বৈষ্ণব ধর্মমতের ইতিহাস: উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাব
বৈষ্ণব ভাবনার শুরু আর বেড়ে ওঠা পুরনো ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসে খুব দরকারি একটা দিক। এই মতের আসল মানুষ হলেন বিষ্ণু বা তাঁর অন্য রূপ, যেমন রাম, কৃষ্ণ বা নরসিংহ। বৈষ্ণব ধর্মের আগের রূপগুলো বেদ, উপনিষদ আর পুরনো গল্পে দেখা যায়, বিশেষ করে ভগবদ্গীতা আর বিষ্ণুপুরাণে এর গভীর চিন্তা আর আত্মার কথা খুব পরিষ্কার। যীশু আসার আগের এক হাজার বছরে বিষ্ণুর পূজার প্রমাণ পাওয়া যায়, কিন্তু গুপ্ত সময়ে (৪র্থ-৬ষ্ঠ শতাব্দী) এই ধর্মের নিয়মকানুন শক্ত হয়।
![]() |
বৈষ্ণব ধর্মমতের উদ্ভব ও বিকাশ |
মাঝে
রামানুজ (১১শ-১২শ শতক),
মধ্ব (১৩শ শতক), নিম্বার্ক,
বল্লভ আর চৈতন্য মহাপ্রভুর
(১৫শ-১৬শ শতক) মতো
শিক্ষকেরা বৈষ্ণব ধর্মকে অনেক ভাগে ভাগ
করেন। ভক্তিমূলক কাজের মধ্যে দিয়ে বৈষ্ণব ধর্ম
খুব পরিচিত হয় এবং এর
প্রভাব পুরো ভারত আর
নেপালে ছড়িয়ে যায়। এখনও বৈষ্ণব ধর্মের
ভেতরের আধ্যাত্মিক মানে, ভক্তদের কাজ আর গভীর
চিন্তার জন্য সারা বিশ্বে
অনেক মানুষ এটাকে পছন্দ করে।
বৈষ্ণব ধর্মমতের ইতিহাস
বৈষ্ণবধর্ম:
একটি পরিচয়
শৈবধর্ম
যেমন একটি প্রধান হিন্দু
ধর্মীয় শাখা, তেমনি বৈষ্ণবধর্মও হিন্দু ধর্মের অন্যতম বৃহৎ সম্প্রদায়, যা
শাক্ত ও স্মার্ত ঐতিহ্যের
পাশাপাশি হিন্দুধর্মের মূল ধারাগুলোর একটি।
২০১০ সালে জনসন ও
গ্রিম-এর তথ্যমতে, প্রায়
৬৪১ মিলিয়ন বা ৬৭.৬%
হিন্দু বৈষ্ণব, যা বৈষ্ণবধর্মকে হিন্দুধর্মের
বৃহত্তম শাখা হিসেবে চিহ্নিত
করে।
তাহলে,
বৈষ্ণব ধর্ম আসলে কী?
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর চৈতন্যলীলায় বৈষ্ণবের
প্রকৃত অর্থ ও লক্ষণ
সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি যখন কুলিন
গ্রামে হরিনামের প্রচার করছিলেন, তখন এক ব্যক্তি
জিজ্ঞাসা করেন, "প্রভু, বৈষ্ণব কাকে বলে? আমরা
বৈষ্ণবকে কীভাবে চিনব?" উত্তরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন, "যাঁর মুখ থেকে
একবারও হরিনাম বা কৃষ্ণনাম শুনবে,
তাকেই বৈষ্ণব বলে জেনে নিও।"
— হরিবোল!
