুলোর উপর ভিত্তি করেই মণিপুরি রাসলীলার জন্ম হল। আমাদের দেশের নাচের সাথে মণিপুরের লোকনৃত্য মিশে গিয়ে এক নতুন নাচের সৃষ্টি হল।

 

রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার ধারণাটা এসেছিল বাংলা থেকেই। মণিপুরি রাসের গানগুলোও বাংলা আর ব্রজভাষায় লেখা, বেশিরভাগই বাঙালি কবিদের লেখা। তার মানে রাসলীলা, যা সেই পুরনো দিনের গল্প, সেটাই এখন রাসপূর্ণিমা নামে পরিচিত। আমাদের দেশে কৃষ্ণের ভক্তরা নানান ভাবে রাস উৎসব পালন করে। কেউ কেউ আবার এই দিনে দেবদেবীর মূর্তি বানিয়ে পুজো করে। নবদ্বীপের রাসে শিল্পীরা বড় বড় ছবি এঁকে মন্দির সাজাতো, তাই রাসপূর্ণিমার আরেক নামপট পূর্ণিমা গরুর গাড়ির চাকার মতো বড় চাকা বানিয়ে তার মাঝে রাধাকৃষ্ণকে বসানো হত, আর চারপাশে থাকতো সখীর মূর্তি। ধীরে ধীরে সেই চাকা ঘোরানো হত। এখনও অনেক জায়গায় এইরকম হয়। মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ (১৭৪৮-১৭৯৯) এই নাচ-গানের উৎসব শুরু করেন। তিনি রাসনৃত্যকে নাটকের মতো করে সাজিয়েছিলেন। ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুরে প্রথম রাসলীলা মঞ্চস্থ হয়। সেই নাচে রাজার মেয়ে বিম্ববতী রাধার ভূমিকায় অভিনয় করেন, আর রাজা নিজে মৃদঙ্গ বাজিয়েছিলেন। শোনা যায়, রাজা নাকি স্বপ্নে রাসলীলা করার আদেশ পেয়েছিলেন। রাসের সুন্দর পোশাকগুলোও তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। আসলে ভাগ্যচন্দ্র ছিলেন একজন বুদ্ধিমান, জ্ঞানী আর শিল্পকলার প্রেমিক। তিনি রাসনৃত্যকে সুন্দর করে তোলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। পড়তে পড়তে আর ভাবতে ভাবতে তিনি মন্দিরের মধ্যেই ঘুমিয়ে যেতেন। রাসের নাচ, গান, সুর সবকিছু তিনি একটি বইতে লিখে রেখেছিলেন, যার নামগোবিন্দ সঙ্গীত লীলাবিলাস

রাজা ভাগ্যচন্দ্রের নাতি চন্দ্রকীর্তি ১৮৪৪ সালে রাজা হন। তাঁর সময় রাসনৃত্য আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। মণিপুরীদের রাসলীলার অনুষ্ঠানে পোশাক, নাচ-গান আর মঞ্চের সাজসজ্জা দেখলে মনে হয় যেন রাজার দরবারের অনুষ্ঠান। সত্যি বলতে, এই নাচের শুরু রাজবাড়িতেই, তাই এমনটা মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। রাসের পোশাকের নামপল্লই এই পোশাক দশটা আলাদা অংশে তৈরি। যেমন, মাথার উপরে পরার অংশের নামকোকতোম্বি মুখের উপরে যে হালকা কাপড় থাকে, তার নামমেইখুম্বী শরীরে পরে সবুজ ভেলভেটের ব্লাউজ, যার নাম ফুরিৎ, এতে সোনালী রূপালী কাজ করা থাকে। কোমরের কাছে বক্ষবন্ধনীর নাম থাব্রেৎ।