তবে
বৈষ্ণবধর্ম শুধুমাত্র নাম উচ্চারণের মধ্যে
সীমাবদ্ধ নয়। শ্রীল ভক্তিচারু
স্বামী মহারাজ এই বিষয়ে গভীরভাবে
আলোচনা করেছেন এবং বৈষ্ণব জীবনের
তিনটি স্তর বা ধাপ
ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম ধাপ হলো নাম-অপরাধস্তর, যেখানে ভক্ত হরিনাম জপ
করলেও নানা অপরাধের দ্বারা
নামের শক্তি অনুভব করতে পারে না।
দ্বিতীয় ধাপ হলো নাম-আভাসস্তর, যেখানে ভক্ত ধীরে ধীরে
নামের প্রকৃত শক্তি উপলব্ধি করতে শুরু করে।
আর তৃতীয় ও শ্রেষ্ঠ স্তর
হলো শুদ্ধনামস্তর, যেখানে নাম জপ সম্পূর্ণ
নিষ্কলুষভাবে, অপরাধমুক্ত অবস্থায় হয় এবং কৃষ্ণপ্রেম
লাভ সম্ভব হয়।
কোটি হরিনাম জপ করলেও যদি তা অপরাধমূলক কর্মের সাথে যুক্ত থাকে, তবে তা থেকে কৃষ্ণপ্রেম লাভ করা সম্ভব নয়। কেবল মাত্র নাম উচ্চারণই যথেষ্ট নয়—হৃদয়ের গভীর থেকে আন্তরিক ভক্তিসহকারে নাম সংকীর্তন করাই একজন সত্যিকারী বৈষ্ণবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এভাবেই একজন সাধক তার ভক্তির গভীরতা অনুসারে আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করেন এবং শুদ্ধভক্তির মাধ্যমে কৃষ্ণচেতনায় প্রতিষ্ঠিত হন।"
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: শুদ্ধ ভক্তির গুরুত্ব: শুধু নামের সংখ্যা নয়, ভক্তির বিশুদ্ধতাই মুখ্য। অন্তরের ভক্তি: নাম জপ বা কীর্তন হৃদয়ের গভীর অনুরাগ নিয়ে করতে হবে। আধ্যাত্মিক অগ্রগতি: ভক্তির গুণমানই নির্ধারণ করে কৃষ্ণপ্রেমের স্তর।
(১)
কনিষ্ঠ বৈষ্ণব তিনিই, যার মুখে অন্তত
একবার শুদ্ধভাবে হরিনাম ধ্বনিত হয়।
(২)
মধ্যম বৈষ্ণব হলেন সেই ব্যক্তি,
যাঁর মুখে নিয়মিতভাবে হরি
ও কৃষ্ণ নাম শ্রবণ করা
যায়।
(৩)
উত্তম বৈষ্ণব হলেন তিনি, যাঁকে
একবার দর্শন করলেই আমাদের মুখ থেকে হরিনাম
নিজে থেকেই বেরিয়ে আসে।
এই তিনটি স্তরের মধ্য দিয়েই বৈষ্ণবদের
প্রকৃতি ও তাদের আত্মিক
অবস্থান বোঝা যায়। প্রতিটি
স্তর আমাদের শেখায় যে, শুদ্ধভাবে হরি
ও কৃষ্ণ নাম জপ করা
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রথমে নাম-অপরাধ থেকে
মুক্ত হতে হবে এবং
নামের আভাসের মাধ্যমে ধীরে ধীরে শুদ্ধনামের
স্তরে পৌঁছাতে হবে।
এই সাধনার পথ সহজ নয়, তবে ধৈর্য, নিষ্ঠা ও ভক্তির মাধ্যমে এটি সম্ভব। এই বিষয়গুলো বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছিল তাঞ্জোরে অনুষ্ঠিত একটি বৈষ্ণব আলোচনা সভায়, যেখানে বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ ছাত্ররা অংশ নিয়েছিল। এই সভার উল্লেখ পাওয়া যায় দ্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন-এর নভেম্বর ১৯০৯ সংখ্যায়।
বৈষ্ণব ধর্ম ও তার সম্প্রদায়ভিত্তিক বৈচিত্র্য
বৈষ্ণব ধর্মে চারটি প্রধান উপশাখা বা সম্প্রদায় রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটির নিজস্ব দার্শনিক ভিত্তি আছে। এই সম্প্রদায়গুলোর দৃষ্টিভঙ্গি জীবাত্মা (ব্যক্তিগত আত্মা) ও পরমাত্মার (বিষ্ণু বা কৃষ্ণ) সম্পর্কের সূক্ষ্ম পার্থক্যের উপর নির্ভরশীল। তবে, সব সম্প্রদায়ের মূল উদ্দেশ্য ও আধ্যাত্মিক পথ প্রায় অভিন্ন।
১. লক্ষ্মী সম্প্রদায়: এর দার্শনিক ভিত্তি হলো রামানুজাচার্যের প্রচারিত বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদ।
২. ব্রহ্মা সম্প্রদায়: মাধবাচার্য ও পরে চৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বারা প্রচারিত অচিন্ত্য ভেদ অভেদ তত্ত্ব এই সম্প্রদায়ের ভিত্তি।
৩. রুদ্র সম্প্রদায়: বিষ্ণুস্বামী ও বল্লভ আচার্যের প্রচারিত শুদ্ধাদ্বৈত দর্শনের অনুসারী।
৪. নিম্বার্ক সম্প্রদায়: এদের দর্শন দ্বৈতাদ্বৈত, যা জীবাত্মা ও পরমাত্মার পার্থক্য ও একতার একটি সম্মিলন।
এই প্রধান চার সম্প্রদায়ের পাশাপাশি আরও কিছু উপশাখা রয়েছে, যেমন—রামানন্দের রামানন্দি সম্প্রদায়, শঙ্করদেবের মহাপুরুষীয়া ধর্ম, এবং জগন্মোহন গোসাঁইয়ের প্রচারিত জগন্মোহনী বাউল মতবাদ।
বৈষ্ণবদের মধ্যে তিলক অঙ্কনের একটি বিশেষ রীতি রয়েছে। এটি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক পরিচয়ের প্রতীক নয়, বরং প্রতিটি সম্প্রদায়ের আলাদা তিলক আকার ও অর্থ আছে। সাধারণত, তিলকের আকৃতি ইংরেজি 'Y'-এর মতো, যা বিষ্ণুর পদচিহ্ন ও পদ্মের প্রতীক বহন করে। কেউ প্রতিদিন তিলক আঁকে, কেউ আবার উৎসব বা বিশেষ দিনে এটি ব্যবহার করে।
বৈষ্ণব ধর্ম মূলত বাংলাদেশের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একটি শাখা হিসেবেই উদ্ভূত। প্রাচীনকালে শিব ব্রাহ্মণদের কাছে কৃষ্ণের তুলনায় অধিক গ্রহণযোগ্য ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিষ্ণু ও কৃষ্ণ পূজা একত্রে মিশে যায়, যা আধুনিক বৈষ্ণব ধর্মের রূপ দেয়। বর্তমানে ভারতে এই ধর্মের অনুসারীদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও গুজরাটে।
বৈষ্ণবদের প্রধান তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে—শ্রীরঙ্গম, বৃন্দাবন, মথুরা, অযোধ্যা, তিরুপতি, পুরী, মায়াপুর, দ্বারকা, গুরুভায়ুর ও খেতুরী ধাম।
বিংশ শতাব্দীতে হপকিনসের গবেষণা অনুসারে, বৈষ্ণব ধর্ম ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রসারে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্যগুলোও বৈষ্ণব দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রামায়ণে রাম আদর্শ রাজা হিসেবে চিত্রিত হন এবং মহাভারতে কৃষ্ণ কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন—বিশেষত তাঁর উপদেশমূলক বক্তৃতা ভগবদ্গীতা ধর্ম ও নৈতিকতার দিক থেকে গভীর তাৎপর্য বহন করে। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা মহাকাব্যিক কাহিনি নিয়ে নাটক, গান ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ভগবদ্গীতা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এটি আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ধর্মীয় ও দর্শনীয় আলোচনার বিষয় হয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্বে বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে গবেষণা বেড়েছে। ১৯৯২ সালে স্টিভেন রোসেন এই বিষয়ে একটি গবেষণা পত্রিকা চালু করেন, যা এখনও বৈষ্ণব দর্শন নিয়ে আলোচনার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত।
বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক বা প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
একটু অন্যরকম, ১৯৬৬ সালে এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ইসকন শুরু করলে এটা সম্ভব হয়। আচ্ছা, দেখি ভাগবত বা বৈষ্ণব ধর্মের ক'জন বস? ১২ জন। চলো, তাদের খুঁজি। যমরাজ তার লোকেদের একদিন বললেন, এই যে শোনো, ভাগবত বা বৈষ্ণব ধর্মের ১২ জন বস এর নাম বলছি। খাতায় না, মনে গেঁথে নাও, নইলে সব ভুল হয়ে যাবে। যখন জপ করবে, তাদের নাম ধরে বসবে। কারণ তারা সেই ১২ জন, যারা বৈষ্ণব ধর্ম বসিয়েছিল। তাদের কথা মনে না রাখলে কিছুই হবে না।
(১)
স্বয়ম্ভু মানে ব্রহ্মা। তার
ওপর সব দায়িত্ব।
(২)
নারদ মুনি, যিনি দিন-রাত
ভগবানের নাম গেয়ে বেড়ান।
(৩)
শম্ভু মানে মহাদেব। তার
ওপর সব শেষ করার
দায়িত্ব।
(৪)
কুমার মানে সনদ কুমার।
(৫)
কপিল, যাঁর জন্য বাংলায়
আজও গঙ্গা মেলা হয়। বাংলাদেশ
থেকে মানুষজন ভারতে তীর্থ করতে আসে, আবার
ভারতের লোকেরা ঐ কপিল মুনির
গঙ্গা মেলার দিনে বাংলায় যায়।
(৬)
মনু সতর্বত।
(৭)
প্রহ্লাদ, হিরণ্যকশিপুর ছোট ছেলে। তাঁর
ডাকে নৃসিংহ দেব দেখা দিয়েছিলেন।
(৮)
জনক রাজা, সীতার বাবা, রামের শ্বশুর।
(৯)
ভীষ্ম, গঙ্গার ছেলে ভীষ্ম। কুরুক্ষেত্রে
অর্জুন যাকে তীর মেরে
তীরের ওপর শুইয়ে রেখেছিল।
তাঁর পেছনে অনেক গোপন কথা
আছে।
(১০)
বলি মহারাজ, যিনি বামন অবতারকে
সব দান করে নিজে
পাতালে গেলেন। তাঁর মতো বৈষ্ণব
আর কে আছে?
(১১)
বৈয়াসখি মানে ব্যাসদেবের ছেলে
শুকদেব গোস্বামী। যিনি পরীক্ষিত মহারাজকে
৮ দিন ধরে ভাগবতের
কথা শুনিয়েছিলেন।
(১২) অহম মানে আমি। সংস্কৃতে অহম মানে আমি, আসাম মানে আমরা দুজন, বৈয়ম মানে আমরা সবাই। তাই যমরাজ ১২ নম্বরে কাউকে না পেয়ে নিজের দিকে আঙুল তুলে বললেন, অহম, ১২ নম্বরে আমার নাম লেখো।
আচ্ছা, ৩ নম্বরে কার নাম? মহাদেবের নাম। মহাদেব ১ নম্বরে না এসে ৩ নম্বরে কেন? মহাদেব বৈষ্ণবদের মধ্যে তৃতীয়। তবে বৈষ্ণব হিসাবে তিনি সেরা।
ভাগবতের দ্বাদশ স্কন্ধে আছে, নদীর মধ্যে গঙ্গা সেরা, দেবতাদের মধ্যে বিষ্ণু সেরা, ১৮টা বইয়ের মধ্যে ভাগবত সেরা, তেমনই বৈষ্ণবদের মধ্যে মহাদেব সেরা।
বিষ্ণুর
সেরা ভক্ত হল বৈষ্ণব।
আবার বৈষ্ণবদের মধ্যে বিষ্ণুর সেরা ভক্ত হল