পল্লইয়ের প্রধান অংশ হলোকুমিন এই অংশে অনেক চুমকি ছোট ছোট আয়না বসানো থাকে, যা আলোতে চকচক করে। এর সাথে থাকে জরির কাজ করা পেশোয়ান, খোল, খাঙ্গই। আর মণিপুরি সোনার গয়না তো আছেই। এই রাজকীয় জিনিসটা সাধারণ মানুষ খুব সহজেই আপন করে নিয়েছে। সাধারণত এমন দেখা যায় না যে রাজবাড়ির কোনো জিনিস সাধারণ মানুষ এত সহজে গ্রহণ করেছে। কিন্তু মণিপুরের রাসলীলার ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে। এখন রাসলীলা শুধু রাজার নয়, সাধারণ মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই রাসের এই ভারী পোশাকপল্লইমণিপুরি বিয়ের একটা জরুরি অংশ। বিয়ের রাতে মৈতৈ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কনেকে এই পোশাক পরানো হয়।

এটা বেশ মজার যে, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও মণিপুরি পাঙনরা বিয়ের দিন রাসনৃত্যের পোশাকটি গায়ে চাপায়। একটা নাচের অনুষ্ঠান বা শিল্পের ধরণ কেন একটি দলের উৎসবে রূপ নেয়, এর গভীরে জটিল রাজনৈতিক সামাজিক কারণ আছে। মণিপুরি রাস শুরুর সময় বলা হয়, ‘রাস আরম্ভিলা ভাগ্যচন্দ্র মনোহর’, এটা মূলত রাস শুরু করা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের প্রতি সম্মান জানানো হয়। প্রথমে বৃন্দা নর্তন কৃষ্ণ নর্তন হয়। ভাগবত পুরাণের রাস-পঞ্চ-অধ্যায় অনুসারে কৃষ্ণ যাত্রা, রাধা-গোপীর যাত্রা, দল সাজানো, গোপীদের রাগ প্রকাশ, কৃষ্ণ-রাধার নাচ, গোপীদের নাচ, ভঙ্গি পারেং, রাধা কৃষ্ণের নাচে কৃষ্ণের হার রাধার বাঁশি পাওয়া, কৃষ্ণের হারিয়ে যাওয়া, রাধার কষ্ট, কৃষ্ণের ফিরে আসা দুজনের মিলন এই কয়েকটি ধাপে হয় মণিপুরি মহারাস। একটানা সাত-আট ঘণ্টা ধরে এই নাচগান চলে, একদম না থেমে। এখানে রাসের শিক্ষক বা বিচারক ছাড়াও সূত্রধারি মৃদঙ্গবাদকের বেশ দরকার লাগে।

রাসের নিয়ম, এর সাথে জড়িত কাজ সাধারণ মানুষের মনের ভাব ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায় মণিপুরি রাসলীলা শুধু একটা নাচ বা নাটক নয়, এটা অন্যকিছু। রাস দেখার সময় ভক্তরা রাধা, কৃষ্ণ গোপীদের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পরে, অনেকে কান্নায় ভেঙে যায়, রাস দেখতে আসা মানুষজন একে অপরের সাথে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। রাসের কিছু অংশ খুব দুঃখের, যেমন বিরহের সময় কৃষ্ণের হারিয়ে যাওয়ার পর রাধার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, গোপীদের কান্না পায়ের ছাপ দেখে কৃষ্ণকে খুঁজতে যাওয়ার দৃশ্য খুবই কষ্টের। মণিপুরি রাসের আসল বিষয় ভাগবৎ পুরাণ বৈষ্ণব কবিদের কবিতা থেকে নেয়া হলেও এর মাঝে বৃন্দা নামের একটি চরিত্র থাকে। পুরাণ পড়লে বোঝা যায় বৃন্দা পুরোপুরি মানুষের মনের তৈরি এক চরিত্র। বৃন্দা রাধার একজন বার্তাবাহক কিন্তু রাস শুরু হয় বৃন্দার নাচ দিয়ে। বৃন্দা মণিপুরি রাসেরচিংপীবা পরিচালক। রাধাকৃষ্ণকে ছাড়িয়ে তিনিই মণিপুরি রাসলীলার আসল মানুষ হয়ে দাঁড়ান। মণিপুরি রাসলীলা আসলে বৃন্দাদেবীরই রাসলীলা।

অন্য গোপীরা তাকে দেখে নাচের তাল তোলে। নাচের ওস্তাদ কঠিন ভাবে বলেন বৃন্দা ভুল করলে সবাইকে সেভাবেই নাচতে হবে।বৃন্দাশব্দটাবৃন্দাবনথেকে এসেছে নাকিবৃন্দাবননামটাইবৃন্দাথেকে এসেছে বলা শক্ত। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার বলছেবৃন্দাবননামটা সংস্কৃতেরবৃন্দা’ (তুলসী) আরবন’ (জঙ্গল) থেকে এসেছে। বৈষ্ণবরা বলেন বৃন্দা হলেন ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের তুলসীদেবী। সব পূজায় তুলসী লাগে, তাহলে কি তুলসী গাছই যমুনার পাড়ের বৃন্দা? বিষ্ণুর ভক্ত বলে বৃন্দার আরেক নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। মৈপুরীর রাসের বৃন্দাকে দেখলে মনে হয় খুব কাছের, যেন পাশের বাড়ির মেয়েটি যে শুধু কৃষ্ণভক্ত নয়, রাধারও খুব কাছের একজন। সে কৃষ্ণের জন্য কুঞ্জ সাজায়, রাধার সাথে ছায়ার মতো থাকে। সে মন খুলে গায়, "আমি কৃষ্ণের জন্য পাগল, বৃন্দাবনে বৃন্দা হতভাগী, আমি যুগলের পায়ের সেবা করব,যুগলের রূপ দেখব, জীবন সার্থক করব", মানে বৃন্দা নিজে কৃষ্ণকে চান না, যুগলের পায়ের কাছে থাকলেই সে খুশি।

এই যে নিজের সব কিছু ছেড়ে দেওয়া, এটাই কি ভক্তির আসল কথা? নিত্যরাস, বসন্তরাস, মহারাস, দিবারাস এরকম অনেক রাসের মধ্যে মহারাস সবচেয়ে বড়, যেটা হয় কার্তিক মাসের পূর্ণিমায়। সবাই চাইলেই মহারাস করতে পারে না, এটা এক একটা পরিবারের উপর দায়িত্ব পরে। রাস শুধু নাচ-গানের অনুষ্ঠান নয়, এটা একটা কঠিন ব্রত। রাসের এক মাস আগে থেকে এর প্রস্তুতি শুরু হয়। বিশেষ দিনে নাচের শিক্ষককে ডেকে আনা হয়। তিনি রাজি হলে ভালো দিনে নাচের শুরু হয়, নাচ শিল্পকলার কঠিন নিয়ম মেনে। রাসের মুদ্রাগুলো শাস্ত্র মেনে, নাচের ভঙ্গি ক্লাসিক্যাল। গানগুলো বৈষ্ণব ভাষায় লেখা, যা কবিতার মতো।

দূর থেকে দক্ষ শিল্পীরা আসে, তাদের কণ্ঠ যেন মধু ঢেলে দেয়, মায়াবী সুর তোলে মৃদঙ্গবাদক। শিল্পীরা যে পোশাক পরে, সেটাও পবিত্র, ধূপ জ্বেলে দেবতার পূজা করা হয়। রাস শুরুর আগে গুরুকে ডেকে বলা হয়, "আপনি আসুন" বাঁশ আর কাগজ দিয়ে রাস মঞ্চ তৈরি হয়, দেখতে দারুণ লাগে। মঞ্চটা ঠিক মাঝে বসানো হয়, সবাই গোল হয়ে বসে দেখে। রাস শুরু হওয়ার আগে নটপালা কীর্তন হয়, যেখানে সবাই চায় রাস যেন ভালো হয়। এটা বিশাল ব্যাপার। শুধু শিল্প দিয়ে এই অঞ্চলের সংস্কৃতি বোঝা যায় না। এর পেছনে আছে একটা জাতির পরিচয় আর টিকে থাকার চেষ্টা। যারা একসময় সবকিছু হারিয়ে এখানে এসেছে, সংখ্যালঘুদের ভিড়ে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি বাঁচাতে লড়ছে, রাসলীলা সেই যুদ্ধের একটা অংশ।

পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের রাধা আর কৃষ্ণ সাজানো হয়, কারণ মনিপুরীরা মনে করে এরপর তাদের জাদু ক্ষমতা কমে যায়। তবে আসল নাচ আর গান করে যুবতীরা, তারা রাধার বান্ধবী সেজে মঞ্চে আসে। নাচের মূল আকর্ষণ হল ভঙ্গি পরেং, মানে নাচের মালা। রাসলীলা শুরু হয় নট সংকীর্তন দিয়ে। গোবিন্দজীর মন্দিরে মৃদঙ্গ আর করতাল বাজিয়ে গান করা হয়। শিল্পীরা সুন্দর পোশাকে সেজে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের বন্দনা করে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে রাসসঙ্গীত পরিবেশন করে। কৃষ্ণ লীলা করলে সব ঠিক, আর আমরা করলে দোষ? এই লেখায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলার আসল মানে বোঝানো হয়েছে। আসুন, রাসলীলা সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতি রাধারাণী আর গোপীদের সাথে বৃন্দাবনের রাগমন্ডলে মহারাস লীলা করেছিলেন।

রাস নীলা নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন এবং সেগুলোর উত্তর এখানে দেওয়া হলো।

() রাস মানে কী ?

উত্তরঃ সৃষ্টিকর্তার আর মনের গভীর যোগসূত্রই রাস।

() গোপী আসলে কে ?

উত্তরঃ তারা হলো মন, যারা ভালো কাজ করে ঈশ্বরের সঙ্গে মিশেছে। রাসে কি শরীর বিষয়ক কোনো চাহিদা মাথাচাড়া দেয়? একদম না। প্রেমের দেবতা যখন নাচের আসরে এসে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিল, তখন ভগবান তাকে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। কারণ, মহান আত্মার সঙ্গে মনের মিলনে কোনো খারাপ চিন্তা থাকে না, সেখানে শুধু খাঁটি ভালোবাসা থাকে।

() নাচের তালে তালে ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে হওয়ার মানে কী?

উত্তরঃ রাসলীলা নকল করার মতো কিছু নয়। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, মহাদেব শিব, স্বর্গের রাজা ইন্দ্র, সব দেবতা, গন্ধর্ব, অপ্সরা-কারোর পক্ষেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর তাঁর প্রিয় শ্রীরাধারাণীর রাসলীলার ধারেকাছে যাওয়াও সম্ভব নয়। সেখানে সাধারণ মানুষ কী করতে পারে? ব্রহ্মা দীর্ঘ সময় ধরে তপস্যা করেও ব্রজের গোপীদের পায়ের ধুলোর কণাও পাওয়ার আশা পূরণ করতে পারেননি। স্বর্গের দেবী লক্ষ্মীও শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলায় ঢোকার সুযোগ পাননি, তাই তিনি নদীর অন্য পাড়ে কৃষ্ণের পায়ের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। মহাদেব শিবও রাসলীলা দেখতে গিয়ে ফিরে এসেছিলেন। তাহলে এখন যারা খারাপ স্বভাবের, যাদের শরীরে রোগ বাসা বেঁধেছে, যারা ধার্মিক নয়, খারাপ কাজে জড়িত, সবসময় নেশা করে, তারা কী করে রাধা-কৃষ্ণ সেজে রাসলীলা করে? অথবা রাধা-কৃষ্ণ নিয়ে খারাপ কথা বলে? তাই যারা রাসলীলা নিয়ে ভুল কথা ছড়ায়, তাদের উচিত ধর্মগ্রন্থ পড়া। আমাদের শাস্ত্র পড়লে বুঝবে রাস শুধু নাচ-গান নয়, এটা হলো আধ্যাত্মিকতার একটা দারুণ ফল। রাধারাণীকে প্রণাম, গোপীদের জয় হোক, ভগবানের জয় হোক।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url