শিব। তাহলে মহাদেব যদি আমাদের মাথা
হয়, তাঁকে বাদ দিয়ে কি
কিছু হবে? হবে না।
তবে সব মিলিয়ে পৃথিবীতে
বৈষ্ণব ধর্ম ভালোভাবে বসিয়েছেন
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।
বিষ্ণুর প্রেম ছড়ানো আন্দোলনটা ছিল ভারতের পুরোনো দিনের এক জরুরি ধর্মীয় আর সমাজের ঢেউ। এটা আসলে হিন্দুদের বিষ্ণুকে ভালোবাসার উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা ধর্মীয় কাজ, যার আসল উদ্দেশ্য ছিল বিষ্ণুর প্রতি মন দিয়ে ভালোবাসা দেখিয়ে মুক্তি পাওয়া। এই কাজটা প্রথম শুরু হয় দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে অন্ধ্র, তামিলনাড়ু আর কর্ণাটকে, আর পরে এটা উত্তর ভারতের নানা দিকে ছড়িয়ে যায়। বিষ্ণুর প্রতি ভালোবাসা দেখানোর আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিলেন আল্বর নামের কিছু সাধু, যারা তামিল ভাষায় বিষ্ণুর ভালো কথা গানের সুরে বলতেন। পরে রামানুজ, মাধবাচার্য, চৈতন্য মহাপ্রভু, মীরাবাঈ, তুকারাম এইসব ভক্ত কবি আর ধর্মগুরু এই কাজটাকে আরও বাড়িয়ে দেন। এই আন্দোলনে ধর্মের ভুল ধারণা, জাতপাতের ভেদাভেদ, আর ব্রাহ্মণদের শাসনের বিরুদ্ধেও কথা বলা হয়। বিষ্ণু আর তাঁর রূপ রাম ও কৃষ্ণকে ভগবান মেনে সাধারণ মানুষজনের মধ্যে ভালোবাসার মাধ্যমে নিজের ভেতরের মুক্তি পাওয়ার রাস্তা দেখানো হয়।
চৈতন্য মহাপ্রভুর
দলের লোকেরা এই আন্দোলনকে বাংলায়
খুব ছড়িয়ে দেন আর গৌড়ীয়
বৈষ্ণবধর্মের জন্ম হয়। তিনি
কৃষ্ণ নাম জপ করে
ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা আর নিজেকে সঁপে
দেওয়ার কথা বলেন। এই
আন্দোলন মানুষের ভেতরের ভালোবাসা আর ভক্তিকেই ঈশ্বরের
কাছে যাওয়ার রাস্তা মনে করত। এতে
ধর্মকে একটা সহজ সরল
পথ হিসেবে দেখানো হয়। মেয়েরা, ছোট
জাতের মানুষ আর গরিব লোকেরাও
এই আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মীয় মুক্তি পাওয়ার সুযোগ পান। এই আন্দোলন
ভারতের গান, কবিতা আর
সংস্কৃতির উন্নতিতে অনেক সাহায্য করে।
এটা হিন্দুধর্মে একটা নতুন শুরু
ছিল, যেখানে নিজের ভক্তি, মন থেকে ঈশ্বরকে
ডাকা আর সমাজের সব
মানুষ সমান এই কথা
বলা হয়। বিষ্ণুর প্রতি
ভালোবাসা দেখানোর আন্দোলন শুধু একটা ধর্মীয়
কাজ ছিল না, এটা
ছিল একটা নতুন সংস্কৃতি,
যা ভারতীয় সমাজ আর ধর্মের
চিন্তায় অনেক বড় পরিবর্তন
আনে।
বলা
যায় তাই, না আলাদা
কিছু, ধর্ম তো সেই
সনাতন ধর্মই। এর মধ্যে বৈষ্ণব
একটা পথ শুধু, যারা
বিষ্ণুর ভক্তিতে মগ্ন থাকে। পুরনো
দিনের ভারতীয় ভক্তরা পাঁচ ভাগে ভাগ
হয়ে পূজা করত। যেমন
- বিষ্ণুর ভক্ত বৈষ্ণব, শিবের
ভক্ত শৈব, শক্তির ভক্ত
শাক্ত, সূর্যের ভক্ত সৌর, গণেশের
ভক্ত গাণপত্য। এই পাঁচ ভক্তকে
একসঙ্গে পঞ্চদেবতা আর তাদের পূজাকে
পঞ্চ উপাসনা বলা হতো আগে।
যার মুখ দিয়ে সবসময়
হরিনাম বা কৃষ্ণনাম ভেসে
আসে।